বড্ড বেকায়দায় পড়েছেন বেচারা রুতে। ন্যাটো সম্মেলন শেষে সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ। এক পর্যায়ে ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘ড্যাডির’ সাথে তুলনা করেন। বলা বাহুল্য আক্ষরিক অর্থে তো নয়ই। আর যায় কই! ডাচ ও বিশ্ব মিডিয়া হৈচৈ করে উঠলো। তারা সমালোচনায় মুখর হয়ে বলতে লাগলো, ট্রাম্পকে তিনি ‘ড্যাডি’ হিসাবে সম্বোধন করেছেন। এতে নিজেকে খাটো করেছেন, ‘সাইকোফেনসির’ তো একটা সীমারেখা থাকা চাই ইত্যাদি ইত্যাদি। সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত লিখবো একটু পর। তার আগে দেখা যাক কে এই রুতে। পুরো নাম মার্ক রুতে। জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ‘ন্যাটোর’ সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের ৩২টি দেশ নিয়ে যে সামরিক জোট, যা সংক্ষেপে ‘ন্যাটো’ হিসাবে পরিচিত তার সেক্রেটারি জেনারেল তিনি। ন্যাটোয় যোগ (২০২৪ সালের ১ অক্টোবর) দেবার আগে তিনি ছিলেন হল্যান্ডের দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী। ছিলেন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ, যদিও বা সময়ে–সময়ে নানা কারণে (সরকারের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত) তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সে কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগে তার কোয়ালিশন সরকারের পতনও হয়েছিল। কিন্তু নতুন নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেছেন। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন, দেখতে সুদর্শন। সেটিও একটি গুণ কেননা কথায় আছে ‘আগে দর্শনধারী তো পরে গুণবিচারী’। সংসদে দক্ষতার সাথে বিরোধী দলের সাথে বিতর্কে যুক্তি তুলে ধরেন। ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমার ভালো লাগে। যদিও বা তার কনজরাভেটিভ লিবারেল দল, (ফেই ফেই দে)-কে গত ৩৪ বছরে অনুষ্ঠিত কোন নির্বাচনে ভোট দেইনি। রুতে সাধারণ জীবন–যাপন করেন। তার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন থেকে নিজে সাইকেল চালিয়ে সংসদে যেতেন অফিস করতে। বৃষ্টি–বাদলেও। কদাচিৎ গাড়িতে চড়তেন। ভদ্র ও মার্জিত বলে তার সুনাম রয়েছে। অকৃতদার ও সফল এই রাজনীতিবিদের সাথে একবার দেখা ও কুশল বিনিময় হয়েছিল। সে বছর কয়েক আগের কথা। তখন তিনি হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। সস্ত্রীক গিয়েছিলাম পার্লামেন্ট ভবনে। হেগ শহরে আমার বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়। পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরে মিডিয়া সেন্টারের ডাইরেক্টরের সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল। রিসেপশনে আগমনের হেতু জানালে সেখানে বসা ডাচ তরুণীটি ফোনে খবর দিলেন। বেরিয়ে এলেন সেন্টারের তরুণ পরিচালক। বাঁয়ে রেস্তোরাঁ। আমাদের সেখানে বসিয়ে কফির অর্ডার দিয়ে, ‘কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি’ বলে বিদায় হন। তখন সকাল এগার। দু–একটি টেবিল ঘিরে বসে আছেন কয়েক সাংসদ। ‘বারে’ এক তরুণ। কফি খাচ্ছি, এমন সময় সুমনা বলে, ‘দেখ ওখানে প্রাইম মিনিস্টার মার্ক রুতে একা দাঁড়িয়ে, কফি খাচ্ছেন। চলো, একটু আলাপ করে আসি।’ যেচে পরিচয় ও আলাপ করার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সুমনার ইচ্ছেরই জয় হলো। কফি শেষ করে তার দিকে এগিয়ে যাই। হাত বাড়িয়ে নিজেদের পরিচয় দেই। বাংলাদেশ, তার সাইকেল চালিয়ে পার্লামেন্টে আসা এবং এই নিয়ে ডাচ টেলিভিশন ও পত্র–পত্রিকায় প্রশংসিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে সুমনা বলে, আমিও প্রতিদিন প্রায় ৩০ মিনিট সাইকেল চালিয়ে অফিস–বাসা করি। কদাচিৎ গাড়ি নিয়ে যাই। টুকটাক আলাপ হলো। ছবি তোলা যাবে কিনা জানতে চাইলে সুমনাকে বলেন, অবশ্যই। তিনিই বলে দিলেন কোনদিকে দাঁড়ালে ছবি ভালো হবে। কেননা বারে ছিল অনুজ্জ্বল আলো। বারের কাউন্টারে বসা তরুণটিকে ডাকলেন। স্বল্পক্ষণের আলাপ। আমাদের মুগ্ধ করলেন। কত সাধারণ ! ভাবতে অবাক লাগে – দেশের প্রধানমন্ত্রী রেস্তোরাঁয় একা দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছেন। সাথে কেউ নেই। নেই কোন সহকারী, নেই নিরাপত্তা রক্ষী বা চামচিকের দল। নেই কোন কৃত্রিম গাম্ভীর্য। ততক্ষণে সেন্টারের পরিচালক ফিরে এসেছেন। ভালোলাগার বোধ নিয়ে ফিরে যাই আমাদের টেবিলে। যাই হোক –
এই নিরহংকার ও সফল রাজনীতিবিদ সমপ্রতি হল্যান্ডের হেগ শহরে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন যাতে সফল ও ফলপ্রসূ হয় তার জন্যে টানা কয়েক মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। দৌড়েছেন ন্যাটোর সদস্য দেশগুলিতে। সফল–সম্মেলন বলতে তো কেবল ‘সুন্দরভাবে মিটিং’ এর আয়োজন বুঝায় না। আয়োজন ছিল বিশাল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা ৩২টি দেশের সরকার প্রধানরা আসবেন, রাত কাটাবেন। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপার আছে, এয়ারপোর্টে প্লেন উঠা–নামার ব্যাপার আছে, এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল, অনুষ্ঠানস্থল, ডিনার, লাঞ্চ, কয়েক হাজার সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকের জন্যে মিডিয়া–সেল, সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিতকরণের তাবৎ ব্যবস্থা, সভাস্থলে আসার সময় যাতে কোনভাবেই কোন বিঘ্ন না ঘটে– এতো সব কিছুর সুষ্ঠু আয়োজন– সে এক বিশাল যজ্ঞ। হল্যান্ড ছোট্ট একটি দেশ। কিন্তু অত্যন্ত সফলভাবে এই বিশাল সম্মেলন সম্পন্ন করেছে সে জন্য সকল মহল থেকে প্রশংসিত হচ্ছে। এর উপর রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তার আগমনে সে যে–দেশে ঘটুক না কেন, নিতে হয় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আছে তার নিজস্ব নিরাপত্তা আয়োজন, নিজের লোক। এই সব কিছুর বাইরে ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুতের বড় মাথা ব্যাথার কারণ ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাকে খুশি রাখা। তার মতিগতির কোন ঠিক–ঠিকানা নেই। ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন, ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলির বাৎসরিক সামরিক ব্যয় বর্তমান ২% থেকে ৫% ভাগে উন্নীত করতে হবে। এই ইস্যুতে ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলি যেন সম্মত হয় তাই মার্ক রুতে লেগে ছিলেন জোঁকের মত। তার আশংকা ছিল যদি তারা এই ব্যাপারে সম্মত না হন তাহলে ট্রাম্প বেঁকে বসতে পারেন, এমন কী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে বের করে আনতে পারেন। সেই হুমকি ট্রাম্প দিয়েছিলেন আগে এবং অনেকবার। সবার দৃষ্টি মার্ক রুতের দিকে। সফল হবেন কি তিনি ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে এক মঞ্চে এনে এই ইস্যুতে একমত করাতে? সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন যখন ঘোষণা দেয়া হলো, আগামী ১০ বছরে অর্থাৎ ২০৩৫ সালের মধ্যে ন্যাটো সদস্য–রাষ্ট্রগুলি তাদের জিডিপি–র ৫% ভাগ সামরিক খাতে ব্যয় করবে। সফল হলেন মার্ক রুতে।
সাফল্যের হাসি হাসলেন মার্ক রুতে। তিনি যখন এই বিরাট সাফল্যের আনন্দে ভাসছিলেন, চারিদিকে প্রশংসিত হচ্ছিলেন তখনই ঘটলো সমস্যা। ট্রাম্প রুতে – দুজন মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদের। ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ, যুদ্ধ–বিরতির সময়েও একে–অন্যকে আক্রমণ প্রসঙ্গে বিরক্তি প্রকাশ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘এই দুটি দেশ এত দীর্ঘ এবং এত তীব্র লড়াই করছে যে তারা জানে না তারা কী করছে।’ সাংবাদিকরা যুদ্ধ বিরতি সম্পর্কে ট্রাম্প এবং ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুতেকে জিজ্ঞাসা করলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘তাদের মধ্যে একটি বড় লড়াই হয়েছে, যেন স্কুলের উঠোনে দুই বাচ্চার তুমুল লড়াই, যা আপনি থামাতে পারবেন না।’ তাদের (বাচ্চাদের) দুই তিন মিনিট লড়াই করতে দিন, দেখবেন তাহলে তাদের থামানো সহজ হবে। তখন মার্ক রুতে হেসে বলেন, ‘ড্যাডিকে এসে কড়া কথা বলে শান্ত করতে হয় বিবাদরত বাচ্চাদের।’ আর যায় কই! এর ব্যাখ্যা করলেন অনেকে এইভাবে– ইসরায়েল ও ইরান বাচ্চাদের মত কলহে রত এবং ট্রাম্প ‘ড্যাডি’র মত এসে তাদের থামিয়ে দিলেন।’ শুরু হলো তুমুল সমালোচনা।
কেমন কাটলো ‘আনপ্রেডিক্টবল’ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডাচ রাজ প্রাসাদের ‘একটি রাত’ – অনেকের মনে কৌতূহল। আমার ধারণা কোন রাজপ্রাসাদে এই তার প্রথম নিশি যাপন। তিনি ছিলেন একা। সাথে স্ত্রী ছিলনা। অবশ্য স্ত্রীর সাথে যে খুব একটা মধুর সম্পর্ক এখনো বিদ্যমান তা মনে হয় না। তবে ভালো কেটেছে নিঃসন্দেহে। কথাটা এই জন্যে বলছি, পরদিন সকালে তাকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা যায়। রাজা রানীর সাথে ব্রেকফাস্ট শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এক প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প তখন বলেন, ‘খুব ভালো কাটলো, রাজা রানী দুজনেই চমৎকার ব্যক্তি।’ এদিকে ট্রাম্পের জন্যে এই বাড়তি আপ্যায়ন এবং রাজবাড়িতে থাকার বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সমালোচনা উঠে এসেছে। কেউ কেউ বলেন, এটি বাড়াবাড়ি। এর কোন প্রয়োজন ছিল না। এটি তো তার এক রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। তাকে কেন এই বিশেষ সম্মান দেখানো হলো এর মধ্যে দিয়ে কি বাকিদের খাটো করে দেখা হলো না। কেননা ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে তার মত আরো ৩১ সরকার প্রধান এসেছিলেন। হতে পারেন তিনি অতি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রধান। কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য সহ আরো ৩১ জন সরকার প্রধান এলেও দৃষ্টিকটুভাবে একটু বেশি মনোযোগ যেন দেয়া হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টের দিকে। তিনি কী মুডে থাকবেন, তাকে কীভাবে সন্তুষ্ট রাখা যায় সেদিকে মনে হয় ডাচ সরকার ও ন্যাটো মহাসচিবের মনোযোগ ছিল বেশি। সে যাই হোক না কেন– ন্যাটো শীর্ষ বৈঠক যে সফল হয়েছে সেটিই হলো বড় কথা। সব সদস্য রাষ্ট্র, মাইনাস স্পেন, রাজি হয়েছে তাদের সামরিক ব্যয় ২০৩৫ সালের মধ্যে বার্ষিক জিডিপির ৫% ভাগে উন্নীত করতে। বড় কথা ট্রাম্পের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তিনি খোশ–মেজাজে ফিরে গেছেন নিজ দেশে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন– এতে কি ইউরোপ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হবে? এখানে বহিঃশত্রু বলতে যে রাশিয়াকে বোঝানো হচ্ছে তা বলা বাহুল্য। ট্রাম্প ন্যাটোর পাশে থাকবেন– তার এই আশ্বাসে ইউরোপ কি সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারে? কারণ ট্রাম্প ক্ষণে–ক্ষণে তার মত বদলান। এই ঐক্যের মধ্যে কি শান্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত সম্ভব? রাশিয়া গোটা ব্যাপারটিকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে? সবশেষে বলতে হয়, ‘সাস্টেইনাবল পিচ’ বা দীর্ঘস্থায়ী শান্তি বলতে যা বুঝায় তার জন্যে আলোচনা, দেন–দরবার, সমঝোতার কোন বিকল্প নাই। মারণাস্ত্র–যুদ্ধে লাভবান কে? লাভবান হবে সেই সমস্ত রাষ্ট্র যারা এই মারণাস্ত্র উৎপাদন করে, ব্যবসা করে। একজন সাধারণ নাগরিক সে কথা বুঝেন, কেবল বুঝেন না, কিংবা স্বার্থের কারণে বুঝতে চান না তারা যাদের ‘বুঝাটা’ ছিল খুব জরুরি। তাহলে যুদ্ধ–যুদ্ধ খেলার নিরীহ শিকার ও দর্শক একটু স্বস্তি পেতো, বিশ্ব পেতো শান্তির সুবাতাস।
(৯–৭–২৫)
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট