হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৪ জুন, ২০২৫ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

শপথ গ্রহণের মাত্র ১১ মাসের মাথায় চলতি সপ্তাহের ৩ জুন ভেস্তে গেল হল্যান্ডের চার দলীয় কোয়ালিশন সরকার। বছর দেড়েক আগে অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে বরাবরের মত কোন রাজনৈতিক দল একক ভাবে সরকার গঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন অর্জনে ব্যর্থ হলে, শুরু হয় কোয়ালিশন সরকার গঠনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সাত মাস ম্যারাথন দেনদরবার শেষে চার দলীয় রাজনৈতিক দলকে নিয়ে গঠন করা হয় এক ‘নড়বড়ে’ কোয়ালিশন সরকার। বিজয়ী দলগুলির মধ্যে চরম ডান এবং কট্টর ইসলাম ও অভিবাসনবিরোধী নেতা খিয়ের্ট বিল্ডার্স ও তার দল, পার্টি ফর ফ্রিডম বা পেই ফেই ফেই ১৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৩৭টি পেয়ে এগিয়ে থাকলে স্বাভাবিকভাবে কোয়ালিশনসরকারকে নেতৃত্ব দেবার কথা পার্টি ফর ফ্রিডমের এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা দলের নেতা খিয়ের্ট বিল্ডার্সের। কিন্তু কোয়ালিশন সরকারের অংশ নিতে সম্মত হলেও কোন রাজনৈতিক দল খিয়ের্ট বিল্ডার্সকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে রাজি নয়। তাদের যুক্তি, খিয়ের্ট বিল্ডার্স ও তার দল ডাচআদর্শ ধারণ করেনা। নির্বাচনী প্রচারণাভিযানে খিয়ের্ট বিল্ডার্স বলেছিলেন, তিনি ও তার দল নির্বাচিত হয়ে যদি সরকার গঠন করে তবে হল্যান্ডে অবৈধ অভিবাসী আসার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়া হবে, বেআইনিভাবে যারা এদেশে আছে এবং যে সমস্ত বিদেশি বেআইনি কাজে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে, হল্যান্ডে কোরান নিষিদ্ধ সহ মুসলিম দেশগুলির জন্যে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হবে এবং ‘এসাইলাম’ পাবার প্রত্যাশীদের (শরণার্থী) সমস্ত সুযোগসুবিধা বন্ধ করে দেয়া হবে। তার এই এন্টিইমিগ্রেন্ট ও এন্টিইসলাম বক্তব্য ডাচ ভোটারদের বিশাল একটি অংশকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলেও তিনি হল্যান্ডের কনভেনশনাল রাজনৈতিক দলগুলির তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে বিল্ডার্স ইসলামবিরোধী অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসেন। তবে অভিবাসী বা ইমিগ্রেন্টবিরোধী ইস্যুতে অনড় থাকেন। এরপর যে তিনটি দলের সাথে তিনি কোয়ালিশন সরকার গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেন তারা এই বলে ঘোষণা দেন যে, তারা খিয়ের্ট বিল্ডার্সের দলের সাথে কোয়ালিশনে যেতে রাজি, তবে বিল্ডার্স যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান তবে তারা এই কোয়ালিশনে নেই। ফলে বিল্ডার্স বাধ্য হন রাজনীতির বাইরে থেকে তার এক অনুগতকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হাজির করতে। কিন্তু সরকারের বাইরে থেকে বিল্ডার্স দলের নীতিনির্ধারণীর ‘নাটাই’ নিজ হাতে রাখেন এবং সাইডলাইনে থেকে সরকারকে নানা সময়, নানা ইস্যুতে চাপের মধ্যে রাখেন।

সরকার গঠনের পর নতুন সরকারকে তিনি কয়েকটি নির্দেশনা দেন। তার মধ্যে প্রধান ও অন্যতম ছিল শরণার্থী (এসাইলাম) ইস্যুতে কঠোরতম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে এই সরকার থেকে তিনি তার দলের সমর্থন উঠিয়ে নেবেন। নড়বড়ে কোয়ালিশন সরকার যে, যেকোন সময়ে পতন হতে পারে সে আশংকা শুরু থেকেই যারা সরকারের মধ্যে ছিলেন তারা যেমন করেছিলেন, ঠিক তেমনি সরকারের বাইরে যারা ছিলেন, এমন কী আমাদের মতো আমজনতাও। খিয়ের্ট বিল্ডার্স তার দলের মধ্যে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। দলের সমস্ত নীতিনির্ধারণীর ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সবশেষে, বিল্ডার্স গত সোমবার এক তড়িৎ ডাকা সংবাদ সম্মেলনে কোয়ালিশন সরকারের উপর এই বলে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, ইমিগ্রেশেন, নাগরিকত্ব ও এসাইলামের ক্ষেত্রে সরকার ‘দমনমূলক পদক্ষেপ’ গ্রহণের ব্যাপারে কার্যত কোন উদ্যোগ নেয়নি। তিনি বলেন, ‘এসাইলাম প্রার্থীদের জন্যে সীমান্ত বন্ধ করা, যারা অবৈধভাবে এদেশে ঢুকেছে তাদের বহিষ্কার এবং শরণার্থীআশ্রয়কেন্দ্র বন্ধের জন্যে আমি একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিলাম। আমি কোয়ালিশন সরকারে যারা আছেন তাদের এই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করার দাবি করেছিলাম। কিন্তু তারা তা করেননি। ফলে এই সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না।’ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি কঠোরতম এসাইলাম পলিসির পক্ষে স্বাক্ষর করেছি, হল্যান্ডের পতনের জন্যে নয়।’

খিয়ের্ট বিল্ডার্স কোয়ালিশন সরকার থেকে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেন। ফলে যা হবার ছিল তাই হলো। কোয়ালিশন সরকার এক বছর পেরোনের আগেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফ প্রথানুযারী ডাচ রাজা বিলেম (উইলিয়াম) আলেক্সজান্ডারের সাথে সাক্ষাৎ করে তার পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। আগামী নির্বাচন হবে চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ। হল্যান্ডে যখন কোন সরকারের পতন ঘটে তখন মন্ত্রীরা সাধারণত পরবর্তী নির্বাচন তক তত্ত্বাবধায়ক পদে বহাল থাকেন। কিন্তু খিয়ের্ট বিল্ডার্স বলেন, তার দলীয় মন্ত্রীরা অবিলম্বে তাদের পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। কেউ কেউ বলেন, এটি বিল্ডার্সের স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। ফলে ডাচ রাজনীতি আবারো নতুন করে অনিশ্চয়তার দিকে মোড় নিলো। এই রাজনৈতিক বিপর্যয় এমন সময় হলো যখন হল্যান্ড চলতি মাসে (জুন) ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করতে চলেছে এবং এটি অনুষ্ঠিত হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

এখন দেখা যাক, কোয়ালিশন সরকারের ভেতর থাকা দলগুলি কীভাবে দেখছে সরকারের এই নাটকীয় পতনকে এবং এই পতনের পেছনে যে একক ব্যক্তি রয়েছেন সেই খিয়ের্ট বিল্ডার্সের ভূমিকাকে। তারা স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ এবং বিল্ডার্সের সমালোচনায় মুখর। সরকারের অন্যতম শরিক কৃষক ও কৃষিভিত্তিক দলের (বিবিবি) নেতা ক্যারোলিন ভ্যান দের প্লাস খিয়ের্ট বিল্ডার্সের এই পদক্ষেপকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেন, তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এই নেত্রী বলেন, ‘তার (বিল্ডার্স) হাতে ‘ট্রাম্প কার্ড’ রয়েছে। তারপরও তিনি এই কর্মটি করলেন।’ আর এক কোয়ালিশন দল, এনসিসি প্রধান, নিকোলিন ফান ভ্রুনহোফেন বলেন, ‘সিদ্ধান্তটি অবোধগম্য।’ অন্যদিকে কোয়ালিশন সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল, ফেই ফেই দের তুর্কী বংশোদ্ভূত নেত্রী, দিলান ইয়েসিলগজ বলেন, ‘আমাদের মধ্যে (দলগুলি) কোন মত পার্থক্য নেই এবং তিনি ভীষণ রাগান্বিত। আমাদের একটি ডানপন্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু বিল্ডার্স তার ‘ইগোর’ জন্যে সবকিছু নষ্ট করে দিলেন। তিনি নিজে যা চান তাই করে চলেছেন। বিল্ডার্স দায়িত্ব নিতে চাননি এবং তিনি তার ভোটারদের পরিত্যাগ করেছেন।’

এখন দেখা যাক বিরোধী দলগুলি কীভাবে দেখছে সরকার পতনের এই ঘটনাকে। বিরোধী দলীয় নেতারা মন্ত্রিসভা ভেঙে যাওয়া ও সরকার পতনের সংবাদকে স্বাগত জানিয়েছেন। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাক্ট পার্টির (সিডিএ) নেতা হেনরি বনতেবাল ‘কোয়ালিশন জোটকে’ বেপরোয়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বর্ণনা করে বলেন, ‘গত এক বছর ধরে আমাদের রাজনৈতিক অপেশাদারিত্বের অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং হল্যান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। কোয়ালিশন সরকারের অংশীদারি দলগুলি পেই ফেই ফেই, বিবিবি, এনএসসি ও ফেই ফেই দেই দেশের চাইতে নিজস্ব বিষয় নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিল।’ এদিকে বিরোধী দল ডি৬৬এর নেতা রব জেটেন বলেন, বিগত ১৮ মাস অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও সংকটের দ্বারা চিহ্নিত। দেশের বড়ইস্যুতে তারা খুব কম অগ্রগতি সাধন করেছেন, পাশাপাশি নিজেদেরকে খিয়ের্ট বিল্ডার্সের হাতে জিম্মি হবার সুযোগ করে দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো খিয়ের্ট বিল্ডার্স মনোনীত প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফ বিল্ডার্সের এই সিদ্ধান্তকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অপ্রয়োজনীয়’ বলে মন্তব্য করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য বেশ মজার। কেউ কেউ বলেন, বিল্ডার্স যা করেছেন খুব ভালোভাবে জেনে শুনেই করেছেন। করেছেন অনেক হিসেবনিকেষ করে। বিগত পার্লামেন্টনির্বাচনে তার দল শীর্ষ স্থান অধিকার করলেও তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। সে ক্ষোভ বা আফসোস তো রয়েই গেছে। কেন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি সে ব্যাখ্যা এই লেখার শুরুতে দিয়েছি। বিল্ডার্স খুব ভালো করেই জানেন যে, তার এন্টিইসলাম ও এন্টিইমিগ্রেন্ট ইস্যুতে সাধারণ ডাচ জনগোষ্ঠী তার পক্ষে রয়েছেন। আর তাই আসন্ন নির্বাচনে তিনি আরো ভালো ফলাফল ছিনিয়ে আনবেন বলে আশা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর আসনখানি হাতছাড়া হবে না তার ধারণা। তার এই অনুমান সত্য বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা খিয়ের্ট বিল্ডার্স বলেন, তিনি আগামী নির্বাচনে তার দল পেই পেই ফেএর নেতৃত্ব দেবেন এবং আগামীদিনের প্রধানমন্ত্রী হবেন। একই ধারণা পোষণ করেন হল্যান্ডের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী। তবে সেটি যে নির্বাচনের পরপর হবে তেমন সম্ভাবনা কম। পরবর্তী সরকার গঠন করতে লেগে যাবে বেশ কয়েক মাস। তাতে দেশের জরুরি বিষয় নিয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে না। ফলে ব্যহত হবে দেশের উন্নয়ন। তবে তাতে বিল্ডার্স খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হয় না। লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাচ পলিটিক্সের সহকারী অধ্যাপক সিমন ওটচেস মনে করেন, বিল্ডার্সের দল অবশ্যই হিসাব করে দেখেছে যে পরবর্তী নির্বাচনকে জনগণ দেখবেনা “ইমিগ্রেশন পলিসির” উপর রেফারেন্ডাম হিসাবে, কারণ তারা জানেন যে তারা এতে জিতবেন।’ ফুল বিক্রেতা, রন ভান দেন হোগেন বান্দ আশা করেন বিল্ডার্স বিজয়ী হয়ে সংসদ নিয়ন্ত্রণে নেবেন, যাতে তিনি ট্রাম্প ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির মত যেখানে চরম ডানপন্থীরা ক্ষমতা দখল করছেন, কাজ করতে পারবেন।’ উল্লেখ করা যেতে পারে, বছরের পর বছর ধরে ডাচ রাজনীতিতে মাইগ্রেশন একটি ‘ডিসাইসিভ’ (বিভাজনমূলক) ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমান ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুটের নেতৃত্বে পূর্ববর্তী কোয়ালিশন সরকারও ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে তার পতন ঘটে। পরিশেষে, পরবর্তী নির্বাচন হবার আরো মাস পাঁচেক বাকি। এই প্রায় অর্ধবছর সময়ে রাজনৈতিক গুটি যে কোন দিকে যায় তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। আর সেটি নিশ্চিত হবার জন্যে আমাদের আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানসম্মত শিক্ষার জন্য দরকার দক্ষ শিক্ষক
পরবর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে নদীতে লাকড়ি সংগ্রহ করতে গিয়ে শিশু নিখোঁজ