হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বডুয়া | শনিবার , ২৪ মে, ২০২৫ at ৭:০১ পূর্বাহ্ণ

এক নাগাড়ে প্রায় তিন মাস দেশে থেকে ফিরে এলাম সপ্তাহ দেড়েক আগে। গত ৩৪ বছর হল্যান্ড অবস্থানকালে এই প্রথম একসফরে এতগুলি দিন দেশে কাটালাম। একটা সময় ক্লান্তি ধরে গিয়েছিল। ছিল প্রচন্ড গরম। ছিল রাস্তাঘাটে অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন চলাচল। শারীরিক কারণে কিছুটা উদ্বেগও ছিল। যদি অসুখবিসুখে পেয়ে বসে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। সে জাতীয় কিছু হয়নি। গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে। পাশাপাশি কিছু কাজের কাজও ছিল। ঢাকায় ছিল সম্মেলন (প্রিকনসালটেশন) গোছের অফিসিয়াল প্রোগ্রাম, মাইগ্রেশন ইস্যু নিয়ে। অন্যদিকে চাটগাঁয় ছিল সাংবাদিক বন্ধু ও সহকর্মী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর স্মরণে আলোচনা অনুষ্ঠান। এর বাইরে ছিল রমজানঈদের একটানা প্রায় ১০ দিনের মত ছুটি। সরকারি বেসরকারি সব কাজ বন্ধ। উপায়হীন এখানেওখানে ঘুরেবেড়িয়ে দিন কাটানো ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ভাগ্যিস এই সময় বছরের বেশ কয়েকটি উৎসব, তাৎপর্যপূর্ণ দিন ছিল। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ এবং চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বরের বলী খেলা। এই প্রথম আমার জব্বরের বলী খেলাকে ঘিরে যে বিশাল মেলা সেখানে যাওয়া। শুনে কেউ কেউ তো বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমি এর আগে কখনো এই মেলায় যাইনি। অথচ আমার জন্ম, বেড়েউঠা, স্কুলকলেজবিশ্ববিদ্যালয় এবং সাংবাদিকতা পেশার শুরুর কয়েক বছর কেটেছে চট্টগ্রামে। আসলে ছোটকাল থেকে যেখানে খুব ভিড়, সেটি খেলা হোক আর মেলা, এড়িয়ে চলতাম। আর সে কারণে দেশে (বিদেশেও) স্টেডিয়ামের গ্যালারি বা প্যাভিলিয়নে বসে ফুটবল খেলা দেখা হয়নি আমার কখনো। কেবল একবার আশির দশকের শুরুতে পাকিস্তান ক্রিকেট টিম চাটগাঁ খেলতে এলে আমাকে যেতে হয়েছিল স্টেডিয়ামে। স্পোর্টস রিপোর্টার না হলেও সেই খেলার রিপোর্টিং করার জন্য আমাকেই পাঠানো হয়েছিল অফিস থেকে। তখন আমি ডেইলি লাইফের যাকে বলে ‘সবেধন নীলমনি’, একমাত্র রিপোর্টার। জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সব বিষয়ে আমার কভার করতে হতো। এর কিছুদিন পর অবশ্য মঈনুদ্দিন নাসের (বর্তমানে নিউ ইয়র্কে স্থায়ী বসবাস) স্পোর্টস রিপোর্টার হিসাবে ডেইলি লাইফে যোগ দেয়। আমার সাংবাদিকতা জীবনে সেই প্রথম ও শেষ স্পোর্টস রিপোর্টিং। ছাপার অক্ষরে বের হওয়া সেই রিপোর্ট এতো বাজে হয়েছিল যে (সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম ববির বিচার্যে) আমার চাকরি যাবার দশা। যাই হোক, চাকরি যাবার প্রশ্ন উঠেনি। কেননা স্পোর্টস, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ওয়াজ নট মাই কাপ অফ টি’ অর্থাৎ আমার পছন্দের বা এখতিয়ারে নয়। দেশে গিয়ে এবার দেখলাম জব্বরের বলী খেলাকে ঘিরে যে মেলা তার বিশালত্ব। গোটা লালদীঘির আশপাশ এলাকা থেকে শুরু করে কোতোয়ালি থানা, আন্দরকিল্লা, সিনেমা প্যালেস এলাকা জুড়ে বসেছিল মেলা। বলী খেলা শুরু হবার দুদিন আগ থেকেই মেলা বসতে শুরু করে। বৈশাখকে ঘিরে এই ঐতিহ্যবাহী জব্বরের বলী খেলা যার শুরু আজ থেকে ১১৬ বছর আগে ১৯০৯ সালে, তা গ্রেফ বলী বা কুস্তি প্রতিযোগিতা নয়। এটি দেশের জনসংস্কৃতির বহ্নিশিখা। চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বর সওদাগর ১৯০৯ সালের ২৫ এপ্রিল (১২ বৈশাখ ১৩১৬ বঙ্গাব্দ) লালদিঘির মাঠে এই প্রতিযোগিতা শুরু করেন। কালের পরিক্রমায় এই বলী খেলা ‘জব্বরের বলী খেলা’ নামেই পরিচিতি লাভ করে ও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তবে এটি কেবল খেলা ছিল না। এর পেছনে ছিল বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের চেতনা। কুস্তি খেলার আড়ালে লুকিয়ে ছিল আত্মপ্রতিরোধের আহবান। প্রতি বছর বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই মেলা ও বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে এই পর্যন্ত দুবার অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। প্রথমবার, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং সামপ্রতিক অতিমারীর (কোভিড) সময়। হাতে অখন্ড অবসর। একবার নয়, তিন তিনবার গিয়েছিলাম মেলা দেখতে ও ঘুরতে। মেলা শুরুর একদিন আগে সন্ধ্যায় স্নেহভাজন ইয়ার চৌধুরীকে সাথে নিয়ে। এরপর গেছি শ্যালিকা টুম্পা ও তার মেয়েকে নিয়ে। শেষের দিন ভাগ্নে কুণালকে নিয়ে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নানা ধরনের দেশীয় সামগ্রী নিয়ে এসেছে ব্যবসায়ীরা। দেশের এমন খুব অঞ্চল নেই যেখান থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা নিয়ে মেলায় বসেনি। ফুটপাত থেকে শুরু করে গোটা রাস্তা জুড়ে বসেছে অস্থায়ী দোকান। কাঁচ, মেলামাইন, প্লাষ্টিক, মাটি, কাগজের তৈরি হরেক রকমের গৃহ সামগ্রী, খেলনা, তালপাতার বাঁশি, ঢোল, শীতল পাটি, শাড়ি, চাদর, সোফা কুশন, বালিশ, হাঁড়িবাসন কী নেই এই মেলায়। যা চাইবেন তাই পাবেন। পাবেন বৈশাখ উপলক্ষে বানানো নাড়ু, মুড়িমুড়কি, গুড়, বাদাম ইত্যাদি। এক কথায় সব সব পাওয়া যায় এই মেলায়। প্লাস্টিকের বানানো ফুল, মাটির তৈরি নানা সাইজের ফুলের টব, ডেকোরেশন পীস, তার গায়ে চমৎকার চোখধাঁধানো কারুকাজ, হাতপাখাইচ্ছে করে সব কিনে নেই। সব তো আর কেনা হয় না, তবে খেলনা সহ বেশ কিছু গেহস্থলি সামগ্রী কেনা হয়েছে। তার কিছু সাথে এসেছে সাত সমুদ্র পেরিয়ে হল্যান্ডে।

মেলায় সব ছাড়িয়ে যা আমাকে অবাক করেছে তা হলো উপচে পড়া মানুষের ভীড়, আক্ষরিক অর্থে এ ছিল জনসমুদ্র। রাত বাড়ার সাথে ভিড় যেন বেড়েই চলেছে। আরো যেটি অবাক করেছে তা হলো, সকল বয়েসী নারীপুরুষ, ছেলেমেয়ে, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধবৃদ্ধা এসেছে মেলায়। সেদিন জোৎস্না ছিল কিনা জানিনে। কিন্তু মানুষের ভীড় দেখে মনে হলো যেন ‘আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’। সবাই যেন বাড়ি ছেড়ে মেলায় এসেছে। সবার কিছু না কিছু কেনা চাই। পসরা খুলে বসা দোকানির সামনে দরাদরি করে চলে ক্রেতারা। তাতে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি মনে হলো। হাঁটছি, মনের মধ্যে একটা ভয় নিয়ে। যদি হঠাৎ দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়, তাহলে তো এই সাধের প্রাণটা নির্ঘাৎ উড়াল দেবে। ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। আন্দরকিল্লা থেকে শুরু করে বেশ কিছুদূর এগুলে হাতের ডানে সিনেমা প্যালেসের দিকটা, কে সি দে রোড। এখন বোধকরি সেখানে সিনেমা প্যালেস হলটি আর নেই। স্কুলকলেজ বয়সে এই হলে কত ফিল্ম যে দেখেছি তার হিসাব নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে, ঠেলাঠেলি করে যখন হাতটা টিকেট কাউন্টারের ছোট্ট ফাঁকটিতে ঢুকাতে পেরেছি তখন মনে হতো যেন স্বর্গ পেলাম। মেলায় মানুষের ভিড়ে চোখে পড়লো না হ্যাপি লজ। তবে শুনেছি সেটি এখনও আছে। হয়তো আগের সেই জৌলুস নেই। বিশ্ববিদ্যালয়পড়াকালীন অনেক দুপুরে বসেছি এই মাঝারি গোছের রেস্টুরেন্টে। সেখানে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিয়েছি লাঞ্চ খেতে খেতে। তার কাছাকাছি পাহাড় ঘেঁষা ফাঁকা স্থানটিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী বাসগুলি দাঁড়াতো। আমরা সকালে বাসা থেকে রিকশায় এসে বাস ধরতাম। বিশ্ববিদ্যালয় ট্রেন চালু হবার পর শিক্ষার্থীদের জন্যে সেই বাসসার্ভিস উঠে গেছে। হেঁটে এগিয়ে যাই খুরশিদ মহল সিনেমা হলের দিকে। সেটিও নেই। সেটি ভেঙে এখন হয়েছে মহল মার্কেট। একটু হেঁটে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে যেতে হাতের বাঁয়ে যে রঙ্গম সিনেমা হল ছিল সেটিও নেই। নেইএর তালিকায় আরো রয়েছে স্টেশন রোডের উজালা। এই হলেই আমার প্রথম সিনেমা দেখা। কিন্তু সেদেখা ছিল অসমাপ্ত। ছবির নাম খুব সম্ভবত ‘রূপবান’। ছবি চলছে, গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছি, অর্ধেকের মাথায় হঠাৎ হলের মধ্যে হইচই, দৌড়াদৌড়ি। আগুন, আগুন বলে দর্শকরা যে যেদিকে পারে দৌড়াতে শুরু করলো। আমিও সিট টপকে দিলাম দৌড়, হল থেকে বের হয়ে বাইরে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে হলের দিকে তাকাই। আগুন লেগেছে তার জন্যে কোন চিন্তাভাবনা নেই। যে ভাবনাটি তখনও মাথার মধ্যে ছিল তা হলো, ছবিটি শেষ করতে পারলাম না। মন খারাপ হয়ে রইলো বাকি দিনটা এবং আরো অনেক দিন। স্কুলকলেজবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন খুব ছবি দেখতাম। বোধকরি চাটগাঁর কোন সিনেমা হল নেই যেখানে গিয়ে ছবি দেখিনি। ইংরেজি, উর্দু থেকে শুরু করে ভালো, রদ্দিমার্কা বাংলা ছায়াছবি সব দেখতাম। প্রতিটি হলে ছবি শুরু হবার মিনিট পনের আগে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন দেখানো হতো। কখনো সামনে প্রদর্শিত হবে তেমন কোন ছবির ট্রেলার দেখাতো। সেগুলিও মন দিয়ে দেখা চাই। মোদ্দাকথা, বড় পর্দায় যা যা দেখাতো তার সব দেখা চাই। ফলে কোন ছবির সম্পাদনায় কে, পরিচালক কিংবা ক্যামেরাম্যান কে, সাউন্ড এডিটর কে, সংগীত পরিচালক সবার নাম ছিল একেবারে ঠোঁটস্থ। পাঠকদের কারো কারো এই কথা শুনে হাসি পেতে পারে। তবে এই যে নামগুলি ঠোঁটস্থ ছিল তার একটা সুফল আমার জীবনে এসেছিল। অনেক পরে যখন চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি তখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এফডিসিতে পাবলিক রিলেশনস অফিসার পদে মনোনীত হয়েছিলাম। সেখানে লিখিত পরীক্ষায় অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে এসেছিল অমুক ছায়াছবির সম্পাদনায় কে ছিলেন, তমুক ছায়াছবির ক্যামেরায় কে ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন। তবে তাতে আর যোগ দেইনি। যোগ দিয়েছিলাম একই সময়ে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে চাকরিতে। আসলে কোন শিক্ষাই বৃথা যায় না। কখন যে কোথায় কাজে লাগে! যে কথা বলছিলাম। চাটগাঁর প্রায় সব সিনেমা হল অনেক আগেই উঠে গেছে। নিউ মার্কেটের সামনে যে বড় সাইজের জলসা হল ছিল সেটি নেই। তার পাশে দোতলায় ছিল চমৎকার এক রেস্তোরাঁ, নাম চিমবুক। কত বসেছি এই রেস্টুরেন্টিতে, কত কাটলেট আর আলুর চপ খেয়েছি। সময়ের কালে সেটি উধাও। উধাও সদর ঘাটের দিকে লায়ন, অন্যদিকে আলমাস ও দিনার। শেষের দুটো ছিল আমাদের সময়কার অভিজাত সিনেমা হল। দিনারে ভালো ভালো ইংরেজি ছবি দেখেছি। যদি আমার স্মৃতি বিট্রে না করে সে সময় ছোট্ট কিন্তু সুন্দর এই হলটিতে কেবল ইংরেজি ছায়াছবি দেখানো হতো। তার পাশ দিয়ে অনেকবার যাওয়াআসা করেছি। এখন আর ছবি প্রদর্শিত হয় না সেখানে। দূর থেকে দেখে মনে হয় পরিত্যক্ত কোন ভবন। দেখে খারাপ লাগে। পড়ে আছে বড্ড অযত্নে, অবহেলায়। ইউরোপে যা কিছু পুরানো তা ধরে রাখার যাবতীয় চেষ্টা করা হয়। পুরানো স্মৃতি, পুরানো ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার যে প্রয়োজন, তাগিদ তা আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। সেটি বড় দুর্ভাগ্যজনক।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমক্কা ও মদিনায় দোয়া কবুলের বিশেষ স্থানসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধসড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কমাতে হবে