হল্যান্ড থেকে

জাস্টিন ট্রুডো -তার উত্থান ও পতন এবং কানাডার ভবিষ্যৎ

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৯ মার্চ, ২০২৫ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

একটা সময় ছিল যখন বলা হতো– ‘আগে গুণবিচারী, পরে দর্শনধারী। অর্থাৎ মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্যের চাইতে ভেতরের গুণাবলীই হলো আসল। তবে বাস্তবে এর সত্যতা কতটুকু মেলে সে আমাদের কারো অজানা নয়। এখন মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই বড় করে দেখা হয়, হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। ফলে এখন হলো আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী। রানী এলিজাবেথও বলেছিলেন, ‘একটি সুন্দর মুখ হলো মানুষের সেরা প্রশংসাপত্র। তবে রানী এলিজাবেথ বলেছেন বলেই যে সেটি গোসপেল ট্রুথবা চরম সত্যতা ভাবার কোন কারণ নেই। তারপরও বোধকরি এই কারণে সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়া কানাডার প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে আমার ভালো লাগতো। আমার মত অনেকেরই ভালো লাগতো। তবে তিনি কেবল তরুণ ও সুদর্শন নন, অনেক গুণের অধিকারীও। সুবক্তা, সাউন্ড রাজনৈতিক পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড সব মিলিয়ে পাঁচজনের মধ্যে তিনি কেবল একজনই নন, তিনি হয়ে উঠেন অন্যতম। অন্যের দৃষ্টি কাড়বেই। সেই বিচার্যে তিনি ছিলেন দর্শনধারীর পাশাপাশি গুণবিচারীও। কিন্তু শেষতক কোন কিছুই তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পারলো না। কানাডার চার চার বারের প্রধানমন্ত্রী পিয়েরি ট্রুডোর সন্তান, জাস্টিন ট্রুডো নয় বছরের কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর কিছুদিন আগে সরে যেতে বাধ্য হন। এমনকী নিজ দল, লিবারেল পার্টি থেকেও তিনি পদত্যাগ করেন। খ্যাতির শীর্ষে উঠে একটা সময় তার লিবারেল দল সংকটে পড়ে এবং কানাডা এক রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়। অথচ রাজনীতিতে প্রবেশের শুরুতে তিনি একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক আইকনহিসাবে সবার কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। প্রথম দিকে জাস্টিন ট্রুডোর উচ্চ পদে আসার যাত্রাটিকে রাজনৈতিক রূপকথারগল্পের মত মনে হতো, যার মধ্যে ক্যারিশমা, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং অনবদ্য সময় ছিল। তিনি ছিলেন টেলিজেনিকও তারুণ্যে ভরা এক টগবগে রাজনীতিবিদ। তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০০৭ সালে, কিন্তু তার আগেই টেলিভিশনঅনুষ্ঠান পরিচালনা করা ছাড়াও নানা কর্মকান্ডের জন্যে কানাডার জনগণের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। তার বড় প্লাস পয়েন্ট ছিল তিনি পিয়েরি ট্রুডোর সন্তান। তবে তার বয়স যখন মাত্র সাত, তখন তার মাবাবার ছাড়াছাড়ি হয়। তার মা, মার্গারেট ছিলেন লিবারেল এম পি জেমস সিনক্লেয়ারের কন্যা। মার্গারেট তার স্বামী পিয়েরি ট্রুডো থেকে ২৯ বছরের ছোট ছিলেন। গুজব আছে যে, রক ষ্টার ও অন্যান্য সেলেব্রিটির সাথে মার্গারেটের রোমান্স ছিল। ফলে জাস্টিন ট্রুডো এবং তার দুই ছোট ভাই বড় হয়েছিলেন তার বাবার আদরযত্নে, যিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে কানাডাকে দীর্ঘ পনের বছর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

২০০০ সালে বাবার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে জাস্টিন ট্রুডো একটি বাগ্মী, মর্মস্পর্শী বক্তব্য রাখেন যা তাকে জাতীয় স্পটলাইটে নিয়ে আসে। তখন তার বয়স ২৮। কানাডার মধ্যপন্থী লিবারেল পার্টিকে দীর্ঘদিন ধরে দেশের শাসক দল হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ২০১১ সালে দুর্বল নেতৃত্ব এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনের কারণে দলটি এক শোচনীয় নির্বাচনী পরাজয়ে়র সম্মুখীন হয়। দুই বছর পর জাস্টিন ট্রুডো দলের নেতৃত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তিনি প্রথম ব্যালটেই ইংরেজিতে যাকে বলে ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টরিঅর্থাৎ ভূমিধস বিজয় লাভ করেন এবং বিপর্যস্ত দলটিকে নতুন করে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। সফলতাও আসে। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলকে তৃতীয় স্থান থেকে একেবারে সরকার গঠনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি। সক্ষম হন একটি নির্ণায়ক (ডিসাইসিভ) লিবারেল মেজরিটি সরকার গঠনে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জাস্টিন ট্রুডো তার এজেন্ডা তৈরী করেন। এর মধ্যে ছিল জেন্ডারব্যালান্সড মন্ত্রীসভা, সাহসী পরিবেশ উন্নয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম। দুহাত বাড়িয়ে কানাডায় শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর মধ্যে দিয়ে তিনি অচিরেই একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। কানাডার সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের ছাড়িয়ে যাবার জন্যে তিনি তার দলকে বামদিকে পরিচালিত করতে থাকেন। জাস্টিন ট্রুডো সেই সময় ক্ষমতায় থাকা উদারপন্থী মধ্যপন্থীদের মধ্যে একজন তারকা ছিলেন এবং দ্রুত একজন প্রগতিশীল আইকন হিসাবে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার উচ্চাভিলাষী নীতিগত এজেন্ডা তার সত্যিকারের জয় এনে দেয়। তিনি নাটকীয়ভাবে শিশু দারিদ্র্য হ্রাস করতে সক্ষম হন এবং একটি জাতীয় সাশ্রয়ী মূল্যের শিশুযত্ন কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা করেন। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় তিনি প্রশংসা অর্জন করেন, সে সময় কানাডিয়ানদের উদার আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছিলেন, হাজার হাজার মৃত্যু রোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিওবা ভ্যাকসিন বাধ্যবাধকতা ও লক ডাউন দেয়ার কারণে জনগণের মাঝে বিভাজন দেখা দেয়।

তবে তার সফল কাহিনীর পাশাপাশি ব্যর্থতাও রয়েছে। তিনি প্রতুশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কানাডার পুরানো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তিনি সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন। বিশ্ব রাজনীতিতে জাস্টিন ট্রুডো একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিচিতি লাভ করলেও দেশে নানা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। তার অযৌক্তিকবিলাসবহুল ভ্রমণগুলি তার নতুন সরকারের উজ্জলতাকে ম্লান করে দিয়েছিল। ফলে ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে এবং ২০১৯ ও ২০২১ সালের ফেডারেল নির্বাচনে তার দল তেমন ভালো ফল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়নি। যা হবার তাই হয়েছে। তার দল এক পর্যায়ে অস্থির সংখ্যালঘু সরকারে পরিণত হয়। মহামারীপরবর্তী সময়ে কানাডা মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হলে জাস্টিন ট্রুডোর সমর্থন কমতে কমতে প্রায় তলানিতে এসে পৌঁছায়। আকাশছোঁয়া আবাসন খরচ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করার চেষ্টা করলেও ট্রুডো সরকার খুব একটা সফলতা অর্জন করতে পারেনি। সংকট বেড়েই চলেছিল। অন্যদিকে তিনি যে দুবাহু বাড়িয়ে অভিবাসনকে আহবান জানিয়েছিলেন দেখা গেলো তার ফলে দেশে আবাসন সমস্যা দেখা দেয়। অভিবাসনের বিরুদ্ধে কানাডিয়ানরা সোচ্চার হতে থাকে। ২০২৩ সালে ধীরলয়ে কমতে থাকা তার জনপ্রিয়তা বছরের শেষ দিকে এসে চুড়ান্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। ডিসেম্বর নাগাদ তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র তার ডান হাত হিসাবে পরিচিত উপপ্রধান মন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড নাটকীয়ভাবে পদত্যাগ করলে জাস্টিন ট্রুডো পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। তিন মেয়াদে নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি ত্যাগ করেন রাজনৈতিক মঞ্চ, যে মঞ্চ তাকে নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এবং দেশের বাইরে দাঁড় করিয়েছিল প্রথম সারির বিশ্ব রাজনৈতিক নেতাদের মঞ্চে। তার পদত্যাগের বিষয়টির ঘোষণা দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এই দেশ সত্যিকারের সঠিক নেতৃত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখে এবং আমার কাছে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে লড়তে হয় তাহলে আমি সেই নির্বাচনে সেরা বিকল্প হতে পারবো না।একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের মত তার বক্তব্য। সত্যকে গ্রহণ করার মত সাহস ও ইচ্ছে ছিল বলেই তিনি কানাডার মত একটি বিশাল ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশকে পরিচালনা করতে পেরেছেন।

জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের সাথে সাথে সমাপ্তি ঘটলো কানাডার একটি রাজনৈতিক যুগের। ১৯৭১ সালের ক্রিস্টমাস রাতে (২৫ ডিসেম্বর) জন্ম নেয়া জাস্টিন ট্রুডো যেকানাডাকে রেখে গেলেন, সেই কানাডার আগামী দিনগুলি আরো অনেক অনিশ্চয়তায় ভরা এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছোটোবেলায় ঈদ আসতো জবাকুসুমের ঘ্রাণে
পরবর্তী নিবন্ধসেনাবাহিনীর গৌরব-সৌরভ অপরাজিত থাকুক