যখন দেশ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ ছিল, যখন ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া, দক্ষিণ ও ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশে গেছি তখন হাতে সময় ছিল না। সম্মেলন, সেমিনার আর মিটিংয়ের কারণে সে সময় সে সমস্ত দেশে যাওয়া। ফলে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল, চেক–ইন, কয়েক দিনের লাগাতার মিটিং, হয়তো এরই ফাঁকে একদিন বিশেষ কোনো দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ানো দল বেঁধে, ব্যাস। দেশ দেখা শেষ। এ অনেকটা কাক–স্নানের মত, ‘জলে ডুব দেব, চুল ভেজাবোনা’র মতো। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায় যিনি বা যারা সঙ্গী হন, তারা বা তাদের ঘুরে দেখার সময় থাকলেও ধৈর্য থাকে না। আবার দেশ থেকে আসা কাউকে কাউকে দেখেছি শীতের কারণে গাড়িতে বসেই ঘুরে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। মজার ব্যাপার বটে! এ যে কেবল দেশ থেকে যারা ইউরোপ–আমেরিকা–কানাডায় ঘুরতে আসেন তারা করেন তা নয়। এমনটি হয় আমাদের অনেকের, আমরা যারা প্রবাসে স্থায়ী ঘাঁটি গেড়েছি তাদের কারো কারো। তবে এমনটি হয় না আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের। আমাদের সন্তান–সন্ততি, যাদের জন্ম ও বেড়ে উঠা এদেশে তারা কিন্তু এর ঠিক উল্টো। ওরা যখন ‘ভেকেশনে’ যায়, নতুন কোনো দেশে, সে পশ্চিমে হোক, কিংবা পূর্বে বা উত্তর–দক্ষিণে, তারা যাবার আগে আগ বাড়িয়ে প্ল্যান করে কী কী দেখবে, কোন দেশ থেকে কীভাবে পার্শবর্তী দেশ দেখবে, কোথায় থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের সাথে এই জেনারেশনের পার্থক্য হলো– আমরা আরামবিলাসী, ভোগবিলাসী, ভ্রমণবিলাসী নই। যা সহজলভ্য তাতেই আমাদের আকর্ষণ। চ্যালেঞ্জ নিতে বা গ্রহণ করতে চাইনে, তাতে এক ধরনের আনন্দমিশ্রিত উত্তেজনা আছে জানা সত্বেও। এই যে আমি এত কথা বলছি, তার মানে এই নয় যে আমি এর বাইরে। আমিও ওই যে বললাম, বিলাসীদের দলে। এই প্রসঙ্গে এক অভিজ্ঞতার কথা পাঠকের সাথে ভাগাভাগি না করলেই নয়। তখন আত্মজ অতীশ স্কুলে পড়ছে। ঠিক হলো আমরা দুজন স্কুল–ছুটিতে যাবো বার্সিলোনা। দক্ষিণ ইউরোপের সব চাইতে বড় দেশ স্পেনের এই নগরীতে ফি–বছর লক্ষ লক্ষ ট্যুরিস্ট ভিড় জমায়। বার্সিলোনা বেছে নেবার আর একটি কারণ অতীশ ফুটবল পছন্দ করে, ফুটবল ক্লাবে নিয়মিত খেলে। এফ সি বার্সিলোনা তো বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব। মায়ের উৎসাহেই অতীশের ফুটবল মাঠে যাওয়া। মনের দিক থেকে সায় ছিল না আমার। সেটি তার মাকে জানালেও অতীশকে কখনো জানাইনি। মাঝে মধ্যে মাঠে যেতাম তাকে উৎসাহ দিতে। ভয় ছিল ফুটবলে নেশা হয়ে গেলে না–জানি পড়াশুনা ব্যাহত হয় কিনা। না তেমনটি হয়নি। পড়ার চাপে এক সময় সে নিজেই ফুটবল বাদ দেয়।
যাই হোক, সব ঠিকঠাক। অতীশ প্রচণ্ড আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে অন–লাইনে আমাদের দুজনের প্লেনের টিকেট কাটলো। হোটেল পছন্দ করে নিজেই বুকিং দিলো। চমৎকার ছিল সে হোটেল। যাবার আগে তাকে বলি, এয়ারপোর্ট থেকে আমরা টেক্সি নিয়ে হোটেল যাবো, তারপর চেক–ইন করে বেরুবো। সে বেঁকে বসলো। বলে, ‘না, টেক্সি নয়, আমরা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাবো। বার্সিলোনা ঘুরে দেখবো বাস, মেট্রো বা ট্রামে চড়ে, কোন টেক্সি নয়।’ কোনো দেশে প্রয়োজনে কিংবা বেড়াতে গেলে যেটি সাধারণত আমি করি তা হলো, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে টেক্সি স্ট্যান্ডের দিকে যাওয়া। কে অত খোঁজাখুঁজি করে ট্রাম বাসের জন্যে? অতীশকে বলি, ‘ঝামেলা করে লাভ নেই, টেঙি নিয়ে নেব।’ সে কিছুতেই রাজি নয়। বলে, ‘তোমার কিছু করতে হবে না। আমিই সব করবো।’ তখনও তার স্কুল–বয়স পেরোয়নি। তার উপর এই তার প্রথম স্পেন যাওয়া। তার উপর সম্পূর্ণ ভরসা করি কী করে! যাবার আগের দিন রাতে গুগুল সার্চ করে সে একটি ছোট্ট কাগজে টুকে নিলো এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল যাবার পথে কোন কোন বাস ধরতে হবে ইত্যাদি। আমাকে দেখিয়ে বলে, কোন বাস ধরে কোথায় গিয়ে নেমে, আবার বাস বদল করে এগিয়ে যেতে হবে। তারপর সেখানে পৌঁছে গোলচত্বর পার হয়ে বা–দিকের রাস্তা ধরে কিছুদূর হাঁটলেই হোটেল। আমাকে সব বর্ণনা দিলে বললে হ্যাঁ–সূচক মাথা নাড়ি, মনে মনে এই ভেবে আগে এয়ারপোর্ট পৌঁছি তো। তখন সামার। ইউরোপে সামার মানে মচ্ছব। ‘আজ সবাই গেছে বনে’–র মত গোটা ইউরোপ যেন বার্সিলোনায় ভিড় জমিয়েছে। বার্সিলোনা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে অতীশ তার এক হাতে ধরা ছোট্ট নোট–কাগজটি দেখে। এদিক–ওদিক তাকিয়ে বলে, চলো সামনে বাস স্ট্যান্ড, ওদিকে যাই। তাকে আবারো আমার দলে ভেড়াতে ব্যর্থ চেষ্টা করে বলি, ‘বাদ দাও, আমরা টেক্সি নিয়ে নেই।’ এবার মনে মনে সে একটু বিরক্তই হয়। খুব কনফিডেন্টলি বলে, ‘চুপ করতো, আমার সাথে আসো’। এগিয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। সেখানে কয়েকটি বাস দাঁড়িয়ে, বিভিন্ন রুটের। সেদিন ছিল চমৎকার আবহাওয়া, রৌদ্রস্নাত দিন, প্রচণ্ড বাতাস। সেখানে গিয়ে সে ওই কাগজের টুকরোটি যেই না দেখার জন্যে পকেট থেকে বের করলো, অমনি বাতাসের তোড়ে সেটি কোথায় উড়ে গেল। এদিক–ওদিক খুঁজেও তার হদিস মিললো না। মনে মনে বলি, যাক এবার তো টেক্সি নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাকে সে কথা বললে তার উত্তর, ‘আমার মাথায় রুটটা গেঁথে আছে‘। তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে এগিয়ে যেদিকে আমাদের বাস যাবার কথা সেদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে কিছু জিজ্ঞেস না করে উঠে পড়লো। আমার মনে তখনও দ্বিধা কাটেনি। তাকে বলি, ‘ঠিক বাসে চড়লাম তো? একটু জিজ্ঞেস করে নাও ড্রাইভারকে।’ সে আবারো বিরক্ত হয়, বলে, ‘না’। আমি তার আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক ও মুগ্ধ হই। তারপরও আমার মনের ভয় কাটে না। তাকে বলি, ‘কোন স্টপেজে বাস বদল করতে হবে সেটি অন্তত জিজ্ঞেস কর।’ তার একই উত্তর, না। আমি এদিক–ওদিক তাকাই। গল্পের শেষ এখানেই নয়। কিছুদূর যাবার পর সে আমাকে বলে, আমাদের এখানে নামতে হবে। আবারো বাস বদল। আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলে, কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না কিন্তু। আমি স্কুলগামী এই ছেলের উপর শতভাগ ভর করে এসেছি এই নতুন দেশে। আমাদের বাস এগিয়ে চলে। মিনিট দশ/পনের চলার পর একটি স্টপেজে তার কথামত নেমে পড়লাম। দেখি বিশাল চৌ–মাথা চত্বর। কোনদিকে যাব? সে মোবাইলে ম্যাপ দেখে। আমি নীরব দর্শক। তাকে কোনো সাহায্য করতে পারি না। মোবাইল অনুসরণ করে নতুন এলাকায় ঠিকানা খুঁজে বের করার মত জ্ঞান, তার চাইতে বড় কথা ধৈর্য্য আমার নেই। ধৈর্য্য তো এমনিতে কোনোকালেই ছিল না। কথাটা আমার দুই সন্তান ছাড়াও তাদের মা–জননীও সুযোগ পেলে শোনাতে ভুলে না। যাই হোক, চত্বরে এসে অতীশ এদিক–ওদিকে দেখছে দেখে তাকে বলি, এবার কাউকে জিজ্ঞাসা করো। তার সেই একই উত্তর, না। তারপর বলে, রাস্তা পার হয়ে বা–দিকের রাস্তা ধরি আমরা। আট–দশ মিনিট হাঁটার পর সে বলে উঠে, ‘ঐ দেখো, আমাদের হোটেলের সাইনবোর্ড।’ তার মুখে বিজয়ের হাসি, তাকে জড়িয়ে ধরি পরম মমতায়। তারপর যে ক’দিন বার্সিলোনা ছিলাম, যত দর্শনীয় স্থানে গেছি, সব সে খুঁজে খুঁজে বের করেছে। মেট্রো থেকে শুরু করে বাস, ট্রাম সব। টিকেট কাটা, রেস্টুরেন্ট পছন্দ করা সব। অতীশের সাথে দেশ বেড়ানো আর আমার একার দেশ বেড়ানোর মধ্যে অনেক ফারাক। ওর দেশ দেখা বা ঘোরার মাঝে নতুন দেশ আবিষ্কার করার মাঝে যে আনন্দ, উত্তেজনা, সে আনন্দ সে উত্তেজনা আমার দেশ–দেখার মাঝে নেই। সেই সকালে হোটেলে ব্রেকফাস্ট শেষে দুপুরে বাইরে লাঞ্চ সেরে হোটেল ফিরতাম। তারপর আবার সন্ধ্যেয় বের হওয়া এবং বাইরে রেস্তোরাঁয় ডিনার শেষে হেঁটে হোটেল ফেরা। এরপর অতীশ যখন আমাদের সাথে গেছে, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন থেকে শুরু করে অন্যান্য স্থানে সব জায়গায় সে এবং তার বোন সপ্তর্ষি দুজন মিলে সব ঠিকঠাক করেছে। আমরা বাবা–মা তাদের পছন্দের উপর সম্পূর্ণভাবে নিজেদের সঁপে দেই।
এবার ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি–সফরে অতীশ সাথে ছিল না। এখন সে বড় হয়েছে। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া। তবে সাথে আর একজন ছিল, ভাগ্নি জামাই জুয়েল। কিন্তু ছিল না আমাদের সময়। সুইডেন থেকে হেলসিংকি এসে আড়াই দিনের অবস্থানে যেটুকু সম্ভব তার আয়োজন করলো সে। তাতে হেলসিংকির অনেকটা দেখা সম্ভব হয়েছিল। সে গল্প গেল সংখ্যায় লিখেছিলাম কিছুটা। হেলসিংকি থেকে যখন সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ফিরে আসি তখন আঁধার নেমেছে। অথচ তখন সবে বিকেল পাঁচটা পেরিয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময় এমনই থাকে সুইডেনের আবহাওয়া। মনের সাথে যে দিনের আবহাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে সেটি সুইডেন এসে নতুন করে টের পাই। কেমন যেন মরমরা ভাব।
জানা যায়, প্রকৃতির এই খেয়ালের কাছে হার মেনে এদেশে অনেকে আত্মহত্যা করে। বলা হয় ডিপ্রেশনে ভুগে চিরবিদায়ের পথ বেছে নেয়। ফিনল্যান্ড যাবার সময় জুয়েল তার গাড়ি এয়ারপোর্ট পার্কিং প্লেসে পার্ক করে গিয়েছিল। প্লেন থেকে নেমে কোন চেক ছাড়াই বেরিয়ে আসি। যাত্রী একেবারে হাতেগোনা। বছরের এই সময় (নভেম্বর) ঘুরে–বেড়ানোর জন্যে উত্তর ইউরোপ কোনো ‘আইডিয়াল’ টার্গেট নয়। এয়ারপোর্ট থেকে জুয়েলের বাসা আধ ঘণ্টা দূরত্বের। হাইওয়ে অনেকটা ফাঁকা। ফিরে এসে কণিকা, সুমনা লেগে গেল রান্নাবান্নায়, ভাপা পিঠা বানানোয়। পরদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আমাদের আমস্টারডাম ফেরার ফ্লাইট। সকালবেলা ঘণ্টা কয়েকের জন্যে ফ্রি। তখনও স্টকহোমের ‘নোবেল মিউজিয়াম’ দেখা হয়নি। ভাবলাম, দু–দুবার স্টকহোম এসে নোবেল মিউজিয়াম না–দেখে ফিরে যাব? আবার এদিকে এয়ারপোর্ট যেতে হবে হাতে সময় নিয়ে। সে জন্যে একটু দ্বিধাও ছিল। আমার দ্বিধা দেখে জুয়েল বলে, আধ ঘণ্টার তো ড্রাইভ, চলেন ঘুরে আসি। দুজন বের হয়ে পড়লাম। ছোটখাট মিউজিয়াম, কিন্তু কত মূল্যবান! চোখে পড়লো বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহ এই পর্যন্ত যত নোবেল বিজয়ী আছেন তাদের সবার ছবি সম্বলিত কিছু ব্যাখ্যা। আছে আরো তিন বাঙালি নোবেল বিজয়ীর ছবি– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন ও অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জি। খুব ভালো লাগলো, গর্বও।
লেখক
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট