হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৯:১৮ পূর্বাহ্ণ

ট্রেড ওয়ারবা বাণিজ্যযুদ্ধের অশনি সংকেত কি শোনা যায়? এই যুদ্ধের সূচনা যে আমেরিকার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করেছেন সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, মেক্সিকো এবং চীন থেকে আসা কোটি কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। এই ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ তখনই হয় যখন দেশগুলি শুল্ক এবং কোটাআরোপ করে একে অন্যের বাণিজ্যকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। এটি কেবল সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, এর প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। সৃষ্টি করে রাজনৈতিক উত্তেজনা, যা কোন দেশের জন্যে, বিশ্বের জন্যে কোনভাবেই কাম্য হতে পারেনা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে এমনটি করবেন সে তিনি তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অনেকবার বলেছিলেন। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এবং তার ভাষায় আমেরিকার হারানো ঐতিহ্য ও নিম্নমুখীঅর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্যে তিনি এই জিহাদএর ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর শুরু মেক্সিকোকে দিয়ে। অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে আসা মেক্সিকান অভিবাসীদের সামরিক হেলিকপ্টারে ফেরত পাঠানো উড়োজাহাজকে মেক্সিকান সরকার সেদেশে নামার অনুমতি না দিলে, এর বদলা হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানীকৃত সকল পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেন। ফলে সুর নরম হয়ে আসে মেক্সিকান সরকারের। এর আগে মেক্সিকান সরকার পাল্টা ব্যবস্থা নেবে বলে হম্বিতম্বি করেছিল। কথায় আছে-‘যত গর্জে তত বর্ষে না।’ মার্কিন সামরিক উড়োজাহাজকে নামতে দিতে বাধ্য হয়। মেক্সিকোর সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে ‘একতরফা অ্যাকশন’ আখ্যায়িত করলেও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে এক দিনে চারটি ডিপোর্টেশন ফ্লাইট গ্রহণ করতে রাজি হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের শর্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসী ও মাদক পাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে মেক্সিকো সরকার বর্ডারে দশ হাজার সেনাবাহিনী পাঠানোর আশ্বাস দিলে ট্রাম্প মেক্সিকো থেকে আসা পণ্যের ওপর যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন তা থেকে সরে আসেন এবং এই সিদ্ধান্ত এক মাসের জন্যে স্থগিত করেন। এর আগে ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপের নিন্দা জানিয়ে মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া বলেছিনা, ‘শুল্ক আরোপ করে সমস্যার সমাধান হয়না, আলোচনা ও ডায়লগের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।’

এরপর ট্রাম্প কানাডা ও চীনের আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শতকরা ২৫% শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেন। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপের হুমকির মধ্যে দিয়ে আমেরিকা তার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারদের সাথে ‘বাণিজ্য যুদ্ধকে’ অস্থিতিশীল করে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করলেন। সাথে সাথে নড়েচড়ে বসেন সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারগুলি। কানাডীয় সরকার এই বলে পাল্টা হুমকি দেন যে, কানাডা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় আমদানিকৃত আনুমানিক ২০ বিলিয়ন ডলার পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করবে। এই সমস্ত পণ্যের মধ্যে রয়েছে মধু, হুইস্কী, টমেটো, চীনা বাদামের বাটার এবং গার্মেন্টস। এই পাল্টা ঘোষণা দিয়ে কানাডীয় প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, এখানেই শেষ নয়, আরো পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে কথা হলো, ট্রাম্পের সাথে তিনি পেরে উঠবেন কী করে? ট্রাম্পের শুল্কহুমকির মুখে কানাডীয় প্রধান মন্ত্রী চলতি সপ্তাহে তার ইক্সএ বলেন, অবৈধ অনুপ্রবেশ ও মাদক পাচার বন্ধ করতে তার দেশ বাড়তি ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, মেক্সিকান মাদক পাচারকারী গোষ্ঠীগুলিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হবে এবং ‘সংঘটিত অপরাধ, ফেন্টানাইল (মাদক) এবং অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কানাডামার্কিন যৌথ স্ট্রাইক ফোর্স চালু করা হবে।’ ট্রাম্প পেয়ে গেলেন তার কাঙ্ক্ষিত টার্গেট। মেক্সিকোর মত কানাডার ওপর যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করবেন বলে তিনি হুমকি দিয়েছিলেন তা আপাতত পরবর্তী এক মাসের জন্যে স্থগিত করলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প চমক দেখাতে পছন্দ করেন এবং চাপ, ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং দেনদরবার করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সমাধান বের করে আনলেন। এরপরও কি বলা যায় তিনি একজন দক্ষ ‘নেগোশিয়েটর’ নন? কানাডা, মেক্সিকো পর রইলো চীন ও ইউরোপ। স্বাভাবিকভাবেই বসে নেই চীন। চীনা পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের জবাবে চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে তাদের দেশে আমদানীকৃত মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত কয়লার ওপর ১৫% এবং অপরিশোধিত তেল, খামারের সরঞ্জাম, কিছু যানবাহনের ক্ষেত্রেও শুল্ক আরোপ করবে বলে জানায়। কেবল তাই নয়, শুল্কের বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে চীন। এর একটি হলো মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘গুগলের’ বিরুদ্ধে তদন্ত। ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোকে যত সহজে বাগিয়ে নিয়েছিলেন চীনের ক্ষেত্রে কাজটি তত সহজ হবেনা বলে ধারণা করা হচ্ছে। জানা যায়, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যাতে এখনো একটি চুক্তি করা যায়, সে লক্ষ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সাথে আলোচনার পরিকল্পনার কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পাল্টাপাল্টি এই শুল্ক আরোপের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু হলে কোন দেশেরই জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে না বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। উল্লেখ্য, চীন থেকে আমেরিকায় অবৈধ মাদকের প্রবাহ বন্ধ না হওয়ায় চীনকে শাস্তি দিতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন অতি দক্ষ ‘নেগোশিয়েটর’ অর্থাৎ তিনি ভালো দেনদরবার করতে পারেন। প্রতিপক্ষকে চাপের মুখে রেখে দাবি আদায় করে নেবার ব্যাপারে তিনি পটু। কথাটা যে সত্যি সে আমরা তার বিগত সরকারের সময় দেখেছি। সেবার ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি এই বলে হুমকি দিয়েছিলেন যে, আমেরিকা ন্যাটোথেকে তার সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেবে যদি সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলি তাদের দেয়া আর্থিক চাঁদার পরিমান বৃদ্ধি না করে। ফলে হল্যান্ড, জার্মানি সহ পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছিল তাদের দেয়া বাৎসরিক চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে। অনেকটা একইভাবে ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে কয়েকদিনের মাথায় মেক্সিকো ও কানাডাকে সম্মত করতে সক্ষম হলেন বর্ডারে কড়াকড়ি বাড়াতে, যাতে প্রতিদিন হাজার হাজার অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারে। ট্রাম্প এটিই চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এই অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে। সেটি ছিল তার অনেক নির্বাচনী ওয়াদার অন্যতম। যদিওবা বিনিয়োগকারী, কোম্পানি এবং রাজনৈতিক নেতারা যে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরুর আশংকা করেছিলেন, আপাতত তা কম বলে ধারণা করা হচ্ছে। “তবে কম হলেও তার মানে এই নয় যে ট্রাম্পের ‘শুল্ক হুমকি’ নিয়ে ‘নাটকীয়তা’ শেষ হয়েছে”, মন্তব্য আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এপির। বার্তা সংস্থা লিখেছে, ‘কানাডা এবং মেক্সিকো আরও কিছু সময় কিনেছে। তবে ট্রাম্প সহজেই তার শুল্ক পুনরায় আরোপ করতে পারেন এবং ইতিমধ্যেই তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমদানির ওপর কর ঘোষণা করার পরিকল্পনা করছেন।’

ট্রাম্প ইতিমধ্যে ইউরোপের উপর অনুরূপ কর আরোপের হুমকি দিলে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ এককাট্টা হয়ে বলেন, যদি আমাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ আক্রান্ত হয়, তাহলে ইউরোপকে একটি সত্যিকারের শক্তি হিসেবে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা বলেন, মার্কিন সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ ইইউকে আরো ঐক্যবদ্ধ করে তুলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ বলেন, ইইউ যে কোনো মার্কিন বাণিজ্য শুল্কের আরোপের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া জানাতে জন্যে যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে ‘লক্ষ্য হওয়া উচিত সহযোগিতার মাধ্যমে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা।’ ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি প্রধান, কাজা কালাস বলেন, ‘বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হবে না’। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো মন্তব্য করেন, ‘ইউরোপ এবং আমেরিকার একে অপরের প্রয়োজন।এদিকে, পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক বাণিজ্য যুদ্ধকে সম্পূর্ণ ভুলআখ্যায়িত করে বলেন, ‘রাশিয়ার হুমকি বা চীনা সমপ্রসারণের মুখে’ মিত্রদের লড়াই বন্ধ করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, ইউরোপ, চীন, কানাডা, মেক্সিকো ও ইইউর উপর যদি শুল্ক আরোপ করা হয় তাহলে এর কী প্রভাব পড়বে আমেরিকার অর্থনীতিতে এবং মার্কিন সাধারণ জনগণের ওপর? কানাডা, চীন, মেক্সিকো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। এই প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, মার্কিন নাগরিকরা শুরুতে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবেন, তবে তা সাময়িক। দীর্ঘ মেয়াদে তারা লাভবান হবেন। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র কুশ দেশাই মনে করেন, ‘এর ফলে মার্কিন অর্থনীতির উন্নয়ন হবে। পাওয়া যাবে ঐতিহাসিক ফলাফল। চাকরি, বেতন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি হবে, কোন মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবেনা।’ তবে অর্থনীতিবিদরা এর সাথে দ্বিমত পোষন করেন। পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সের অর্থনীতিবিদ, ওয়ারউইক ম্যাককিবিন এবং মার্কাস নোল্যান্ডের বিশ্লেষণ অনুসারে, ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে চীনের ওপর ১০% অতিরিক্ত শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিকে ৫৫ বিলিয়ন ডলার সংকুচিত করবে। কেননা ধরে নেওয়া হচ্ছে পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে চীন তার নিজস্ব শুল্ক প্রয়োগ করবে। অন্যদিকে, মেক্সিকো ও কানাডার ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হলে মার্কিন মোট দেশজ উৎপাদনে ২০০ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পাবে। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে গোটা বিশ্ব অর্থনীতিতে। বিশ্ব অর্থনীতি কি তখন আরো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবে? সেটি এই মুহূর্তে আগ বাড়িয়ে বলা সম্ভব না হলেও তার যে অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। (২০২৫)

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধতমদ্দুন মজলিস ও ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাসী আয়ে রিজার্ভ স্থিতি প্রশংসনীয়