আজ দুপুর সোয়া তিনটায় চোখের ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিল। চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে সপ্তাহ কয়েক আগে এপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছিল। আজ যে ডাক্তারের কাছে সোয়া বারোটায় যেতে হবে সে কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু সে–কথা হাসপাতালের চক্ষু বিভাগ থেকে গত পরশু মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছিল। এমনটিই হয়। আপনি ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু ডাক্তার আপনাকে ভুলতে দেবেন না। হল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মজাটাই এখানে। কথাটা এই কারণে বলা– রোগ আপনার, সমস্যা আপনার, কিন্তু তাবৎ গরজ যেন ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। রোগীর দিক থেকে কখনো কোন কারণে গড়িমসি হলে, আমার ক্ষেত্রে যেমনটি প্রায়শ হয়, ডাক্তার বা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ফোন করে তাগিদ দেন, অবহেলা না করার জন্যে অনুরোধ করেন। একটা সময় ছিল যখন ডাক্তার বা হাসপাতালের সাথে খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু দিন বাড়ার সাথে সাথে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে, ডাক্তার ও হাসপাতালের মধ্যে নৈকট্য বাড়তে থাকে। এ কথা নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলা। একটা সময় ছিল যখন অসুখ–বিসুখকে সহজেই বুড়ো আঙ্গুল দেখতাম। শরীর কিছুটা বেঁকে বসলে, চিকিৎসা সেবা না নিলে আরো মন্দ কিছু হতে পারে সে ভাবনা তখন কিছুতেই ভাবাতো না। কিন্তু সময় বদলেছে। মেঘে মেঘে তো বেলা আর কম হলোনা। ইদানিং অল্পতেই মনে শংকা ধরায়। মনে হয় বুড়িয়ে গেছি, বুড়িয়ে যাচ্ছি। মনে হয় মরণের দিকে কি এগুচ্ছি তবে? সবাইকে তো এই পথ দিয়েই এগুতে হবে। ‘প্রতিটি জন্ম আলিঙ্গন করে নেবে মৃত্যুকে’– সে কথা জেনেও আমরা মেনে নিতে চাই না। সে কথা এই ‘কলামেও’ বার কয়েক লিখেছি। তারপরও মরণে ভয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের রোগও বাড়ে। শরীরের চাইতে মনের রোগ বোধ করি আরো ভয়ানক। ‘বয়স একটি রোগ’ – অনেকদিন আগে এ কথা পড়েছিলাম। কিন্তু কার লেখা, কোথায় পড়েছি সে সঠিক বলতে না পারলেও মনে হচ্ছে নন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমদের কোন লেখায় পড়েছিলাম। বয়স আসলে কোন রোগ কিনা এই নিয়ে খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়ও বিতর্ক রয়েছে। আমাদের অনেকেই কপালে ভাঁজ পড়লে, কানের কাছে চুলের রং সফেদ হলে চিন্তিত হয়ে পড়ি। অথচ এটিই জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ। প্রকৃতির এই স্বাভাবিক বিবর্তনকে আমরা অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারিনা। যা হারিয়েছি বা হারাতে চলেছি তাকে ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে আমরা প্রলেপ দেই চুলে, চামড়ায়। বয়স্ক কাউকে ‘কেমন আছেন’ জানতে চাইলে প্রায়শ তাদের বলতে শোনা যায়, ‘আর থাকা, বয়স হয়েছে, ব্যাথা–বেদনা লেগেই আছে।’ তাদের কথায় হতাশার সুর। ‘বয়স’ নিয়ে ইনগ্রিড বার্গমানের একটি চমৎকার উক্তি রয়েছে। তার উক্তি প্রসঙ্গে যাবার আগে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অভিনেত্রী ইনগ্রিডের জন্ম সুইডেন হলেও তিনি ফিল্ম ক্যারিয়ারের এক পর্যায়ে প্রথমে জার্মানি ও পরে আমেরিকায় চলে যান এবং এরপর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। মরণব্যাধি ক্যান্সারে ইনগ্রিড বার্গমান ১৯৮২ সালে মারা গেলে তার শেষ ইচ্ছানুয়ারি তাকে সুইডেনে দাহ করা হয়। তিন তিনবার অস্কার পুরস্কার অর্জন করা এই জনপ্রিয় সুইডিশ অভিনেত্রী বলেছিলেন, ‘বৃদ্ধ হওয়া পাহাড়ে উঠার মত। তাতে আপনার দম একটু বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ওপর থেকে যে দৃশ্য চোখে পড়বে তা অনেক ভালো লাগবে।’ কী চমৎকার কথা ! আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা। তখন আমি রাইসবাইগ নামক এক শহরে ‘ইউরোপীয়ান প্যাটেন্ট অফিসে’ কাজ করি। আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এক ডাচ মহিলা। ঠিক হলো জন্মদিনে আমরা সবাই মিলে তাকে সারপ্রাইজ দেব। সকাল ন’টায় অফিস শুরু। তার আসার আগেই তার কামরা সাজানো হলো। কেক আগেই অর্ডার করা ছিল। উনি রুমে প্রবেশ করতেই চমকে গেলেন। হইচই করে ডাচ ভাষায় ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ জাতীয় একটি গান সমস্বরে গাই। তারপর ক্ষণিক আড্ডা। এর মধ্যে একজন এগিয়ে এসে তাকে বলেন, ‘মাই গড, তুমি ৫০ হয়ে গেছো? কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’ উত্তরে মহিলা খুব স্বাভাবিক টোনে বললেন, ‘কোনটি ভালো? ৫০ পৌঁছার আগেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া? না, অনেকদিন বেঁচে থাকা?’ বয়স নিয়ে এইভাবে কখনো ভাবিনি। কথাটা ভালো লাগলো। এখন নিজের বয়স বেড়েছে, বাড়ছে। ভাবি কেউ যদি তেমন প্রশ্ন নিয়ে সামনে আসে, তাহলে ওই মহিলার কথাটাই আওড়াবো।
বলছিলাম সকালে হাসপাতালে চোখের ডাক্তারের সাথে এপয়ন্টমেন্টের কথা। বাসা থেকে হেঁটে গেলে হাসপাতাল পৌঁছুতে মিনিট পনেরর বেশি লাগার কথা নয়। যখন কোন কারণে সেখানে যেতে হয় তখন সাইকেল চেপেই যাওয়া হয়। কিন্তু ক’দিন ধরে হল্যান্ডে প্রচন্ড ঠান্ডা। দুপুরে দরোজা খুলে দেখি যদ্দুর চোখ যায় কুয়াশায় ঢাকা। ঠান্ডার কারণে সাইকেল বাদ। একবার ভেবেছিলাম হেঁটে যাই, কিন্তু শেষতক গাড়ির জয় হলো। যাবার পথে ফিলিং স্টেশন থেকে পেট্রল নিয়ে মিনিট পনেরর মধ্যে পৌঁছে যাই হাসপাতাল। হাসপাতালের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং প্লেসে গাড়ি রেখে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে কয়েক মিটার দূরত্বে হাসপাতাল ভবন। অটোমেটিক বড় সাইজের রিভলভিং দরোজা। ঢুকতেই রিসেপশন। সেখানে কয়েক কর্মী বসে। তাদের এক পাশে প্রায় দশটির মতো স্কেনিং মেশিন। সেখানে পাসপোর্ট বা আইডি বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের যে কোন একটি রাখতেই পর্দায় ভেসে উঠে সমস্ত তথ্য– আপনার নাম, কোন বিভাগে কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন, কটায় এপয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। সাথে সাথে আপনাকে জানিয়ে দেবে কোনদিকে, কত নম্বর কামরায় গিয়ে অপেক্ষা করবেন। আপনি যে হাসপাতালে এসেছেন, হাজিরা দিয়েছেন এই তথ্য আপনার নির্দিষ্ট ডাক্তার অটোমেটিক পেয়ে যাবেন। নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করছি। এমন সময় ডাক্তারের সহকারী তার দরোজা খুলে, নিচু গলায় নাম ধরে ডাকতেই এগিয়ে যাই। উনি আমার চোখে এক ধরনের আই–ড্রপ দিলেন। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম তার কামরায়। কামরার পেছনের দরোজা খুলে ধরে আমাকে বললেন, ‘ওই চেয়ারে বসে অপেক্ষা করুন, ডাক্তার আপনাকে ডেকে নেবেন।’ দু–মিনিটে এই কাজটি সারা হলো। কোন উচ্চশব্দ নেই। নেই চিল্লাচিল্লি, হইচই। আমাকে যে আইড্রপ দেয়া হয়েছে এবং আমি যে অপেক্ষা করছি সে তথ্য ডাক্তার ইতিমধ্যে অনলাইনে পেয়ে গেছেন তার সহকারীর কাছ থেকে। কেউ কারো কামরায় যাবার কোন প্রয়োজন নেই। কী চমৎকার ব্যবস্থা।
চেয়ারে বসে আছি। পাশের আসন খালি। পরের সীটে বসে আছেন আর এক রোগী। আমার মুখোমুখি কয়েকটি চেয়ারে বসে এক আধবয়সী মহিলা, সাথে দু’ ভদ্রলোক। পরে টের পেলাম একই পরিবারের। এমন সময় ট্রলি নিয়ে এক লোক এগিয়ে এলো। সাথে চা–কফি। জানতে চাইলো, খাবো কিনা। ‘কফি’ বলতেই প্রশ্ন, চিনি, দুধ সাথে দেবে কিনা। কফি খুব একটা খাইনে। আমার পছন্দের তালিকায় কফি, কোলা বা সফট ড্রিঙ্কস নেই। তারপরও কফি নিলাম গাটাকে একটু চাঙ্গা করার জন্যে। হল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে বিনে পয়সার এই সার্ভিস বাস্তবিক প্রশংসনীয়। কফি শেষ করার কিছুক্ষণ পর ডাক্তার তার কামরার দরজা খুলে আমায় নাম ধরে ডাকলেন। তিনিই আমার পার্মানেন্ট চোখের ডাক্তার। এদেশে প্রত্যেকের রয়েছে নির্দিষ্ট ডাক্তার। ডাক্তার দেখলেন। এর সপ্তাহ আগে যে পরীক্ষা করা হয়েছিল তার ফলাফল তার কম্পিউটারে দেখালেন, ব্যাখ্যা করলেন। কী সমস্যা, কী করণীয় সব স্পষ্ট করে সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, ‘বা–চোখে একটু সমস্যা আছে। সে জন্যে লেসার বিম দিতে হবে।’ লেসার হ্যান্ডলিং কী, কতক্ষণ লাগবে ইত্যাদির ব্যাখ্যা দিলেন। আগে করেছি না সেটিও জানতে চাইলেন। অভয় দিয়ে বললেন, এটি সামান্য ব্যাপার, মিনিট কয়েকের। তারপর বললেন, সামনে কাউন্টারে গিয়ে এপয়েন্টমেন্ট করে নেবেন। বেরিয়ে এলাম। ডাক্তারের কাছে বড়জোর মিনিট দশেক ছিলাম। গেলাম কাউন্টারে। সেখানে বসা এক ডাচ মহিলা কর্মী। নাম জানতে চাইলেন। কম্পিউটারে ইতিমধ্যে ডাক্তার তার কাছে মেসেজ পাঠিয়েছেন। সেটি দেখে বললেন, ‘হ্যা, ডাক্তারের মেসেজ এসেছে’। দিনক্ষণ ঠিক হলো। কত সহজে কাজটি হয়ে গেল। এটি কেবল আজকের ঘটনা নয়। প্রতিবারই ঠিক এভাবেই কোন সমস্যা ছাড়া, কোন রেফারেন্স ছাড়া ‘কাজ’ সারা হয়। ফিরে আসি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে। এক সময় মাটির নিচ থেকে কেঁচোর মত গাড়ি উপরে উঠে আসে। ফিরে চলি বাসার দিকে। বাইরে ঘন কুয়াশা। মনে পড়ে – ‘কুয়াশা, নিকটে থাকি, তাই হেলা মোরে-/ মেঘ ভায়া দূরে রন, থাকেন গুমরে!
কবি কুয়াশারে কয়, শুধু তাই না কি? মেঘ দেয় বৃষ্টিধারা, তুমি দাও ফাঁকি।’ (কণিকা)
(২১–১–২০২৫)
লেখক
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট