হল্যান্ড থেকে

জিমি কার্টার : দুর্বল রাষ্ট্রনায়ক থেকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

একশত বছর বয়সে গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ মৃত্যুবরণ করলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ১৯৭৬ সালে ওয়াল্টার মণ্ডেলকে তার রানিং মেইট করে শতকরা ৫০.% পপুলার ভোট ও ২৯৭ ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার নির্বাচনী লড়াইয়ে তিনি পেরে উঠেননি রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী, রোনাল্ড রিগ্যানের সাথে। কেননা ততদিনে তিনি তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন এবং মার্কিনিদের কাছে তিনি দুর্বলপ্রেসিডেন্ট হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। ইরানের শাহের ক্ষমতাচ্যুতির পর সে দেশে মার্কিন কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের জিম্মিদশা থেকে উদ্ধারে ব্যর্থ হবার পর থেকে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকা। তবে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সময়টায় তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কেন সে কথাটা বলবো একটু পর। জিমি কার্টার বড় হয়েছিলেন এমন এক পরিবারে যে পরিবারের ছিল চীনাবাদাম চাষ। একটা সময় এই পারিবারিক ব্যবসার বেশ প্রসার লাভ ঘটে। এতে তিনিও জড়িয়ে পড়েন। মার্কিন রাজনীতিতে অনেকটা অখ্যাত এই চীনাবাদামচাষি যখন প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন এবং ডেমোক্র্যাক্ট দলের কয়েকটি ‘প্রাইমারিতে’ জয়ী হন তখন পত্রপত্রিকায় হেডলাইন হয়েছিল ‘চীনাবাদাম চাষি থেকে প্রেসিডেন্ট’। ওই সংবাদ পড়ে খুব অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে এক বাদাম বিক্রেতা কিংবা বাদামচাষি কী করে আমেরিকার মত একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। সেই সময়ে আমার মনে যে প্রশ্ন ছিল তা মনে এলে এখন ভাবি কী বোকাই না ছিলাম। বাদামওয়ালা বলতে যে ছবি মুহূর্তে ভেসে উঠতো তা হলো গলায় ঝুলিয়ে কিংবা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে আমাদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে ‘বাদেম’ ‘বাদেম’ (‘বাদাম’ নয় কিন্তু) বলে লুঙ্গি পরনে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া গরিব গোছের এক বিক্রেতা। মাঝে মধ্যে তাকে ডেকে আমরা বাদাম কিনে খেতাম। তবে জিমি কার্টার সরাসরি পারিবারিক চীনাবাদাম ব্যবসা থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসেননি। তিনি এর আগে জর্জিয়ার সিনেটর ছিলেন (১৯৬৩১৯৬৭) এবং ছিলেন একই রাজ্যের গভর্নর (১৯৭১১৯৭৫)

অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান জিমি কার্টার এমন এক সময় হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছিলেন যখন বিশ্বব্যাপী নানা সমস্যা বিরাজমান। জ্বালানি সংকট ও মূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে তেলের সরবরাহ কমে যায়। দেশের অভ্যন্তরে পেট্রল পাম্পগুলিতে দেখা দেয় গাড়ির দীর্ঘ সারি। বেকারের হার উর্ধ্বগতি। আমেরিকায় দেখা দেয় মুদ্রাস্ফীতি। অন্যদিকে আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রাসন। ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের শীতল যুদ্ধ। এই সমস্ত সমস্যার সামাল দিতে তিনি অনেকটা ব্যর্থ হন। সব কিছু মিলে দেশের অভ্যন্তরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার জনপ্রিয়তায়। যদিও বা ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে ‘ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি’ সম্পাদনের মধ্যে দিয়ে জিমি কার্টার মধ্যপ্রাচ্যে উল্লেখযোগ্য ও আশাতীত কূটনৈতিক সফলতা দেখিয়েছিলেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেন বেগিন ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে এক করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়া সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের সাথে তিনি ১৯৭৯ সালের জুন মাসে পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তি সম্পাদন করে প্রশংসিত হন, যদিও বা এই চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। হলে কী হবে। তার ভাগ্যটাই মন্দ। একই সালে ইরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে জিম্মি হয়ে থাকা ৬৬ মার্কিন কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের মুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি দেশে তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনার তোপে পড়েন। জিমি কার্টার এক দুর্বল রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে চিহ্নিত হন নিজ দেশের জনগণের কাছে। ইরানি বিপ্লবীদের হাতে মার্কিনিদের এই জিম্মি হয়ে থাকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি বড় শক্তির জন্যে অপমানজনক ঘটনা। জিমি কার্টার অবশ্য জিম্মিদের উদ্ধারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ইরানের মরুভূমিতে ব্যবহৃত উদ্ধারহেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মার্কিন কমান্ডোদের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি এক সময় ঘোষণা দিয়ে মার্কিন জিম্মিদের উদ্ধারের প্রচেষ্টাকে বাতিল করেন। ফলে মার্কিন জনরোষ আরো বাড়ে এবং সেই থেকে তিনি মার্কিনিদের দৃষ্টিতে এক দুর্বলপ্রেসিডেন্ট হিসাবে চিহ্নিত হন। এই ব্যর্থতার দায় তাকে তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট শাসনামল সময় তক বয়ে নিয়ে যেতে হয়। ফলে দ্বিতীয়বার তিনি আর হোয়াইট হাউস নিজের দখলে ধরে রাখতে পারলেন না। নির্বাচনে হেরে গেলেন রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী প্রাক্তন চলচিত্র অভিনেতা, রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর থেকে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন মানবতার কল্যাণে, বিশ্ব শান্তির জন্যে। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি অনেক সময় মার্কিন সরকারের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। কোন আপোষ করেননি। কী দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ! ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর দক্ষিণ আফ্রিকীয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা প্রতিষ্ঠা করেন ‘নেলসন ম্যান্ডেলা সেন্টার ফর দি আফ্রিকান কালচার ট্রাস্ট ফান্ড’। ‘ম্যান্ডেলা সেন্টারের’ অনেক লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম, আফ্রিকীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও প্রচার, আফ্রিকীয় সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং গবেষণা, আলোচনা, সম্মেলন, গবেষণা ইত্যাদি। কেবল কি জিমি কার্টার কিংবা ম্যান্ডেলা? মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন গড়ে তুলেছেন ‘ক্লিনটন প্রেসিডেনশিয়াল সেন্টার’, তার নিজ শহর আরাকানসাসে। ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গড়েছেন ‘ওবামা ফাউন্ডেশন’। মানবতার কল্যাণে জিমি কার্টার ও তার স্ত্রী রোসালিন কার্টার ১৯৮২ সালে জর্জিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘দি কার্টার সেন্টার’। ‘জিমি কার্টার লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম’ ভবনের পাশেই এই সেন্টার তিনি গড়ে তুলেছেন, যার কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে বিশ্বের ৮০টি দেশে। সেন্টারের কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে: মানবাধিকারের উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ম্যালেরিয়া সহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে প্রচারণা ও চিকিৎসা ইত্যাদি। বিশ্ব মানব কল্যাণে এই সমস্ত ব্যক্তিদের এই ধরনের কর্মকাণ্ড যখন দেখি তখন ভাবি, কেন এমনটি হয় না আমাদের এই দুর্ভাগা বাংলাদেশে। কোন মাটিতে গড়া এ দেশের রাজনীতিবিদরা, রাষ্ট্রনায়করা। কেন আমাদের দেশের সরকার প্রধানদের, মন্ত্রীদের একটি নয়, দুটি নয়, সীমাহীন দুর্নীতি আর অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন? কেন তারা সাধারণ জনগণকে ঠকিয়ে অর্থের পাহাড় গড়েন, দেশেবিদেশে? কেন তারা এই সমস্ত রাষ্ট্রনায়কদের জীবন থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেন না? তাহলে তো তারা জনগণের দৃষ্টিতে, বিশ্বের দৃষ্টিতে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকতে পারতেনতাদের জীবদ্দশায়, মৃত্যুর পরও। যাই হোক

জিমি প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে তার ছেলে, চিপ কার্টার বলেন, “আমার বাবা কেবল আমার কাছেই একজন ‘হিরো’ ছিলেন না, তিনি ‘হিরো’ ছিলেন প্রত্যেকের দৃষ্টিতে যারা শান্তি, মানবাধিকার ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় বিশ্বাস করেন।’ জিমি কার্টার তার নিজ শহর জর্জিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও সমাজকল্যাণ কাজে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে জিমি কার্টারকে ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। এই পুরস্কার এমন সময় দেয়া হয় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকের বিরুদ্ধে ২০০২ সালে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছিলেন। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘কার্টারকে ১৯৭৮ সালের শুরুর দিকে এই পুরস্কার দেয়া উচিত ছিল, যখন তিনি মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে সফলভাবে একটি শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতা করেছিলেন।’ তার স্ত্রী রোসালিন কার্টার ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে তাদের সাদামাটা নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ১৯৬১ সালে এই বাড়িটি তৈরি করেন। সেটি ছিল তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরুর প্রথম দিককার সময়। তারা ৭৭ বছর এক সাথে সংসার করেন। স্ত্রীকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসতেন জিমি কার্টার। স্ত্রী সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি প্রায়শঃ বলতেন, ‘রোসালিন স্মিথকে বিয়ে করেই তিনি তার জীবনের শিখরে পৌঁছেছিলেন।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ইতিহাসে তারাই একমাত্র প্রেসিডেন্টদম্পতি যে এত দীর্ঘ সময় একসাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করেছিলেন। জিমি কাটার ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচাইতে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা রাষ্ট্রনায়ক।

কেমন ছিলেন জিমি কার্টার তার উত্তরসূরীদের দৃষ্টিতে? প্রয়াত প্রেসিডেন্ট তিনি যে দলেরই হোক না কেন মৃত্যুতে প্রশংসা করে শ্রদ্ধা জানানোটাই মার্কিন রেওয়াজ। ‘ভালো পৃথিবী গড়ায় জিমি কাটারের প্রচেষ্টার’ কথা উল্লেখ করে শ্রদ্ধা জানান রিপাবলিকান দলীয় ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট, জর্জ ডব্লিউ বুশ, শ্রদ্ধা জানান ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামা। অনেকের কৌতূহল ছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া জানা বা শোনার জন্যে। কেননা তিনি জিমি কার্টারকে বরাবর ‘দুর্বল প্রেসিডেন্ট’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন তার বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারণাভিযানে এবং তাকে (কার্টার) করেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে। তবে মৃত্যুর পর ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্তরিক শোক প্রকাশ করেন। এক শোকবার্তায় হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘মার্কিন জনগণের জীবন উন্নয়নে জিমি কার্টার তার ক্ষমতার সবটুকু দিয়েছেন। আর সেই জন্যে গোটা জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ।’ তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পূর্বসূরি জিমি কার্টার সম্পর্কে কী বললেন সেটি বড় কিছু নয়। বড় যেটি তা হলো জিমি কার্টারের মৃত্যুর পর মার্কিন জনগণ তাকে কীভাবে দেখছেন বা মূল্যায়ন করছেন। দেখা যায় ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় মার্কিনিরা তাকে যেভাবে দেখেছেন, মৃত্যুপরবর্তী সময়ে তাকে তার চাইতে অনেক পজিটিভলি দেখছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন আগামী ৯ জানুয়ারি ২০২৫ দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেদিন ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯ তম প্রেসিডেন্ট নোবেল বিজয়ী জিমি কার্টারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন করা হবে। মানবতার কল্যাণে জীবনের শেষ পর্যন্ত নিয়োজিত থাকা এই অনুকরণীয় রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক

সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদিব্যালোয় দীপ্ত দেবপ্রিয় : পাঠ ও অনুভবের বিহঙ্গম
পরবর্তী নিবন্ধনতুন বছরে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা