দেশ থেকে ফিরে এসে অনেকটা হুট করে ঠিক হলো উত্তর–ইউরোপের কটি দেশ বেড়িয়ে আসবো। ইচ্ছে ছিল যে–কটি ‘নর্ডিক‘ দেশ এখনো দেখা হয়নি এবার সেগুলি ঘুরে আসবো। আমার হাতে এখন অখণ্ড অবসর। হলে কী হবে গিন্নীর দশা ঠিক বিপরীত, তার কোন বিরাম নেই। ফুলটাইম জব, তার উপর পৃথক বাসায় একা–থাকা তার অশীতিপর অসুস্থ মায়ের নিয়মিত দেখভাল করা, নিজ ঘরে স্বামী ও অন্যদিকে মায়ের জন্যে নিয়মিত রান্নাবান্না করা, মাকে ডাক্তার দেখানো, সেবা করা – সব মিলিয়ে তার নাভিশ্বাস উঠার দশা। এরপরও সেই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, দিন কয়েকের জন্যে হলেও। তার যুক্তি, ‘আমার অক্সিজেন দরকার, হাঁফিয়ে উঠেছি।‘ আমারও অনেক দিনের ইচ্ছে নর্ডিক–দেশগুলি ঘুরে আসার। কিন্তু তখন সময় ছিল বৈরী। এবার ইচ্ছে ছিল না–দেখা ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক ঘুরে আসবো। সুইডেন আগে যাওয়া হয়েছে। অফিসের কাজে নরওয়ে গেছি পনের/ষোল বছর আগে। কিন্তু গিন্নীর প্রায়োরিটি সুইডেন, যদিওবা সে আমার চাইতে বেশি গেছে সে দেশে। তার পেছনে কারণ আছে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে স্থায়ীভাবে থাকে আমার বড় বোন মাধুরীর দু–মেয়ের ছোটজন, কণিকা। তার স্বামী, জুয়েল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুলোজিতে পাশ দিয়ে পনের বছর (২০০৯) আগে সুইডেন আসে উচ্চতর পড়াশোনা করার জন্যে। তারপর সেখানেই থিতু হয়ে বসেছে। ভালো কাজ করছে, স্থানীয় সরকার সংস্থায়। কণিকা এসেছে পরে। মজার ব্যাপার হলো, সম্পর্কে জুয়েল আমার আপন ছোটমামার দু সন্তানের বড় জন। কণিকা কাজ করে হেলথ সেক্টরে। ফলে তাদের ব্যস্ততা আমাদের চাইতে কোন অংশে কম নয়। তাদের দু–কন্যা– অধরা ও অনিন্দিতা। বড়টির বয়স ১২, ছোটটি ৮। এতো ব্যস্ততার পরও কণিকার ফোনের উপর ফোন– ‘মামা সুইডেন আসো, বেড়িয়ে যাও।‘ অন্যদিকে ফোন করে ওর মেয়ে অধরা বলে, ‘তোমরা কবে আসছো?’ গিন্নির ইচ্ছেরও পাল্লা ভারী। রাজি হলাম। তবে শর্ত দিলাম সুইডেনের পাশাপাশি ফিনল্যান্ড ঘুরে আসবো। ফিনল্যান্ড আমার দেখা হয়নি এখনো। বেশ ক‘বছর আগে প্রথমবার সুইডেন বেড়াতে গেলে কণিকা–জুয়েলের বাসায় ছিলাম। সে সময় জুয়েলের গাড়িতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় সে আমার জন্যে তার এক বাংলাদেশী বন্ধুর কাছ থেকে একটি আলাদা গাড়ি নিয়েছিল দিন কয়েকের জন্যে। দুই গাড়িতে সবাই মিলে বেশ ঘুরে বেড়িয়েছিলাম, স্টকহোমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। চমৎকার দেশ সুইডেন। যে পাঁচটি নর্ডিক (সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, নরওয়ে) দেশ রয়েছে তার মধ্যে সুইডেন আয়তনে সব চাইতে বড় এবং ইউরোপের মধ্যে ৫ম বৃহত্তম দেশ। হল্যান্ডের তুলনায় আকারে এগারো গুণ বড়। অথচ জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি ৬০ লক্ষ। অন্যদিকে, সুইডেনের তুলনায় এগার গুণ ছোট হল্যান্ডের জনসংখ্যা ১ কোটি ৪০ লক্ষ।
আমস্টারডাম থেকে স্টকহোম দু–ঘন্টার আকাশ–পথ। ইউরোপে আকাশ–পথে উড়াল দিতে গেলে আমার পছন্দের এয়ারলাইন্স হলো ডাচ ও ফরাসি যৌথ মালিকানায়, কে এল এম। নির্দিষ্ট সময়ের বেশ আগ বাড়িয়ে এয়ারপোর্টে যাওয়া আমার বরাবরের অভ্যেস। টেনশন নিয়ে, তাড়াহুড়ো করে প্লেন বা ট্রেন ধরা কিংবা কোন অনুষ্ঠানে যাওয়া আমার ধর্তব্যে নেই। আমার বাজে অভ্যেস বেড়াতে গেলেও সাথে থাকে ল্যাপটপ। এ কারণে ছেলে–মেয়ে, যখন ওরা একসাথে একই ছাদের নিচে ছিল তখন ও তাদের জননী আমার উপর বিরক্ত। যাই হোক, দৈনিক আজাদীর জন্যে সাপ্তাহিক কলামের লেখাটা (কালুরঘাটের ব্রিজ নিয়ে) ইতিমধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মনের মধ্যে একটা খট্কা লেগে রইলো। কারণ সেদিন ছিল ৬ নভেম্বর। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ফলাফল সেদিন বেরিয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়। মন বলে, এই নিয়ে লেখো। মন তো কত কিছুই বলে। সময়–সুযোগ কম। এই বিষয়ে লিখতে গেলে আজ রাতের মধ্যে লেখা পৌঁছাতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে সুহৃদ কবিবন্ধু সাংবাদিক রাশেদ রউফকে আগের লেখাটা না ছাপিয়ে মার্কিন–নির্বাচনের উপর লেখা পাঠাতে চাই জানালে উনি বললেন, ‘কোন সমস্যা নেই, লেখা আগামীকাল দুপুরের মধ্যে পাঠালেই চলবে।’ হাতে তখনও প্লেনে উঠার ঘন্টা খানেক বাকি। বসে আছি প্লেনের গেইটের মুখে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এবার সাথে ল্যাপটপ নেয়া হয়নি। এদিকে হাতে কোন কাগজ নেই যে লিখবো। কোটের পকেটে ছিল বাড়তি টিকেটের একটা কপি। তার উল্টো দিকটা খালি। তাতেই লেখা শুরু করলাম। লেখা দ্রুত এগিয়ে গেলো অনেকটা। প্লেনে বসে মোবাইলে আরো কিছু অংশ। ঠিক করলাম সুইডেন পৌঁছে জুয়েলের ল্যাপটপ বা ডেক্সটপে বসে লেখাটা শেষ করে আজাদীতে পাঠিয়ে দেব। জুয়েলের বাসায় পৌঁছে চা খেয়েই ওর ল্যাপটপ খুলে বসি। ঘন্টা খানেকের মধ্যে লেখাটা শেষ করে ড্রইয়িং রুমে অন্যদের সাথে আড্ডায় যোগ দেই।
ফিরে আসি শিফল এয়ারপোর্টে। আগের দিন অনলাইনে চেক–ইন করতে গিয়ে দেখি প্লেনের সামনের প্রায় সব আসন ‘বুকড‘ হয়ে গেছে। কিছু আসন খালি আছে, তবে বাড়তি টাকা ‘পে‘ করলে তা পাওয়া যাবে। এটি এয়ার লাইন্সগুলির স্রেফ ব্যবসার ধান্দা। আমার পছন্দ সামনের দিকের আসন। তাতে কমফোর্ট ফিল করি। আকাশে মন্দ আবহাওয়ার কারণে টার্বুলেন্স হলে সামনের আসনগুলোতে কিছুটা কম অনুভব করা যায়। ভয়টা কম লাগে। তবে সৃষ্টিকর্তা না করুক, যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সামনে আর পেছনের কোন আসনই বাদ যাবেনা। নির্দিষ্ট সময়েই প্লেন উড়াল দিল। বাইরে মেঘলা আবহাওয়া। ঠান্ডা তো আছেই। বছরের এই সময়টায় হল্যান্ডে এটিই স্বাভাবিক আবহাওয়া। মেঘ চিরে আরো উপরে যখন আমাদের উড়োজাহাজ পৌছুলো, তখন দেখা মেলে সূর্যের। এমন প্রখর সে তাপ কবুতরের খাঁচার মত প্লেনের ছোট্ট পুরু কাঁচের জানালা ভেদ করে যেন গায়ে লাগে। ঘণ্টা খানেক উড়াল দেবার পর ট্রলি নিয়ে এলো ‘আইলের’ দু–দিক থেকে দুই বিমানবালা। কী ড্রিঙ্কস করবো জানতে চাইলে বলি কেবল ‘ব্ল্যাক টি’, দুধ–চিনি ছাড়া। চা হাতে নিয়ে সাথে একটি বড় সাইজের স্যান্ডুইচ এগিয়ে দিলো। চমৎকার ছিল এবারের আমস্টারডাম–স্টকহোম ফ্লাইটটি। তেমন বড় কোন ঝাঁকুনি খেতে হয়নি। মাঝখানে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে একটু নড়ে–চড়ে উঠেছিল প্লেনটি। তাতেই পাশে বসা সুমনা কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল। এই ধরনের স্বল্পস্থায়ী ও মৃদু ঝাঁকুনি আমার অনেকটা গা–সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ভয় লাগতো। এখন ভাবি ভয় পেয়ে কিংবা আতংকিত হয়ে কোন লাভ নেই। তবে ভেতরে ভেতরে ভয় যে একেবারে লাগেনা তেমনও দাবি করতে পারিনে। এমন মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রার্থনা করি যেন এই ঝাঁকুনি থেমে যায়। দেশ থেকে ফিরে আসার দিন (২২ আগস্ট) চট্রগ্রাম থেকে ঢাকা–গামী ইউ এস বাংলার যে ছোট্ট প্লেনটি পড়েছিল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার খপ্পরে। ক‘দিন ধরেই দেশের আবহাওয়া ছিল ভীষণ খারাপ। ঝড়ো বৃষ্টি লেগেই ছিল। চল্লিশ মিনিটের স্বল্প দূরত্বের আকাশ–পথে এমন ভয়াবহ টার্বুলেন্সের কবলে কখনো পড়িনি। ছোট্ট প্লেনটি একবার উপরে উঠে, আবার ধপাস করে নিচে নেমে আসে, খানিক বাদে ডানে আবার বাঁয়ে। চল্লিশ মিনিটের এই যাত্রায় প্লেনটি এমন অবস্থায় ছিল পাঁচ সাত মিনিট। ভয়ংকর ব্যাপার। যাই হোক সুইডেনের উদ্দেশ্যে দু–ঘণ্টার ফ্লাইট হলেও আমাদের প্লেনটি নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট বিশেক আগে রাজধানী স্টকহোমের অরলান্ডা বিমানবন্দরে ল্যান্ড করে। তখন বিকেল সোয়া চারটা। অথচ প্লেনের ভেতর থেকে দেখি বাইরে অন্ধকার, যেন অনেক রাত। সুইডেনের ব্যাপারটিই এমন। চারটা বাজার আগেই অন্ধকার নামে। হল্যান্ডের শিফলের তুলনায় ছোট্ট এয়ারপোর্ট। আমাদের কোন বাড়তি লাগেজ নেই। দুজনের দুটো হ্যান্ড লাগেজ, সুমনার হাতে বাড়তি একটি ছোট ব্যাগ। কোন ইমিগ্রেশন চেক নেই। এয়ারপোর্টের ভেতরের শেষ গেইট পেরিয়ে হলঘরে পৌঁছুতেই দেখি কণিকা, জুয়েল, তার দু–মেয়ে দাঁড়িয়ে। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িপথে জুয়েলের বাসা প্রায় আধ ঘণ্টার দূরত্বে। জুয়েলের সাত–সীটের গাড়ি এগিয়ে চলে। চারিদিক সুনসান নীরবতা। যেন গোটা শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ তখন মাত্র বিকেল সোয়া চারটা। প্রকৃতির সাথে মনের একটা ব্যাপার–স্যাপার আছে। বাইরের আকাশ মেঘলা হলে, মনের ভেতর তার ছায়া পড়ে। আর কেবল এই বৈরী আবহাওয়ার কারণে সুইডেনে ‘ডিপ্রেশনে‘ ভোগে প্রচুর সংখ্যক লোক। সে কারণে আত্মহত্যার সংখ্যাও অনেক বেশি। প্রতি বছর সুইডেনে ১২০০ ব্যক্তি আত্মহত্যা করে বলে জানা যায়। আর এর দুই–তৃতীয়াংশ হলো পুরুষ। তবে ৮৫ বছরের উর্ধ্বে যাদের বয়স তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। ফি–বছর প্রতি এক লক্ষ এই বয়সীদের মধ্যে ৪০ জন আত্মহত্যা করে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০২২ সালে ১৫ বছরের কম বয়েসী ছেলে–মেয়েদের ১০ জন আত্মহত্যা করে। ভয়াবহ ব্যাপার। এই নিয়ে সামনের কোন সংখ্যার বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইলো। যাই হোক–অরলান্ডা এয়ারপোর্টকে পিছু ফেলে এগিয়ে চলে আমাদের গাড়ি রাজধানী স্টকহোমের দিকে। সুইডেনে যে কটি বিমানবন্দর রয়েছে তার মধ্যে এটি সব চাইতে বড় হলেও আমস্টারডাম শিফল এয়ারপোর্টের তুলনায় অনেক ছোট। রাজধানী স্টকহোম থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে সিগতুনা মিউনিসিপালিটিতে এটি অবস্থিত। অরলান্ডা বিমানবন্দর ছাড়াও সুইডেনে আরো কয়েকটি ছোটখাটো এয়ারপোর্ট রয়েছে। স্টকহোমে আর একটি ছোট এয়ারপোর্ট হলো ব্রোমা এয়ারপোর্ট। এর বাইরে আরো দুটি এয়ারপোর্ট রয়েছে তা হলো–স্কাভস্তা এয়ারপোর্ট ও স্টোকহোম ভাস্তেরাস এয়ারপোর্ট। দ্বীপের দেশ সুইডেন। সে–কথা হয়তো আমাদের অনেকের জানা নেই। ছোটবড় সব মিলিয়ে সুইডেনে দ্বীপের সংখ্যা মোট ২৬৭,৫৭০টি। বেশিরভাগ দ্বীপ বোথনিয়া উপসাগর এবং বোথনিয়ান সাগরের বাল্টিক সাগর অঞ্চলে অবস্থিত। সেটি জানা না থাকলেও আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা আছে যে, নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক হলেন এই দেশের সন্তান, আলফ্রেড নোবেল। পুরো নাম আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল। রসায়নবিদ, উদ্ভাবক, প্রকৌশলী এবং ব্যবসায়ী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ‘ডিনামাইট‘। চলবে (২৮–১১–২০২৪)
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট, সাংবাদিক