হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বডুয়া | শনিবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

ছোড ছোড ঢেউ তুলি ওভাই, লুসাই পারওর উরুতথুন নামিয়েরে যারগই কর্ণফুলী।’ আর লুসাই পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এসে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগিয়ে চলা কর্ণফুলী নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে ‘কালুরঘাট ব্রিজ’, স্কুল বয়সে বলতাম ‘কালুরঘাডর পোল’। চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে দক্ষিণে যাবার একমাত্র ভরসাস্থল ছিল এই ‘কালুরঘাট ব্রিজ’। কর্ণফুলীর ওপর নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় শতবর্ষী এই ব্রিজ যে কত ঘটনার সাক্ষী সে বোধকরি একমাত্র এই ব্রিজই বলতে পারে। গেল সপ্তাহে প্রতিদিনকার মত সকালে ঘুম থেকে উঠে কফি খেতে খেতে অনলাইনে দৈনিক আজাদী পড়ছিলাম। পড়তে গিয়ে প্রথম পাতায় ছবি সহ ‘কালুরঘাট ব্রিজ যানবাহন চলাচলের জন্যে খুলে দেয়া হয়েছে’ মর্মে সংবাদটি দেখে ও পড়ে মনটা ভরে গেলো। চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল অবহেলা ও অযত্নে পড়ে থাকা এই ব্রিজটি সংস্কারের। অনেক চড়াইউৎরাই পার হয়ে নূতন করে এই সেতুর সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০২৩ সালের ১ আগস্ট। দীর্ঘ ১৪ মাস সংস্কার কাজ শেষে ব্রিজটি যানবাহন চলাচলের জন্যে খুলে দেয়া হয় বলে জানতে পারি প্রকাশিত ওই সংবাদে। ব্রিজের ছবিটি দেখে কিছুটা নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসেছিল। ফিরে তাকাই পিছু ফেলে আসা দিনগুলিতে। মনে মনে আওরাই– ‘এই পথ দিয়ে গেছি বারবার’। জীবনানন্দ দাশের মত বলতে ইচ্ছে করে– ‘এই পথ দিয়ে কেউ চলে যেতো জানি/এই ঘাস/ নীলাকাশ/ এ সব শালিখ সোনালী ধান নরনারীদের/ ছায়াকাটাকুটি কালো রোদে/ সে তার নিজের ছায়া ফেলে উবে যেতো’। ব্রিজটি এখন সেজেছে নতুন সাজে। পত্রিকা লিখেছে– ‘দিনের আলোয় সেতু জুড়ে নান্দনিক চিত্র চোখে পড়ে। সন্ধ্যা গড়াতেই সেই রূপ আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নতুন রূপে রাতের সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে এক সময়ের ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতুটি। দীর্ঘদিনের অন্ধকারাচ্ছন্ন সেতু এলাকা এখন সোডিয়াম লাইটের আলোয় ঝলমলে।’ চমৎকার বর্ণনা। আহা যদি এখনই যেতে পারতাম, পারতাম যদি ঘুরে আসতে। অথচ এটি তো কেবল প্রাণহীন একটি সেতু। কিন্তু এই প্রাণহীনসেতু প্রতিদিন লক্ষ জনের প্রাণের স্পন্দন জুগিয়ে চলেছে, যারা এপার থেকে ওপারে যায়, ওপার থেকে আসে এপারে, প্রয়োজনে, জীবনের তাগিদে।

এক সময় নৌকা ছিল কর্ণফুলী নদী পারাপারের একমাত্র ভরসা। এখন পারাপারের তিনটি মাধ্যম। দুটি নদীর ওপর দিয়ে, আর একটি নদীর তলদেশ দিয়ে। কালুরঘাট ব্রিজ ছাড়াও রয়েছে ১৯৮৯ সালে কর্তফুলী নদীর ওপর দিয়ে নির্মিত শাহ আমানত ব্রিজ। তারও আগে ছিল একটি ভাসমান ব্রিজ। হল্যান্ড থেকে পাওয়া ওই ভাসমান ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল কর্ণফুলী নদীর ওপর। চাটগাঁ শহর থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দূরে ফিরিঙ্গিবাজার বাঁশঘাটা পয়েন্টে ছিল ব্রিজটি। সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু নাসিরুল হকের মতে, ব্রিজটি নির্মাণ করা হয় প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে। তিনি জানান, কর্ণফুলী পার হয়ে যে এপ্রোচরোড তৈরি করা হয়েছিল সেটি যোগ হয় আরাকান বা কক্সবাজার রোডের সাথে। সেটি ছিল দেশের একমাত্র ভাসমান ব্রিজ। দেখতে ছিল চমৎকার। বন্ধু হিরুর সাইকেলের সামনের ‘রডে’ বসে মাঝে মধ্যে যেতাম এই ভাসমান ব্রিজে, স্রেফ ঘুরে বেড়ানোর জন্যে। আমাদের মত অনেক কৌতূহলী নরনারী, ছেলেমেয়ে, দর্শনার্থী ভিড় করতো ব্রিজটি দেখতে। এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াতো। পরে ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ব্রিজটি ভেঙে যায়। এরপর আর মেরামত করা হয়নি। এরপর এলো আর একটি চমৎকার দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ, কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে, চান্দগাঁও উপজিলা পয়েন্টে। মোট ৯১৯,৪৮ মিটার দীর্ঘ এই ‘শাহ আমানত’ সেতুটিও নির্মাণ করে হল্যান্ড সরকার। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। দুই সরকারের পারস্পরিক সমঝোতার শর্তানুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের কথা। মূল সেতুর কাজ শেষ হয় ১৯৮৯ সালের জুনে। সদরঘাট থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উজানে এবং চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেলওয়ে ব্রিজ থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার ভাটিতে অবস্থিত এই সেতুটি। ব্রিজটি চালু হবার পর কক্সবাজার, বান্দরবান যাতায়াত অনেকটা সহজ হয়। এর পর অনেকবার গেছি এই ব্রিজ হয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে।

তখন কিন্তু কালুরঘাট ব্রিজ চালু ছিল, কিছুটা ঢিলেঢালা গতিতে, কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে। বিশেষ করে ব্রিজের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের রাস্তার অনেক স্থানে ফাঁটল দেখা গিয়েছিল। কোনোভাবে মেরামত করে গাড়ি চলতো। ওর ওপর দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে পার হতো অনেকেই। পার হতো রেলগাড়ি, প্রাইভেট কার, সিএনজি, ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেল এবং পথচারী। আমরাও বার কয়েক হেঁটে পার হয়েছি, স্রেফ মজা করার জন্য। পার হয়েছি মোটরসাইকেল চড়েও। নাসির ভাইয়ের মোটর সাইকেলে সওয়ার হয়ে একবার গিয়েছিলাম পটিয়া, গ্রামের বাড়ি। আর একবার ফটোসাংবাদিক বন্ধু ইলিয়াসের মোটরবাইকে চড়ে। তবে ট্রেনে কালুরঘাট ব্রিজ পার হবার মজাটাই ছিল ভিন্ন। অপেক্ষায় থাকতাম কখন আসবে কালুরঘাট, কাছাকাছি আসতেই নড়েচড়ে বসতাম, জানালার ধারে। নিচে বহমান কর্ণফুলী, তার ওপর ভেসে চলা নৌকা, ছোট ছোট জাহাজ। সেই কবে প্রায় একশ বছর আগে ১৯৩০ সালে বৃটিশ শাসনামলে নির্মিত ২৩৯ মিটার দীর্ঘ এই কালুরঘাট ব্রিজ। ভাসমান পোল এবং পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে শাহ আমানত ব্রিজ উদ্বোধনের আগ পর্যন্ত এটিই ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগের একমাত্র সংযোগ। এই ব্রিজের সাথে রয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস। এই সেতুর ভূমিকা যেমনটি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, তেমনি ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টে সৈন্য পারাপারের জন্য কর্তফুলীর ওপর দিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়লে ১৯৩০ সালে ব্রুনিক এন্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া এই ব্রিজ নির্মাণ করে। শুরুতে এটি ছিল জানালিহাট এবং গোমদন্ডী এই দুই রেল স্টেশনের মধ্যে ইস্পাত কাঠামোর একটি ৭০০ গজ দীর্ঘ রেল সেতু যা ১৯৩০ সালের ৪ জুন উদ্বোধন করা হয়। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টে লড়াইয়ের জন্যে মোটর গাড়ির জন্য ‘ডেক’ বসানো হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওই ডেক সরিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে সকল প্রকার যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে সেতুটিকে নুতন আকার দেয়া হয়। কালুরঘাট ব্রিজের অনতিদূরে বহদ্দারহাটে ছিল রেডিও স্টেশন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী ‘কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র’ বহদ্দারহাট নামক স্থানসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত হলেও, ইতিমধ্যে কালুরঘাটের দেশব্যাপী পরিচিতির কারণে এই বেতার কেন্দ্রটি ‘কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম ও উত্তর পাড় দখলকে কেন্দ্র করে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্মরণীয়।

স্কুলকলেজ বয়সে ছুটির সময় আমাদের কোথায়ও যাবার একমাত্র জায়গা ছিল গ্রামের বাড়ি, মামার বাড়ি, বোনের শ্বশুর বাড়ি কিংবা পিসির বাড়ি। সব দক্ষিণ চট্টগ্রামে। বিয়ে, মেলা কিংবা ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানে দল বেঁধে যেতাম গ্রামের বাড়ি। বাবার রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে আমরা প্রথম শ্রেণি বগিতে যেতাম। সে সময় দোহাজারী লাইনে গোটা ট্রেনে প্রথম শ্রেণির বগি থাকতো বড়জোড় দুটি। পটিয়া অব্দি পৌঁছুতে সাত/আটটি রেল স্টেশন পড়তো। যে বয়সে মাবাবার সাথে গ্রামের বাড়ি যেতাম তখন কোন স্টেশনে ট্রেন থামলে প্লাটফর্মে নামা ছিল নিষেধ। কলেজ বয়সে যখন বন্ধুদের সাথে গ্রামের বাড়ি যেতাম তখন প্রায় প্রতিটি স্টেশনে ট্রেন থামলে প্লাটফর্মের এই মাথা থেকে ওই মাথা হেঁটে বেড়াতাম। ইঞ্জিনের হুঁইসেল বেজে উঠতেই দৌড়ে চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়তাম। প্লাটফর্মে ঘুরে বেড়ানোর লক্ষ্য ছিল ট্রেনের জানালায় বাইরে দৃষ্টি ছড়ানো সুন্দর কোন মুখ। দেখা মিলতো কদাচিৎ। শহুরে ছেলে, বেশভূষা, হাবভাব দিয়ে নিজেকে ‘দৃশ্যমান’ করার একটা প্রবণতা কাজ করতো ভেতরে ভেতরে। এখন সে সব মনে পড়লে হাসি পায়। মনে পড়ে পটিয়া রেল স্টেশনে নেমে গেইটে পেরিয়ে ইটের রাস্তা। সেখানে অপেক্ষা করতো কটি রিক্সা। তাদের কয়েকজন পরিচিত। ‘চৌধুরী বাড়ির’ লোকজন গ্রামের বাড়ির পথ হেঁটে না গিয়ে রিক্সায় যাবে সে ছিল ওদের জানা। ওরা এটিও জানতো অন্য যাত্রীদের কাছ থেকে যে ভাড়া পাওয়া যাবে এনাদের কাছ থেকে তার কিছু বেশি পাবে। তাই তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত আমাদের নেবার জন্যে। শহরে ফেরার দিন হলে তাদের কাউকে কাউকে আগেই খবর দিয়ে রাখা হতো। ওরা আমাদের রওনা দেবার নির্দিষ্ট সময়ের ঘন্টা কয়েক আগ থেকে হাজির হতো, অপেক্ষা করতো কখন আমরা বাড়ি থেকে বের হবো। একটা সময় দোহাজারী লাইনে সড়ক পথে বাস যোগাযোগের উন্নতি হলো। ‘দোহাজারীট্রেনের’ যৌবন আর আগের মত রইলো না। আমরাও ট্রেন ছেড়ে বাস/কোচ ধরলাম। তবে প্রায় সময় বাস কিংবা কোচে বসে কালুরঘাট ব্রিজের দুদিকেই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো। ট্রেন আসবে, রেল গেইট পড়তো। খুব বিরক্তি লাগতো। চানাচুর, মুড়িওয়ালা, হকার, ভিখিরি এসে গলা ফাঁটিয়ে যাত্রীদের বিরক্তি উৎপাদন করতো। শাহ আমানত সেতু চালুর পর তো সব লেঠা চুকে গেল। রাস্তাঘাটের কাঠামো উন্নতি হলো। পকেটের অবস্থা যার একটু ভালো তারা বাস, পাবলিক কোচ ছেড়ে প্রাইভেট কার, প্রাইভেট কোচ ধরলো। তারপরও ট্রেনে চড়ে কালুরঘাট ব্রিজ পার হবার মজাটা আমার কাছে ভিন্ন। তাই যেদিন কালুরঘাট ব্রিজের সংস্কার ও উদ্বোধনের খবরটি পেলাম, আমায় নিয়ে গেলো ফেলে আসা দিনে। কত স্মৃতি, কত আনন্দঘন মুহূর্ত এই ব্রিজকে জড়িয়ে। আবার যে করে চড়বো রেলগাড়ি, কবে পার হবো এই কালুরঘাট ব্রিজের উপর দিয়ে কর্ণফুলী তারি অপেক্ষায়।

(০৫১১২০২৪)

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগামীকাল মৃত্যুবার্ষিকী মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
পরবর্তী নিবন্ধনারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রুদ্ধ হোক