ঘুরে দাঁড়ালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প : কেমন হবে আগামী চার বছর বিশ্ব রাজনীতি?
সব সম্ভাবনার দেশ আমেরিকা – কথাটা আবারো সত্যি প্রমাণিত হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয়বারের মত তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। দুর্নীতি, কর ফাঁকি, যৌন কেলেঙ্কারি, মিথ্যে বাড়তি সম্পদ দেখিয়ে ব্যাংক থেকে বাড়তি ঋণ নেয়া, নারীদের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য এমনতর অভিযোগের অন্ত ছিল না তার বিরুদ্ধে। আদালত অবমাননার কারণেও তাকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট পদে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী, কমলা হ্যারিস ঠিক তার উল্টো চরিত্র। তারপরও মার্কিন ভোটাররা ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ভোটে বেছে নিলেন ‘আনপ্রেডিক্ট্যাবল’ হিসাবে পরিচিত রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কেবল জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরে এলেন তা নয়, রিপাবলিকান পার্টি সিনেট ও হাউস অফ রিপ্রেসেন্টেটিভস – দুটোই নিয়ে নিলো নিজেদের দখলে।এবার আর রিপাবলিকান পার্টি ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ঠেকায় সাধ্যি কার!
নির্বাচনের ফলাফল যে এমনটি হবে সে অনেকটা অনুমান করেছিলাম। প্রার্থীর যোগ্যতা বিচার্যে কমলা হ্যারিস অনেকের মতে যোগ্যতর হলেও কেন জানি মন বলছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হবেন। হলেনও তিনি। হেরে গেলেন কমলা হ্যারিস। যে কটি বিষয় কমলার হারার পেছনে কাজ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে তা হলো: (১) আমেরিকার অনেকেই এখনো একজন নারীকে তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে গ্রহণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নির্বাচনের আগে এই মন্তব্য করে জানান, খোদ ডেমোক্রেটিক পার্টির অনেকেই কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসাবে পুরোপুরি মেনে নিতে পারেননি; (২) নির্বাচনী মাঠে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিগত প্রায় চার বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন। মূলত ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের দিন থেকে তিনি ধরতে গেলে মাঠেই ছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। জনগণের কাছাকাছি থেকেছেন, কারণে অকারণে। অন্যদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে চার বছর ক্ষমতায় থাকলেও প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে কমলা হ্যারিস নির্বাচনী প্রচারণার সময় পেয়েছেন মাত্র কয়েক মাস। ফলে সাধারণ জনগণ তার সম্পর্কে ভালোভাবে জানার খুব একটা সুযোগ পাননি। বরাবর তিনি থেকেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আড়ালে। (৩) আর একটি ভুল যেটি কমলা হ্যারিস করেছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন তা হলো, তিনি নিজেকে যোগ্যতর প্রার্থী হিসাবে ভোটারদের কাছে তুলে ধরার চাইতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প যে একজন অযোগ্য প্রার্থী সেটি প্রমান করায় বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বারবার এই কথাটাই তার নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছেন, ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় আসলে গণতন্ত্র শেষ হয়ে যাবে। এমন কী তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘ফ্যাসিস্টক্ম হিসাবে আখ্যায়িত করে তাকে হিটলারের সাথে তুলনা করেন, যা অনেকেই খুব একটা ভালোভাবে নেননি। তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নিজের উপস্থিতির চাইতে বেশি প্রকট হয়ে উপস্থিত ছিলেন দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সেলিব্রিটিরা। উপস্থিত ছিলেন ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন থেকে শুরু করে বারাক ওবামা, তার স্ত্রী মিশেল ওবামা, টিভি ব্যক্তিত্ব উইনফ্রি আরো অনেকেই। ফলে নির্বাচনী প্রচারণাভিযানে কমলা হ্যারিসের চাইতে উপস্থিত দর্শক–শ্রোতাদের দৃষ্টি ছিল ওনাদের দিকে, হ্যারিসের দিকে নয়। এছাড়া নির্বাচিত হলে কমলা হ্যারিস কী করবেন, কী তার পরিকল্পনা তা তিনি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে নিউ ইয়র্ক পোস্ট তার জনমত বিভাগে এই বলে মন্তব্য করে যে, হ্যারিসের বড় শত্রু হচ্ছে তিনি নিজেই। তিনি জনগণের কাছে তার ‘মেসেজ’ পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাইডেন প্রশাসন থেকে তার প্রশাসন কোন বিচার্যে ভিন্ন হবে তা তিনি ভোটারদের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এবারের নির্বাচনে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ইস্যু ছিল ‘অবৈধ ইমিগ্রেশন’। গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যের ওপর নির্ভর করে কোন বিষয় যদি বারবার সত্যি বলা হয় তাহলে এক সময় লোকে তাকে সত্যি ভাবতে শুরু করে। আর এই কৌশলকে কাজে লাগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অনুসারী ছাড়াও যারা দোদুল্যমান ভোটার ছিলেন তাদেরও নিজের পক্ষে টানতে সফল হয়েছিলেন। তিনি সাধারণ ভোটারদের মাঝে মেক্সিকো থেকে আসা অবৈধ অভিবাসিদের সম্পর্কে ভীতি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বারবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা ইমিগ্রেন্টদের ক্রিমিনাল, অপরাধী হিসাবে আখ্যায়িত করে বলতেন, এরা অবৈধভাবে প্রবেশ করে আমেরিকাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আর এদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে তার ভাষায় বাম ঘেষা ডেমোক্রেট দল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কেবল আমেরিকায় নয়, হল্যান্ডসহ গোটা ইউরোপে এন্টি–মাইগ্রেন্ট সেন্টিমেন্ট বিরাজ করছে এবং এন্টি–ইমিগ্রেন্ট রাজনৈতিক দলগুলি রাজনীতিতে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন সহ বিভিন্ন পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে কট্টর ডান দলগুলি ক্ষমতায় আসছে। আমেরিকায় দশা ভিন্ন নয়। আর তাই সে দেশে ভোটাররা বিশেষ করে স্বল্প শিক্ষিত ও বেকাররা ট্রাম্পের দিকে ঝুকে পড়েছে।
যাই হোক–শেষ কথা হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী চার বছরের জন্যে পৃথিবীর সব চাইতে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হিসাবে হোয়াইট হাউস নিজের দখলে নিতে চলেছেন। কেবল আমেরিকা নয়, গোটা বিশ্ব মূলত তাকিয়ে রয়েছে আমেরিকার দিকে। আগামী চার বছর আমেরিকার অনুসৃত নীতিমালার ওপর নির্ভর করবে বিশ্বের অনেক বিষয়। নির্ভর করবে ইউক্রেনসহ ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। নির্ভর করবে ন্যাটো, বিশ্ব জলবায়ু সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেমনটি হবে আগামী দিনগুলি? তা দেখার জন্যে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। (৭–১১–২০২৪)
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট