হল্যান্ড থেকে

দেশ থেকে ফিরে এসে- ‘ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে’

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২৪ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ঝরা পাতা গো, ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে / অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে / ফাগুন দিল বিদায়মন্ত্র আমার হিয়াতলে …. শেষের বেশে সেজেছ তুমি কি এ / খেলিলে হোলি ধুলায় ঘাসে ঘাসে/ বসন্তের এই চরম ইতিহাসে।’

আজ শীতের সকালে বাসা থেকে বের হয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখি প্রকৃতি এক নতুন রূপ ধারণ করেছে। গাছের পাতাগুলি তাদের গায়ে বাসন্তী রং মেখে যেন কোন এক অজানা অভিমানে ঝরে পড়ছে। প্রকৃতির সাথে মনের কী এক অদ্ভুত মিল। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতি কেবল নিজেকে সাজায় না, সাজায় আমাদের মনকেও। প্রকৃতি ও মনের এই পরিবর্তনে আমাদের অনেকে, মনের ভাব সে মিলনের হোক কিংবা বিরহেরপ্রকাশ করতে চায়, কিন্তু পারেনা। তখন সে আশ্রয় নেয় কবির কবিতায় কিংবা গানে। প্রকৃতির প্রতিটি পরিবর্তন, কেবল প্রকৃতিই বলি কেন, আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, সুখদুঃখ, আনন্দবিষাদ আমরা প্রকাশ পেতে দেখি কবিগুরুর সৃষ্টি কবিতায়, গানে, নানা রচনায়। মনের কথাটা যখন মনের মত করে ব্যক্ত করতে কিংবা সাজাতে পারিনে তখন অনেকের মত আমারও একমাত্র আশ্রয়স্থল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। তাতে মনটা হালকা হয়। এক ধরনের ভালো লাগায় পেয়ে বসে। তাই কবিগুরুর পরে ভর করে আজকের এই লেখা শুরু। হল্যান্ডে গাড়িরাস্তার পাশাপাশি সাইকেলের জন্যে রয়েছে টুওয়ে পৃথক লেইন। রাস্তার দুধারে অসংখ্য গাছ, সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে। কদিন আগেও তাতে পাতার রং ছিল সবুজ। আজ দেখি তার অনেকটা বাসন্তী রং ধারণ করেছে। বাসন্তী রং গায়ে মেখে ঝরে পড়ছে; মাটিতে, সড়কে লুটোপুটি খাচ্ছে। পাতাগুলির মত একদিন আমরাও ঝরে পড়বো। দুয়ের পার্থক্য এই পাতাগুলির আবার আগমন ঘটবে, আমাদের যাওয়া হবে চিরদিনের তরে। এই ঝরাপাতার চোখজুড়ানো দৃশ্য দেখে আপনাতেই নীচু শব্দে, বেসুরো গলায় গুনগুন করে গেয়ে উঠি– ‘ঝরা পাতা গো, ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে।’ সকালে গিয়েছিলাম বাসা থেকে মাইল খানেক দূরত্বে এক হাসপাতালে। চোখের রেগুলার চেকাপেরজন্যে। মুখে না বললে কী হবে, শরীর সাবধানী বাণী দিয়ে বলছে, ‘মেঘে মেঘে বেলা তো কম হলোনা। আসলেও তাই। কখন কোনদিকে যে ৩৩টি বছর এই হল্যান্ডেই পার করে দিলাম। এখনো মনে হয় যেন এই তো সেদিন এলাম অচেনাঅজানা ওলন্দাজদের এই দেশে। এখনো স্পষ্ট দেখতে পাইহুইল চেয়ারে মা বসে, চোখে চশমা। কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। অশ্রুজলে ঝাপসা হয়ে গেছে তার চশমা। নিকটজনদের সাথে তিনিও এসেছিলেন ঢাকা বিমানবন্দরে তার ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের তৃতীয় পুত্র সন্তানকে বিদায় দিতে। বিদায় মুহূর্তে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরতেই মা হুহু করে কেঁদে ওঠে। মায়ের মত সেই মুহূর্তে হুহু করে কেঁদে উঠিনি, তবে চোখ ভিজে এসেছিল। কী অবাক করা আজ এতগুলি বছর পর, এই কথাগুলি যখন লিখছি, এই জায়গায় এসে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। সবাইকে ছেড়ে চলে এলাম অচেনা এদেশে। মা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন আমার হল্যান্ড আসার ১১ বছর পর, ২০১০ সালে, চিরদিনের তরে। তার এই যে চলেযাওয়া, চিরদিনের তরে, সবাইকে পিছু রেখে এটিও প্রকৃতির অমোঘ বিধান। একে ঠেকায় কার সাধ্যি?

সপ্তাহ খানেক ধরে হল্যান্ডে বেশ শীত পড়ছে। এ আর নতুন কি? শীতের দেশে শীতই তো পড়বে। বরঞ্চ শীত না পড়ে যদি কাঠফাঁটা রোদ্দুর বা অসহনীয় গরম পড়তো তাহলে বলা যেত বলারমত কোন সংবাদ। সাংবাদিকতায় একটা কথা প্রচলিত। তা হলো -‘কুকুর মানুষ কামড়ালে সেটি সংবাদ হয়না, মানুষ যদি কুকুরকে কামড়ায় সেটি সংবাদ হয়।কারণ সেটি অস্বাভাবিক ঘটনা, নিত্য ঘটেনা। লেখার মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে ‘মানুষ কুকুরকে কামড়ানো’ নিয়ে একটি ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তখন কাজ করছি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ডেইলি লাইফে, রিপোর্টার হিসাবে। ডেইলি লাইফের তখন পূর্ণ যৌবন। পত্রিকার সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম ববি ঢাকা থেকে এসেছেন। উনি থাকেন ঢাকা, মাঝে মধ্যে চাটগাঁ আসেন পত্রিকার কারণে। প্রতিদিনকার মত এক দুপুরে অফিসে গেছি। কথা প্রসঙ্গে সহকর্মীদের বললাম, দিন কয়েক আগে পটিয়ার এক গ্রামে আমার বোনের জেঠাতোদেবরকে কুকুর কামড় দিয়েছে। সে শুনেছে যেকুকুর কামড় দেয়, তাকে যদি উল্টো কামড় দেয়া যায়, তাহলে কুকুরের বিষ কাজ করে না। যাকে কামড় দিয়েছে তার ডাকনাম ছিল সোনা। আমরা ডাকতাম সোনাদা। বেশ সাহসী ও শক্ত সামর্থ ছিল সে। সে তক্কে তক্কে থাকে কুকুরটিকে ধরার জন্যে এবং একদিন পেয়ে গেল হাতের নাগালে। কুকুরকে ধরে সে দিল কামড়। ঘটনাটি এদ্দুর বলার সাথে সাথে সম্পাদক ববি ভাই আমাকে বললেন, ‘তুমি এখনই ইলিয়াসকে (ফটোগ্রাফার) নিয়ে ওই ছেলের ছবি তুলে আনো। এটি বক্স আইটেম নিউজ।’ সম্পাদকের হুকুম। না করতে পারিনা। এদিকে সোনা আমার আত্মীয়। কী করি। এই দুপুরে হুট্‌ করে পটিয়া যাওয়া। মনে পড়লো মেজদার এলবামে স্টুডিওতে তোলা ওদের দুজনের একটি ছবি দেখেছিলাম। অফিস থেকে রিক্সা নিয়ে বাসায় এসে সেই ছবি কেটে সোনাদার ছবিটা নিয়ে এলাম। পরদিন ছবিসহ পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হলো। ভাগ্যিস ইংরেজি পত্রিকা। সংবাদে সোনা বড়ুয়া না লিখে, লিখলাম সোনা মিয়া। অজ পাড়াগাঁয়ে এই পত্রিকা পৌছুবেনা সে নিশ্চিত। সোনারও কোনদিন জানা হবে না। পরদিন সংবাদটি ছাপা হলো, বাহবা পেলাম। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মঈনুল আলম। তিনি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান। ঠিক পরদিন ইত্তেফাকের শেষের পাতায় বঙ আইটেমে সংবাদটি ছাপা হলো। সাথে সাথে সোনার গ্রাম ছাড়িয়ে গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো ওই সংবাদ। এর পর থেকে ওকে দেখলেই লোকজন ক্ষেপাতে থাকে। প্রথম দিকে সে বিষয়টা তেমন একটা আমল দেয়নি। কিন্তু দিনদিন তাকে নিয়ে উত্যক্ত করা বাড়তে থাকলে সে ক্ষেপে যায়। ইতিমধ্যে সে জেনেছে সংবাদের মূল হোতা কে। বলে, ‘বিকাশ এই গ্রামে একবার আসুক, তাকে যদি আমি কামড় না দেই তাহলে আমার নাম সোনা না।জানতাম, সে এমন কাজ করতে পারে। ভয়ে আর দিদির বাড়ি অনেক দিন যাইনি। মামলা করবে এই হুমকিও দিয়েছিল। যাই হোক, কয়েক বছরের মাথায় শান্ত হয়ে এলো পরিস্থিতি। অনেক দিন পর ওই গ্রামে বেড়াতে গেলে দেখা হতেই সোনাদা বলে, ‘তোকে যদি ওই সময় পেতাম তাহলে ঠিকই কামড় দিতাম।ফিরে আসি হল্যান্ডে

গতকাল সন্ধ্যার পর ছিল প্রায় মাইনাসের কাছাকছি। দিনের বেলায় কিছুটা ওপরের দিকে। ঠান্ডা তাও সয়। বিরক্তি ও কষ্ট হয় যখন শীতের সাথে সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ে। তখন শীতের তীব্রতা আরো বাড়ে। শীত যেন গায়ের চামড়া ভেদ করে হাড্ডিতে গিয়ে পৌঁছায়, যাকে বলে, হাড় কাঁপানো শীত। কেউ কেউ বলেন, শীতের আগমনের সাথে সাথে ইউরোপের মজাটাই শেষ। এখন ড্রইং রুমের সোফায়, ডিভানে কিংবা ফায়ারপ্লেসের কাছাকাছি বসে বীয়ার পান করো আর চুটিয়ে আড্ডা দাও। আবার এর উল্টো দিকও রয়েছে। অনেকে বলেন, ‘উইন্টার ইজ নট এ সিজন, ইট ইজ এ সেলিব্রেশনঅর্থাৎ শীত একটি ঋতু নয়, এটি একটি উৎসব বা উদযাপন। দেশে শীত বা শৈত্য প্রবাহের আগমনে দুর্ভোগ বাড়ে খেঁটেখাওয়া সাধারণ মানুষের। পরনে নেই গরম কাপড়, রাস্তার ধারে ছেঁড়াকাগজ, গাছের ডাল, গাড়ীর পরিত্যক্ত টায়ার জ্বালিয়ে চক্রাকারে বসে আগুন পোহাতে দেখি তাদের। দেখে কষ্ট হয়। ইউরোপে এমনটি দেখা যায়না বটে, তবে মাঝেমধ্যে দেখি বসনিয়া, রুমানিয়ার জংগলে, এমন কী হাইওয়ের পাশে কাপড়ের তাবু টাঙিয়ে সুন্দর জীবনের আশায় পশ্চিমে ধেঁয়ে আসা ভাগ্যাহত যুবকযুবতী, শিশুকিশোরদেরও। শীতের সময় এদের দুর্ভোগ বাড়ে। এই দুর্ভোগের পরিমাণ আর বাড়ে যখন বরফ পড়তে শুরু করে। বরফ তখন এদের জন্যে অভিশাপ। অথচ এই বরফের জন্যে হন্যে হয়ে অপেক্ষা করে ইউরোপীয়রা, বিশেষ করে বছরের শেষ মাসে, ক্রিস্টমাসের আগে। ইউরোপীয়রা অপেক্ষায় থাকে হোয়াইট ক্রিস্টমাসেরজন্যে। তার মজাই ওদের কাছে আলাদা। বরফ কিংবা তুষারের দেখা না মিললে নকল তুষার বা বরফ দিয়ে তারা হোয়াইট ক্রিস্টমাসেরআবহ তৈরী করে। খ্রীষ্ট সমপ্রদায়ের বড়দিন আসার এখনো মাস দুয়েক বাকি। এখন থেকেই নূতন সাজে সেঁজেছে হল্যান্ড সহ ইউরোপের সকল শপিং মল, শপিং ও ট্যুরিস্ট এলাকাগুলি। বিভিন্ন চেইনশপগুলি ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে বাড়তি মূল্যহ্রাসের ঘোষণা দিয়ে টেলিভিশনরেডিও ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন ছাড়াও ঘরে ঘরে ডাকযোগে বিজ্ঞাপনের বিশেষ ক্যাটালগ পাঠাতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীদের পৌষ মাস। এরা তখন বলতে শুরু করে– ‘এভরি উইন্টার হ্যাজ ইটস স্প্রিংঅর্থাৎ প্রতি শীতেরই বসন্ত থাকে। ব্যবসায়ীদের পৌষ মাস বটে, তবে শীত এলে আমার মত কারো কারো জন্যে কিছুটা সর্বনাশ। যেন প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস / তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।প্রচণ্ড শীতের দিন ঘরের বাইরে পা রাখতে ভয় হয়। এমন না যে বের হই না। বের হই, হতে হয়। তখন গায়ে চাপাতে হয় ব্যস্তসম গরম কাপড়, যা খুব বিরক্তিকর। দেশ থেকে ফিরেছি মাস দেড়েক। দেশে অনিয়ম খাওয়াদাওয়া, ঘুম, ঘোরাঘুরি, টেনশন সব মিলিয়ে ওজন কমেছে প্রায় তিন কেজি। এই হারানোওজন উদ্ধার করতে কয়েক সপ্তাহ গিয়েছিলাম বাড়ির কাছাকাছি জিমনেসিয়ামে। খুব যে ফ্যানাটিকজিম করি তা নয় কিন্তু। শরীরকে রোগমুক্ত ও ঠিক রাখার জন্যে যতটুকু না করলেই নয় কেবল সে পরিমাণ গায়ের ঘাম ঝরানো। কয়েক সপ্তাহে হারানো ওজনের অনেকটা ফিরে এসেছে। কিন্তু সপ্তাহ ধরে ঠান্ডার প্রকোপ বাড়তে থাকায় জিমে যাবার আগের যে একটা রিদমছিল তার পতন হয়েছে। সোজা বাংলায় বলা যায় তাতে ছন্দপতন হয়েছে। ভাবি আমার এই ক্ষয়িষ্ণু জীবনের অনেক কিছুরই তো পতন হয়েছে। তাতে এই পৃথিবীর কার কী এসে যায়। এ আর এমন কি! (১৬১০২০২৪)

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজননেতা চৌধুরী হারুন : আদর্শিক রাজনীতির প্রতিভূ
পরবর্তী নিবন্ধসর্বত্রই সিন্ডিকেট, নির্মূল অতীব জরুরি