হল্যান্ড থেকে

আজাদীর ৬৫ বছর জয় হোক দৈনিক আজাদীর

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

ভাবতে অবাক লাগে, ভালো লাগে, সাথে গর্বও। এই কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত যে পত্রিকা, দৈনিক আজাদী, জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে আজ অবধি পাঠকপ্রিয় পত্রিকা হিসাবে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে টিকে আছে তার সাথে আমার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। স্বগৌরবে আজাদীর বেঁচে থাকা ৬৫টি বছর অনেকটা সময়। কত পত্রিকা আমাদের চোখের সামনেই ‘মরে’ গেল। কিছু কিছু পত্রিকা এখনো আছে বটে, তবে অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে, অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার মত। দৈনিক আজাদীর ইতিহাস বলে ভিন্ন। কোন এক গোপনজাদুবলে যে এই পত্রিকাটি টিকে আছে জানিনে। জাদু তো নিশ্চয় আছে। সে গোপনজাদু হলো পাঠকের পালস বুঝে সংবাদ, তথ্য তুলে ধরার সক্ষমতা, পাঠকের সাথে একটা নিবিড় যোগসূত্র তৈরি করার সক্ষমতা। বোধকরি পাঠকের এই ‘পালস’ অন্য পত্রিকা ঠিক মত ধরতে পারেনা বলে তারা এগিয়েযাবারদৌড়ে পেছনে পড়ে থাকে। দৈনিক আজাদীর এই ৬৫ বছরে পদার্পণে আমার বিশেষ ভালো লাগা, গর্ব লাগার কারণ রয়েছে। আমার পরম সৌভাগ্য যে ৬৫ বছর বয়েসী এই পাঠকনন্দিত দৈনিক পত্রিকাটির সাথে আমার নিয়মিত লেখালেখির যোগাযোগ প্রায় ৩৪ বছর, অর্থাৎ পত্রিকার বয়সের অর্ধেকেরও কিছুটা বেশি। এতটা সময় তো অনেকে বাঁচেই না। অথচ দৈনিক আজাদী পরম গৌরবে, পাঠককুলের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এখনো বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে আরো অনেক অনেক বছর সে প্রত্যাশা। আমার লেখালেখির বয়স ৩৪ বছর হলেও এই পত্রিকার সাথে, সম্পাদক থেকে শুরু করে এর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ তারও আগ থেকে। সে আশি দশকের শুরুতে। যখন চট্টগ্রাম থেকে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে, হাতির পিঠে বিজ্ঞাপন দিয়ে বের করা হয়েছিল বন্দর নগরীর প্রথম অফসেট ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, দি ডেইলি লাইফ। কিন্তু এর শুরুর দিকটায় যে জাঁকজমক, ঠাঁটবাট, যৌবন, ঔজ্জ্বল্য ছিল তা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। পত্রিকাটির এখন অনেকটা ‘মরফিন’ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার মত দশা বলে জেনেছি। ডেইলি লাইফ বের হবার মাস কয়েকের মাথায় তাতে যোগ দিলাম। প্রথমে সাবএডিটর, ছয় মাসের মাথায় রিপোর্টিংয়ে যোগ দিয়ে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই অনেকটা ‘কোন বনেগা কৌড়পতি’র মত বনে গেলাম সাংবাদিক। সেই সূত্রে প্রায় প্রতিদিন যেতাম আন্দরকিল্লার এক সরু গলিতে, ঢুকতেই হাতের বাদিকে একটু পুরানো ধাঁচের বিল্ডিংয়ে। তার সামনে রেড ক্রিসেন্ট ম্যাটারনিটি হাসপাতাল। বিল্ডিংয়ের উপরের তলায় মালিকের বাসা, দোতলায় পত্রিকা অফিস, নিচ তলায় প্রেস। সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই চোখে পড়তো পাতানো একটি মাঝারি আকারের টেবিল। সেটিকে ঘিরে বসতেন সে সময়কার কয়েক হেভিওয়েট সাংবাদিক। তাদের মধ্যে অন্যতম, সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, বার্তা সম্পাদক সাধন ধর, সাহিত্যিক লেখক সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত, লেখক বিমল বড়ুয়া, চিফ রিপোর্টার ওবায়দুল হক, মাহবুবউল আলম, আতাউল হাকিম, কাজী জাফরুল ইসলাম, সমীর ভট্টাচার্য। এদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু তারা দৈনিক আজাদীকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ও প্রচেষ্টা দিয়েছিলেন। আর দিয়েছিলেন বলেই আজাদী এখনো বর্তমান অবস্থানে আছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এদের কয়েকজনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে মেশার, জানার। শুরুর দিকে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সাধন ধর, অরুণ দাশগুপ্তের সাথে তেমন আলাপচারিতা হতো না। বয়স, অভিজ্ঞতায় অপরিপক্ব বিধায় নিজেকে তাদের কাছ থেকে দূরে রাখতাম। ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে ভেতরের কামরায় চলে যেতাম। সেখানে দেখতাম সুদর্শন এক ব্যক্তি। খুব একটা কথা বলেন না, দেখে মনে হতো কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট এবং আত্মম্ভরী টাইপের। তার সাথেও কথা হতোনা। তিনি পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এম এ মালেক। যিনি আজকের সম্পাদক। অনেক বছর পর, বিশেষ করে আমার হল্যান্ড চলে আসার পর যখন তার সাথে, তার সুযোগ্য স্ত্রী কামরুন নাহার মালেকের সাথে পরিচয় হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো, একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠলো, তখন আবিষ্কার করলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন আর এক এম এ মালেককে। হাস্যরস, ‘উইটি’কৌতুকে ভরপুর, বন্ধুসুলভ ও বিনয়ী এক ব্যক্তি। দৈনিক আজাদীতে যেতাম সে সময়কার অপেক্ষাকৃত তরুণ ও স্মার্ট রিপোর্টার এম নাসিরুল হকের কাছে। সকালে অফিসে গিয়ে দিনের এসাইনমেন্ট খাতা দেখে তিনি বের হয়ে পড়তেন অফিস থেকে। তার মোটর বাইকের পেছনে সওয়ার হয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে (সিআরবি), কাস্টমস, পোর্ট, চেম্বার অফ কমার্স সহ কত অফিসপ্রতিষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহে যে গেছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। বয়সে আমার চাইতে বড় নাসির ভাইয়ের সাথে সেই যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তা এতো বছর পরও এখনো অটুটু রয়েছে, সামান্যতম ভুল বুঝাবুঝি হয়নি এই দীর্ঘ পথচলায়। যদি জিজ্ঞেস করা হয় আজাদী তার এই ৬৫ বছর বয়সে চট্টগ্রামের জন্যে কী অবদান রেখেছে, তাহলে প্রথমে নির্দ্বিধায় বলতে হয়, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, লেখককবি পাশাপাশি পাঠক সৃষ্টির পেছনে দৈনিক আজাদীর অবদান অনস্বীকার্য। গণতান্ত্রিক ও অসামপ্রদায়িক পরিবেশ গড়ে তোলার পেছনে এই পত্রিকাটি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। কেবল তাই নয়। নগরীর বিভিন্ন স্থানে সৌন্দর্য্যাবর্ধন, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রেও পত্রিকাটির কর্মকান্ড চোখে পড়ে, বিশেষ করে জামালখান এলাকায়। দেশের দুর্দিনে জনগণের পাশে এসে দাঁড়াতেও আমরা দেখি আজাদীকে। স্বাস্থ্যসেবা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খেলাধুলা সহ নানা গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রামের কৃতি সন্তানদের ঘটা করে সম্মান জানাতেও দেখি এই পত্রিকাকে। এই যে আমরা বলি জনগণেরপত্রিকা, সে তো আর এমনি এমনি এবং রাতারাতি গড়ে উঠেনি। তার জন্যে আজাদী পরিবারকে, পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, ভূতপূর্ব সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক সহ তার পরিবারকে অনেক ত্যাগতিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আজ থেকে ৬৪ বছর আগে ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী যখন প্রথম বের হয়, তখন এম এ মালেক নিজে সাইকেল চালিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যারীদের বাসায়বাসায় গিয়ে পত্রিকার কপি বিলি করতেন। তখন তিনি কলেজের ছাত্র। তার বাবা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে ভিক্ষুকদের ভিক্ষা না দিয়ে ওদের অফিসে ডেকে বিনা পয়সায় পত্রিকা দিয়ে তা বিক্রি করতে দিতেন। তাতে একদিকে পত্রিকা পৌঁছাতে শুরু করে পাঠকের কাছে, অন্যদিকে ওই সমস্ত ভিক্ষুকরা ভিক্ষা পেশা ছেড়ে হকার হিসাবে আবির্ভূত হন। মালেক সাহেবের বাবার মৃত্যুর পর পত্রিকা আর্থিক সংকটে পড়লে তিনি তার বাবার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক রেখে পত্রিকাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। অনুমান করি তিনি চাইলে সেই সময় ঝুঁকি না নিয়ে তাদের পারিবারিক প্রিন্টিং ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারতেন। কিন্তু পত্রিকার প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং বাবার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাকে টিকিয়ে রেখে বাবার সুনাম রক্ষা করা ছিল তার অগ্রাধিকারতালিকায়। আজকের অনেক পাঠক, শুভানুধ্যায়ীদের অনেকে হয়তো জানেননা আজকের দৈনিক আজাদীর পেছনের এই কাহিনী। বর্তমানে আজাদীর কোন দেনা নেই, কোন লস নেই, সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল একটি দৈনিক। একটা সময় প্রয়াত সম্পাদক খালেদ সাহেবের পরিচয় ছিল এই বলে, ‘আজাদীর খালেদ সাব’। এখন সময়ের বিবর্তনে হয়েছে ‘আজাদীর মালেক সাব’। এম এ মালেকের আর কোন পরিচয় লাগে না। আমার ধারণা হল্যান্ড থেকে তার নামে যদি কোনকিছু ডাকযোগে পাঠানো হয় এবং তাতে ঠিকানায় কেবল এম এ মালেক, দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশলিখলে চিঠি গিয়ে পৌঁছাবে নির্দিষ্ট স্থানে। ভাবছি দুএকদিনের মধ্যে এই পরীক্ষাটি করবো। দৈনিক আজাদী এবং এম এ মালেকএই দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধীরে ধীরে সামনে আসছেন মালেক সাহেবের দুই আত্মজর বড়জন, ওয়াহিদ মালেক। জীবন প্রবাহের যে ধারা সেই ধারার প্রক্রিয়ায় একদিন সবাই বলবে ‘আজাদীর ওয়াহিদ সাব’। দৈনিক আজাদী পত্রিকার নাম নিয়েও একটি ঘটনা আছে। আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে উদ্ধৃত করে সাংবাদিক রফিকুল বাহার এক জায়গায় লিখেছেন, পাকিস্তান আমলে প্রথমে পত্রিকাটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘সীমান্ত’। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই নাম শুনে একটু বামঘরানার ঘ্রাণ পেয়েছিল। তারা বলেছিল, এই নাম হবে না, অন্য নাম দিতে হবে। পরে উর্দু শব্দ ‘আজাদী’ বেছে নেয়া হয়। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবং অর্থনীতির মুক্তি দুটির কথা বিবেচনা করে এই নাম।’

প্রবাসে আমরা যারা স্থায়ী, অস্থায়ীভাবে বাস করি, বিশেষ করে যাদের শেকড় চট্টগ্রাম এবং যারা দেশের খবরাখবর রাখেন, অনলাইনে পত্রিকা পড়েন, নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তারা সবাই অনলাইনে দৈনিক আজাদী পড়েন। কথাটা এতো জোড় গলায় বলতে পারছি এই কারণে, দেশ থেকে এমন কী মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডা থেকেও প্রকাশিত লেখার ওপর মাঝেমধ্যে পাঠকের প্রতিক্রিয়া পাই। কেউ অভিনন্দন জানান, কেউ পরামর্শ দেন বিষয় নিয়ে। ভালো লাগে। লেখা চালিয়ে যাবার নতুন করে উৎসাহ পাই। আজ আমার যে সামান্য পরিচিতি তার সমস্ত কৃতিত্ব যতটুকু না লেখকের কলমের ধারের কারণে, তার চাইতে অনেক বেশি দৈনিক আজাদীর। আজাদীর কাছে যে আমার অনেক ঋণ। ঋণ আজাদী পরিবারের কাছে। চাটগাঁবাসীর প্রাণের এই পত্রিকার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি।

্ল

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রাথমিক শিক্ষার শিখন ঘাটতির প্রধান অন্তরায় ও প্রতিকার
পরবর্তী নিবন্ধপোশাকশিল্পে নৈরাজ্য বন্ধ অতীব জরুরি