হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৭ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বেশ কিছুদিন আগের কথা। এ নিয়ে একবার দীর্ঘ এক লেখা লিখেছিলাম, এই পাতায়। যাকে নিয়ে এই লেখা তিনি এখন পুনরায় আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে সামনের কাতারে এসেছেন। দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে এর হাল ধরেছেন। তার পরিচয়ে, তার গৌরবে আমরা গৌরবান্বিত হই দেশে, দেশের বাইরে, প্রবাসে। একটা কথা মানি, তা হলো, ভালো বিষয় নিয়ে যত বেশি বলা যায়, ততো ভালো। তাতে অন্যেরা উৎসাহিত হন, অনুপ্রাণিত হন ভালো কিছু করতে। সে কারণে আবারো তাকে নিয়ে লেখা। আরো একটি বিষয় মানি, সে হলো ভালো কিছু করলে সবাই যে আপনার কাজের প্রশংসা করবে তা ভাবার কোন কারণ নেই। এমন কী যে কাজটি আপনি আপনার সমস্তদিয়ে করেছেন, সমস্ত সততা দিয়ে সেরেছেন, দেখবেন কেউ না কেউ তার সমালোচনা করবেই। পাঠক, নিশ্চয় অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছে না আমি কার কথা লিখবো বলে এতো কথার অবতারণা করছি। তিনি হলেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস, ‘আরার ইউনুস। যে কথা বলছিলাম, অপ্রত্যাশিত ভালো, সুখকর কোন বার্তা পেলে সবার ভালো লাগার কথা। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছ থেকে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে কয়েকটি লাইনের একটি ইমেইল পেয়েছিলাম বছর কয়েক আগে। তাতে তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন, ‘প্রিয় বিকাশ, ডাচ পোষ্টকোড লটারির বার্ষিকগালা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে মার্চের ৩৬ তারিখ পর্যন্ত আমি আমস্টারডাম থাকবো। আমার কলীগ, তানবীর তোমার সাথে যোগাযোগ করবে। আশা করি আমাদের দেখা হবে। ইউনুস।অবাক হয়েছিলাম, সাথে আনন্দ। এই কারণে তার কাছ থেকে এই অপ্রত্যাশিত মেইল পাবার কথা ছিলনা। এমন না যে তার সাথে এর আগে ইমেইল যোগাযোগ ছিলনা। বার কয়েক যোগাযোগ হয়েছিল এবং নানা কারণে তার সাথে কয়েকবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, আলাপ হয়েছে, দশ জনের ভিড়ে, একান্তেও বাংলাদেশ এবং হল্যান্ডে। আমাদের উন্নয়ন সংস্থার জন্যে তিনি একবার একটি ভিডিওবার্তাও পাঠিয়েছিলেন, যা আমরা হল্যান্ডে নারীর ক্ষমতায়নশীর্ষক এক সেমিনারে প্রদর্শন করেছিলাম। হল্যান্ডে প্রথমবার তার সাথে দেখা সে অনেক দিন আগে। ১৯৯১৯২ সালে। তখন তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। তিনি ঢাকা থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন আমার ইউ এন বিনিউজ এজেন্সীর পরিচয়পত্র। মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে আমার প্রথম দেখা তারও আগে, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনার্স ভাইবা বোর্ডে তার মুখোমুখি হয়েছিলাম। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে, চট্রগ্রাম ছেড়ে যখন ঢাকায় সাংবাদিকতা করছি তখন আবারো তার মুখোমুখি হয়েছিলাম। পত্রিকার জন্যে তার একান্ত সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে। অনেক বছর পর আবার আমস্টারডামে।

হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে তার সাথে আমার মুখোমুখি শেষ সাক্ষাতের প্রেক্ষিত ভিন্ন। প্রেক্ষিতটা একান্ত নিজের এবং তা এমনই যে তিনি এক দিনেই (১ মার্চ ২০২০) পরপর তিনটে ইমেইল পাঠিয়েছিলেন আমাকে। সব কটির বিষয়, তার সহোদর মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। বিশিষ্ট মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ধুমসে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। মরণব্যাধি তাকে দমাতে পারেনি। অবাক করা ছিল তার কাজের নেশা। শরীর কুলোচ্ছে না, তারপরও তিনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নিরলস কাজ করে গেছেন। সে আমি অতি কাছ থেকে দেখেছি। চলতে অপারগ, ভগ্ন শরীর কিন্ত দৃঢ় মনোবল নিয়ে হল্যান্ড ঘুরে গেছেন। যাক, ফিরে আসি অধ্যাপক ইউনুস প্রসঙ্গে। অধ্যাপক ইউনুস লিখেছেন, “প্রিয় বিকাশ, ধন্যবাদ। আমি যখনই হল্যান্ড আসি তখনই জাহাঙ্গীর জোর করতো আমি যেন তোমার সাথে দেখা করি। আজ এই উপলক্ষকে ঘিরে তাকে স্মরণ করছি এবং এটি আমি করছি নিজ থেকে। গতকালের সন্ধ্যায় নৃত্যাঞ্চলেরঅনুষ্ঠানে (ঢাকায় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর স্মরণে লেখা বই, “অপরাজেয় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরপ্রকাশনা অনুষ্ঠান) তুমি উপস্থিত থাকলে ভালো লাগতো। অনুষ্ঠানটি খুব সুন্দরভাবে হয়েছিল। জাহাঙ্গীর তাদের শিখিয়েছে কী করে একটি অনুষ্ঠান ভালোভাবে করা যায়। আমস্টারডাম পৌঁছার পর আমি তোমাকে জানাবো কখন আমরা দেখা করতে পারি। জাহাঙ্গীরের বন্ধুদের সাথে আমি দেখা করতে চাই। তাদের সাথে দেখা করা আমার আর একটি দায়িত্ব, কেননা তাদের সাথে দেখা করার জন্য জাহাঙ্গীর আর কখনো আসতে পারবে না। খুব শীঘ্র দেখা হবে। ইউনুস। মেইলটা পড়ে কিছুটা সময় আক্ষরিক অর্থে বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম। অনুভব করছিলাম ছোটভাইয়ের প্রতি এক বড় ভাইয়ের কী আকুলকরা ভালোবাসা মেশানো কান্না, যা আমাকে অজান্তে ছুঁয়ে যায়।

ছোট ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ যে তাকে (অধ্যাপক ইউনুস) আমার সাথে দেখা করতে তাড়িত করে সে বুঝতে পারি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। আমার জন্যে সময় নির্দিষ্ট ছিল আধ ঘন্টা। প্রফেসর ইউনূসের দ্বিতীয় মেইলটি আমাকে এতটাই টাচডকরে যে অজান্তে আমার চোখের কোণায় পানি এসে গিয়েছিল। তার প্রতিটি শব্দে ছোট ভাইয়ের প্রতি পরম ভালোবাসা, মমতা প্রকাশ পেয়েছে। অতি আনন্দ ও আগ্রহের সাথে প্রফেসর ইউনূসের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম রাজধানী আমস্টারডামে, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে, যেখানে উনি উঠেছিলেন দিন কয়েকের জন্যে। ইতিমধ্যে তার অফিস থেকে তানবীরুল ইসলাম ও ইউনুস এন্ড ইউ ফাউন্ডেশনের ডমিনিক যোগাযোগ করে দিনক্ষণ ঠিক করে রাখে। আমার সাথে ছিলেন পারিবারিক বন্ধু, ব্যবসায়ী বুলবুল জামান। লবিতে বসে আছি। এমন সময় এক ইউরোপীয় তরুণ হাই বিকাশবলে আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার অচেনা, তবে অনুমান করি, ডমিনিক। আগেই জেনেছিলাম উনি জার্মান। প্রায় সময় তাকে ঢাকা যেতে হয় এবং প্রফেসর ইউনূসের দেশের বাইরে তাবৎ প্রোগ্রামের আয়োজন ও মধ্যস্থতা করে থাকেন উনি। জানতে চাই, ‘চিনলে কী করেজাহাঙ্গীরকে নিয়ে তোমার হল্যান্ডের বাসায় তোলা ছবি থেকে, যা তুমি প্রফেসর ইউনুসকে পাঠিয়েছিলে। ডমিনিক জানালে, উনি (ইউনুস) এই হোটেলেই আর একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন। একটু পরই শেষ হবে। আমাদের সময় নির্দিষ্ট ছিল বিকেল সোয়া পাঁচটা। তার ঠিক মিনিট পাঁচেক পর পাশ থেকে তার কণ্ঠস্বর শুনি, ‘কই‘ ? দেখেই বলে উঠলেন, ‘কী খবর বিকাশ, কেমন আছো‘? কুশল বিনিময়। লবির এক কোণায় সোফায় বসে কথা শুরু। বুলবুল জামানকে পরিচয় করিয়ে দেই। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের প্রসঙ্গ উঠে আসতেই লক্ষ্য করি তার কণ্ঠস্বর ভিজে এসেছে। অজান্তে আমারও। উনি বলেন, ‘সে (জাহাঙ্গীর) ছিল রিয়েল ফাইটার। রোগ তাকে কাবু করতে পারেননি।জাহাঙ্গীর প্রসঙ্গে তিনি এক লেখায় লিখেছেন, “জাহাঙ্গীরের অসুখ তার শরীরকে কাবু করেছে, কিন্তু তার মনকে বিন্দুমাত্র কাবু করতে পারেনি। সে তার পরাজিত শরীরটি থেকে মুক্তি নিয়ে তার অপরাজেয় মনটি নিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো

আধ ঘন্টার আলাপে জানতে চাইলেন ব্যক্তিগত খবরাখবর, হল্যান্ডপ্রবাসী বাংলাদেশিদের খবর, কেমন আছে তারা, কী করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বলতে চেয়েছিলাম অনেক কিছু, কিন্তু তার মুখোমুখি হয়ে যেন কথা হারিয়ে ফেলি। তিনি কথা বলেন সুন্দর করে। তার কথা শুনতেই ভালো লাগে। শ্রোতা এবং বক্তার সাথে যে ইন্টারঅ্যাকশনহওয়া দরকার সেটি তিনি করেন খুব দক্ষতার সাথে। তার কথা শুনে মনে হয় এই কথাটি মনে হয় তিনি আমাকেই বলছেন। আর এমনটি ভাবেন প্রতিটি দর্শকশ্রোতা। দর্শকশ্রোতার সাথে এই যে সংযোগ তা অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিও করতে পারেননা। ড. ইউনুস সেটি খুব দক্ষতার সাথে করতে পারেন। আর পারেন বলেই তিনি পাঁচ জনের একজন নয়, একেবারে সেরা। হল্যান্ডের হেগ শহরের পাঁচ তারকা হোটেল, হোটেল কুরহাউজে হলভর্তি দর্শকশ্রোতার উপস্থিতিতে দেখেছি পিনপতন নীরবতায় তিনি দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন। সহজ সরল ভাষায়। সে যাক শেষ করবো এই লেখা একটি স্মৃতিচারণ করে। তার ছোট ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মুখ থেকে শোনা। তিনি বলছিলেন তাদের চাটগাঁবাড়ীর কথা, ভাইদের গল্প, প্রতি ঈদে চাটগাঁর বাড়িতে সব ভাইদের এক হওয়ার অনেক গল্প। একবার এক মজার গল্প বলেছিলেন জাহাঙ্গীর ভাই। বললেন, ”মেজদা (ইউনুস) বাড়িতে ছোটছোট ভাইপো, ভাইঝিদের স্কুলে যাবার জন্যে ঘুম থেকে উঠার তাগিদ দিচ্ছেন। ওদের কেউ কেউ লেপের ভেতর থেকে বলে, ‘এখনো তো সকাল হয়নি, অন্ধকার‘ (খুব সম্ভবত মেঘলা দিন)। তখন মেজদা বলেন, ‘তোরা ইউরোপ থাকলে তো কখনো স্কুলে যেতে পারবিনা, কেননা ওখানে তো খুব কম দিনেই সূর্য উঠে।জাহাঙ্গীর ভাইকে অধ্যাপক ইউনুস সম্ভবতঃ বেশি আদর করতেন। তার একটি নামও দিয়েছিলেন তিনি ছোট বেলায়। জাহাঙ্গীরকে ডাকতেন মিষ্টিবলে। পরিবারের অন্যান্যরা এই নামে অনেকদিন ডেকেছে বলে জেনেছি। তারপর কোথা থেকে জাহাঙ্গীরনামটি চালু হয়ে যায়। অধ্যাপক ইউনূসের লেখা থেকে জানতে পারি আরো মজার গল্প। তার কথায়, “জাহাঙ্গীর যখন চারপাঁচ বছরের বালক তখন তাকে নানা কারণে বকা দিতাম। বকা দিলে সে চোখ বড় বড় করে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। কিছুক্ষণের মধ্যে দুচোখ থেকে টশ টশ করে পানি পড়তে আরম্ভ করতো। কোন প্রতিবাদ করতো না। পালিয়ে যেত না। স্থির দাঁড়িয়ে থাকতো। পরে নিজেরই খারাপ লাগতো। বকা বন্ধ করে দিতাম। তার চোখের পানি থামাবার চেষ্টা করতাম। আমস্টারডামের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের লবিতে মুখোমুখি বসে সেদিনের আলাপচারিতায় লক্ষ্য করি অধ্যাপক ইউনূসের চোখের কোণে পানি। আমার চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছিল আমার অজান্তে।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে চাই সামাজিক জাগরণ
পরবর্তী নিবন্ধআইনশৃঙ্খলার পরিপূর্ণ স্বাভাবিকতা জরুরি