একটি গুলি! লক্ষ্য অব্যর্থ হলে শেষ হতো ট্রাম্প–অধ্যায়। ব্যর্থ হওয়ায় কেবল প্রাণে নয়, বোধকরি রাজনৈতিকভাবেও বেঁচে গেলেন ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার আর তাকে ঠেকায় কে! ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন! কোথায় অনেকে ধরে নিয়েছিলেন ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হিলে দাঙ্গা উস্কে দেবার কারণে তার সাজা হবে, ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্যে তার জেল–জরিমানা হবে, আদালত তাকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে অযোগ্য ঘোষণা করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু এখনো হয়নি। হবে সে সম্ভাবনাও কম। কেউ কেউ এও বলেছিলেন, এইভাবে দিনের পর দিন আদালতে হাজির হওয়া এবং কোন কোন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হবার পর মার্কিন ভোটারদের মধ্যে, এমন কী রিপাবলিকান দলের মাঝেও তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে। যারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আগামী চার বছরের জন্যে হোয়াইট হাউসে দেখতে চাননি, তাদের হতাশ করে দেখা গেল ট্রাম্পের নির্বাচনী–হাওয়া তার পালে কেবল লাগা নয়, দিন দিন এর গতি তীব্র হতে লাগলো। গত ১৩ জুলাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার সভায় ২০ বছরের এক মার্কিন যুবক গুলি ছুঁড়ে তাকে হত্যা করার ব্যর্থ চেষ্টার পর সাধারণ জনগণের মাঝে রাতারাতি ট্রাম্পের প্রতি সহানুভূতি বেড়ে গেলো। এর ফলে আসন্ন নভেম্বর– প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে তার পক্ষে ‘সিম্প্যাথি–ভোট‘ বেড়ে যাবে তা বলা বাহুল্য। আততায়ীর গুলিতে সামান্য আহত হবার পর তার যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তা ছিল অনেকটা হলিউড–বলিউড টাইপের অ্যাকশন ছবির মত। নায়ক যেমন শত্রু পক্ষের গুলির আঘাতে আহত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, দৃঢ় কণ্ঠে হত্যাকারীকে দেখে নেবে বলে হুমকি দেয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পও ঠিক তেমনি কানে গুলি লাগার (নাকি কানের সাথে লেগে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া) সাথে সাথে মঞ্চে মাথা নিচু করে মুহূর্তপর মাথা উঁচু করে ঊর্ধপানে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরে, উপস্থিত দলীয় সমর্থকদের লক্ষ্য করে বলে উঠেন, ‘ফাইট, ফাইট‘। সমর্থকরাও সমস্বরে শ্লোগান দিয়ে উঠে, ‘ইউ এস এ‘ ‘ইউ এস এ‘।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভূতপূর্ব স্পিকার ন্যান্সি পলোসি সহ অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, মার্কিন রাজনীতিতে সহিংসতার কোন স্থান নেই। সে কথা জোর–গলায় বলেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ন্যান্সি পলোসি। কিন্তু তাদের সে কথা যে কত ঠুনকো সে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে বারবার দেখেছি। দেখেছি খোদ ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২১ সালে কীভাবে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তার উগ্র সমর্থকদের ক্যাপিটাল হিলে সহিংস–দাঙ্গা ঘটিয়েছিলেন। যে দাঙ্গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সহ বেশ কয়েক ব্যক্তি নিহত ও আহত হন। ওই সহিংস আক্রমণের উস্কানিদাতা ছিলেন নিঃসন্দেহে ট্রাম্প। আর এই কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা হলো। বিচারে কিছু হলোনা। কেবল হলো, ‘ট্রাম্প মিডিয়া শো‘। তিনি দিনের পর দিন এক আদালত থেকে অন্য আদালতে হাজিরা দিতে থাকলেন। বিনা পয়সায় মিডিয়া–প্রচারণা পেতে লাগলেন। তার ভোটারদের সহানুভূতি পেতে লাগলেন। মজার ব্যাপার হলো, ট্রাম্পকে এই যে হত্যার প্রচেষ্টা, একে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ আবার ‘সাজানো নাটক‘ বলে মনে করছেন। তাদের যুক্তি, ট্রাম্প যে স্থান থেকে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, সামনে কোন বুলেট–প্রুফ প্রটেকশন গ্লাস ছিলনা। কথিত শুটার, ২০ বছরের টমাস ম্যাথিউ ক্রুস ঘটনাস্থল থেকে খুব একটা দূরে ছিলেননা। ট্রাম্পের এতো বড় শরীর, শরীরের উপরাংশ, কিছুই ওই হত্যাকারী দেখলো না, গুলি চলে গেলো কানের পাশ দিয়ে? এ সবই অনুমান। আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেন্ট–প্রার্থী হত্যার ঘটনা, হত্যা প্রচেষ্টার মত ঘটনা অনেক ঘটেছে। আমেরিকার ইতিহাসে গুলিবিদ্ধ হয়ে চার মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রাণ হারিয়েছেন। এর শুরু ১৮৬৫ সালে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। প্রেসিডেন্ট হবার ছয় মাসের মাথায় গুলিতে প্রাণ হারান জেমস গারফিল্ড। গুলিবিদ্ধ হবার পর দীর্ঘ ছয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আর এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, উইলিয়াম ম্যাককিনলে ১৯০১ সালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গুলিবিদ্ধ হয়ে যে মৃত্যু আমেরিকা সহ গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে তা হলো আমেরিকার ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। অল্পের জন্যে বন্দুক হামলা থেকে বেঁচে যান আরো পাঁচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তারা হলেন, ফ্র্যাংকলিন ডি রুজভেল্ট, হ্যারি এস ট্রুম্যান, রোনাল্ড রেগেন এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ। সবশেষে, ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথিত হত্যাকারী টমাস ম্যাথিউ এফ বি আই–র দেয়া তথ্য অনুযারী রেজিস্টার্ড রিপাবলিকান হলেও ট্রাম্প সমর্থকরা একে ‘বামপন্থীদের‘ কাজ বলে দাবি করে চলেছেন। তাদের কথা, ট্রাম্প সম্পর্কে জো বাইডেনের উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তারা বলেন, গোটা নির্বাচনী প্রচারণায় বাইডেন ট্রাম্পকে একজন স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাকে (ট্রাম্প) যে কোন ভাবে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে হবে বলে ঘোষণা দেন। ট্রাম্প ক্যাম্পের দাবি, বাইডেনের এমন উস্কানিমূলক বক্তব্য এই ধরনের সহিংস কর্মকান্ড উৎসাহিত করেছে। জো বাইডেনের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ তোলার কারণ হলো, কিছুদিন আগে তিনি তার প্রতিপক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখে ‘ষাঁড়ের চোখ‘ (বুল‘স আই) রাখবেন। এর অর্থ হলো, শুটিং, ডার্ট খেলায় লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দু। বাইডেন ইতিমধ্যে গত সোমবার এনবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রিপাবলিকান মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ‘বুল‘স আই‘ রাখতে চেয়েছিলেন বলা ‘ভুল‘ ছিল। তবে তিনি এর পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, তার প্রতিপক্ষের (ট্রাম্প) বক্তব্য আরো উস্কানিমূলক। এবিসি–কে দেয়া আর এক সাক্ষাৎকার বাইডেন বলেন, যাই হোক না কেন আসন্ন দিনগুলিতে তার প্রচারণায় ফোকাস থাকবে ট্রাম্প। তিনি মনে করিয়ে দেন, ট্রাম্পই বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার প্রথম দিন থেকেই তিনি ডিক্টেটর (স্বৈরাচার) হতে চান। ট্রাম্পই বলেছিলেন যে নভেম্বর নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি হেরে গেলে ‘রক্তবন্যা‘ বয়ে যাবে। কথা হলো, ট্রাম্প–সমর্থকরা কিংবা দোদুল্যমান বা সুইং ভোটাররা তার এই সমস্ত সতর্কবাণী কানে নিলে তো। যাই হোক–
২) ট্রাম্প রক্ষা পেলেন। হত্যা প্রচেষ্টার ক‘দিনের মাথায় তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন এবং নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন। যে বিষয়টি লক্ষ্য করার মত তা হলো যা ট্রাম্পের চরিত্রের সাথে যায় না, তিনি এখনো পর্যন্ত তার ওপর এই আক্রমণের জন্যে বাইডেন কিংবা ডেমোক্র্যাক্টিক পার্টিকে আক্রমণ করে কিছু বলেননি, তার সমর্থকদের উদ্দেশেও উস্কানিমূলক কোন বক্তব্য রাখেননি। এখনো পর্যন্ত তিনি খুব সংযত থেকেছেন এবং ‘ঐক্যের‘ আহবান জানিয়েছেন। তবে ‘মন্দকে জয়ী হতে দেবেন না‘ বলে তিনি ঘোষণা দেন। এদিকে আর এক চমক দেখালেন ট্রাম্প। একসময়কার কট্টর ট্রাম্প–বিরোধী, ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘নেভার ট্রাম্পার‘ হিসাবে পরিচিত রিপাবলিকান দলীয় ওহিও সিনেটর, জে ডি ভেন্সকে তিনি আগামী নির্বাচনে তার ভাইস–প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত করেছেন। ট্রাম্প তার নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘দীর্ঘ চিন্তাভাবনা ও বিচার–বিবেচনা‘ করে তাকে মনোনীত করা হয়েছে। গেল সোমবার রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশন আনুষ্ঠানিক ভাবে ৩৯ বছরের জে ডি ভেন্সের নাম ঘোষণা করে। কে এই ট্রাম্প– মনোনীত ভাইস প্রেসিডেন্ট, জে ডি ভেন্স? ২০২২ সালে ভেন্স সিনেট সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন এবং শুরুতে তিনি ট্রাম্পের সমালোচক হলেও এক পর্যাযে ট্রাম্পের অন্ধ সমর্থক হয়ে পড়েন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেইক এমেরিকা গ্রেট এগেইন‘ নির্বাচনী এজেন্ডার অন্ধ সমর্থক হিসাবে আবির্ভুত হন। জানা যায়, ট্রাম্পের সাথে ভেন্সের ‘রসায়ন‘ খুবই ভালো, ব্যক্তিগত সম্পর্কও এবং নিয়মিত ফোনে দুজনের ‘বাতচিত‘ হয়। এদিকে জে ডি ভেন্সকে ডোনাল ট্রাম্প তার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেয়ায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্প এবং ভেন্স – এই দুয়ের মাঝে কোন ফাঁরাক নেই। নানা ইস্যুতে ভেন্স ট্রাম্পের ‘ক্লোন‘ উল্লেখ করে বাইডেন বলেন, এই দুয়ের মাঝে আমি কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা। তবে বিষয় হচ্ছে, ভেন্স সম্পর্কে বাইডেন কী বললেন সেটি নিয়ে রিপাবলিকান পার্টির কোন মাথা ব্যথা নেই।
৩) তবে মাথা ব্যাথা আছে খোদ জো বাইডেনের। কেননা ট্রাম্পের সাথে প্রথম বিতর্কে তার ‘অতি–মন্দ পারফর্মেন্সের‘ কারণে দলের ভেতর ও বাইরে থেকে দাবি সোচ্চার হচ্ছে যাতে তিনি নির্বাচনী–দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান। তাদের মতে, বয়স ও শারীরিক দিক বিবেচনা করে বাইডেনের উচিত নিজে এই লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানো। তা না হলে দলের জন্যে ভয়াবহ ফলাফল হতে পারে বলে দলীয় নেতা ও ডোনারদের আশংকা। ইতিমধ্যে বেশ কিছু বড় দাতা বাইডেন সরে না দাঁড়ালে দলের নির্বাচনী ব্যয়ের চাঁদা না দেবার হুমকি দিয়েছেন।তাদের ভয় যদি জো বাইডেন শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে লড়াই করে যাবার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন তাহলে পার্লামেন্ট এবং সিনেট–দু–জায়গাতেই ডেমোক্র্যাক্ট পাটির্র ভরাডুবি হবে। সবকিছু উপেক্ষা করে অতি সমপ্রতি এনবিসি–কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, তিনি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। জো বাইডেন তার সিদ্ধান্তে কতটুকু অনড় থাকবেন, কিংবা দলের স্বার্থে সরে দাঁড়াবেন কিনা, তা দেখার জন্যে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট