হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

দুটি ভিন্ন চিত্র। ভিন্ন সময়। অভিন্ন আসন (বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য)। সময় ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। জেনারেল এরশাদ সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ও গুলি চালায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। সময় ২০২২ সাল। ঘটনাস্থল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশ লাঠিপেঠা করে ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে। পদত্যাগ তো দূরের কথা, প্রতিবাদও না। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ ফরিদ উদ্দিন পুলিশ তলব করেন। পুলিশী নির্যাতন প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুলিশ বাধ্য হয়েছে’। দুই উপাচার্যে কী পার্থক্য। কী আকাশ-পাতাল ফারাক এই দুই শিক্ষকের চিন্তা-চেতনা-মননে। কেবল এই দু’টি ঘটনা এই হাইপোথেসিসে পৌঁছানোর জন্যে যথেষ্ট নয় কি যে আজকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের চেয়ার মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সংক্রমিত।
১) ফিরে যাই ইতিহাসে। আলেক্সজান্ডার দি গ্রেট। তিনি ছিলেন প্রাচীন গ্রীক রাজ্য মেসিডোনিয়ার শাসক। মাত্র ২০ বছর বয়সে পিতা রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের মৃত্য হলে তিনি সিংহাসনে বসেন। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি গ্রীস থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ইতিহাসের সব চাইতে বড় সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন। তিনি যুদ্ধে অপরাজিত ছিলেন এবং এই কারণে তিনি ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে সফল মিলিটারি কমান্ডার হিসেবে বিবেচিত হন। তার শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত আলেক্সজান্ডার শিক্ষক অ্যারিস্টটলের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিক্ষক অ্যারিস্টটলের প্রতি রাজা আলেক্সজান্ডারের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। নিজ শিক্ষক সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ও ধস রহফবনঃবফ ঃড় সু ভধঃযবৎ ভড়ৎ ষরারহম, নঁঃ ঃড় সু ঃবধপযবৎ ভড়ৎ ষরারহম বিষষ’ অর্থাৎ ‘বেঁচে থাকার জন্য আমি আমার বাবার কাছে ঋণী, কিন্তু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমার শিক্ষকের কাছে।’ বলা বাহুল্য, শিক্ষকের প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধা এমনিতে গড়ে উঠেনি। শিক্ষক তার গুণ, বিদ্যা, পরিশ্রম, ত্যাগ দিয়ে তার শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। স্কট হেডেনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষকের তিনটি ভালোবাসা : এক) শিক্ষার জন্যে ভালোবাসা, দুই) শিক্ষার্থীর জন্যে ভালোবাসা এবং তিন) প্রথম দুটি ভালোবাসাকে একত্র করার ভালোবাসা।’ এতো গেল বড় বড় ব্যক্তির কথা। শিক্ষক সম্পর্কে আমার ধারণা, ‘শিক্ষক হবেন তেমন ব্যক্তি যাকে দেখে ভয়ে নয়, শ্রদ্ধায় আপনাতে মাথা নুইঁয়ে আসে এবং তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করে।’ তেমন এক আদর্শ শিক্ষক পেয়েছিলাম স্কুল বয়সে। কলেজিয়েট স্কুলে তিনি আমাদের বাংলা পড়াতেন, সাহিত্যিক ওহীদুল আলম। পড়াতেন পরম মমতায়। আদর্শ শিক্ষক ছিলেন সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজল, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এদের প্রথম দু’জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং শেষের জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়েছিলাম। ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, দৈনিক আজাদী সম্পাদক। যাদের নাম উল্লেখ করলাম তাদের কাছে যাবার, কথা বলার, আলাপ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাদের কথা এতো বছর পরও এখনো শ্রদ্ধাভরে মনে করি। কথায় আছে – ‘যারা নিজের শিক্ষার কথা মনে করে, তারা শিক্ষকদের কথা মনে রেখেই তা করে। শিক্ষার পদ্ধতি ও কৌশলকে মনে রেখে নয়। শিক্ষক হলো শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র।’
২) যাদের নাম উল্লেখ করলাম তারা আজ নেই। এই তালিকায় হয়তো আরো অনেকে আছেন। তারা নেই বটে কিন্তু রেখে গেছেন বিশাল ও পূরণ-হবার-নয় এমন শূন্যতা। শিক্ষক খুঁজে বেড়াই। খুঁজে পাইনে। যাদের দেখি তাদের শিক্ষকের-মুখোশের আড়ালে দেখি ভিন্নচেহারা। তাতে শিক্ষার চাইতে স্বার্থ, নোংরা রাজনীতি, ব্যক্তি স্বার্থ, এমন কী দানবিক চেহারাও দেখি কখনো-সখনো। ব্যতিক্রম যে নেই তা না। সবাইকে এক পাত্রে ঢালছিনে। সেটি হবে অন্যায়। কিন্তু এটি তো অস্বীকার করতে পারিনে, পবিত্র এই পেশায় এখন মূল্যবোধের ধস নেমেছে। স্কুল থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়েও। পরিস্থিতি এমন যে, যে শিক্ষাপীঠ যত বড়, সে শিক্ষাপীঠে তত বড় অনিয়ম। দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সংক্রমিত উপাচার্যের চেয়ারও। শিক্ষক তার সম্মান রক্ষা করতে পারছেন না। শিক্ষকদের যে তিনটি ‘ভালোবাসার’ কথা উল্লেখ করলাম, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তার করুণ অনুপস্থিতি অন্যদের মাঝে। শিক্ষার চাইতে, শিক্ষার্থীর চাইতে তাদের কাছে নিজ স্বার্থ, নিজ চেয়ার বড়। তাদের অনেককে দেখি তোষামোদিতে, চাটুকারিতা ও ব্যক্তি বন্দনায়। বন্দনা ভালো, তবে তারও তো একটি সীমা-পরিসীমা থাকা চাই।
৩) কী দেখছি আমরা এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীরা উপাচার্য অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবি করে অনশনে যায় এবং ঘোষণা দেয় যে তিনি (উপাচার্য) পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আন্দোলন ছিল, যদ্দুর জানি শান্তিপূর্ণ। ভাইস চ্যান্সেলর শিক্ষক হিসাবে, মুরুব্বি হিসাবে পারতেন ছাত্রদের কথা শুনতে। কিন্তু তিনি ডাকলেন পুলিশ। পেটালেন নিজ শিক্ষার্থীদের। তাদের খাবার করে দিলেন বন্ধ। অবাক করা যে এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়াননি। এমনকী শিক্ষার্থীরা যখন অনশনে তখনও। অথচ উপাচার্যের জন্যে ওই শিক্ষকেরা দল বেঁধে খাবার নিয়ে আসেন। একবারও খোঁজ নিলেন না কেমন আছে তাদের শিক্ষার্থীরা। আরো অবাক করা দেশের ৩০ না ৩৫ জন ভিসি একজোট হয়ে পদত্যাগ করার হুমকী দেন। সেলুকাস। সত্যি বিচিত্র এই দেশ। শিক্ষক সমিতির দু-একজন শিক্ষক এসেছেন, সেটা শুধুমাত্র মর্নিং-ওয়াকের সময়। তারা এসেছিলেন, দেখে গেছেন। কেবল একজন এসেছিলেন, যাকে এর আগেও নানা দুর্যোগ পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি এসেছিলেন তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকসহ। তারা শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গ করিয়ে দেশ ও জাতিকে এক মারাত্মক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন।
ফিরে যাই অতীতে। এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি-হামলা চালালে প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। ভিসিদের এমন ইতিবাচক নজিরও আছে। সমপ্রতি ঢাকার এক দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীর সুযোগ্য কন্যা, অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘তিনি (অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী) মনে করেছিলেন যে, ‘আত্মসম্মান নিয়ে তার পক্ষে সেখানে আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। আত্মসম্মানটা তার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল। কারণ, তিনি আপাদমস্তক একজন শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকরা যখন প্রশাসনে যাবেন, তখন তাকে শিক্ষকসুলভ মনোভাবটাও রাখতে হবে। কিন্তু, বর্তমানে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রের সঙ্গেই বৃহত্তর রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে, হচ্ছে। যখন শিক্ষকসুলভ মনোভাব হারিয়ে যায় এবং বৃহৎ রাজনীতির দিকে বেশি ঝুঁকে যায়, তখন কোনো প্রশাসনের পক্ষেই নিরপেক্ষ বা কিছুটা নিরপেক্ষ হওয়াটা দায় হয়।’ একই আলাপচারিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অনেকটা উত্তাল ছিল। রাজনীতি, সন্ত্রাস, ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মারামারি লেগে ছিল। কিন্তু, সেই সময়ে ভিসিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠেনি। তখন সমাজে পরিস্থিতি উত্তাল হলেও মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়নি। মূল্যবোধের অবক্ষয় মারাত্মক জিনিস। এখন যে অবস্থা, যার যে ক্ষমতা আছে, তা ব্যবহার করা। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার লোভে যা কিছুকেই প্রশ্রয় দেওয়া এখন সমাজের রোগ হয়ে গেছে। এই যে মূল্যবোধের অবক্ষয়, এটাই সমাজকে শেষ করেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রমিত হয়েছে, সংক্রমিত হয়েছে উপাচার্যের চেয়ারও।’
দেশের শীর্ষ শিক্ষাপীঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে বিশিষ্ট সাংবাদিক গোলাম মোর্তাজার পরামর্শ ভালো লেগেছে। তিনি বলেন, “সরকার যদি সত্যি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, তাহলে সমস্যা কী সেটা আগে অনুধাবন করতে হবে। সেই অনুধাবনের প্রথম ধাপ হবে সরকারকে ‘দলীয় রাজনৈতিক নেতারূপী’ শিক্ষকদের ‘উপাচার্য-বানানোর-প্রকল্প’ থেকে বেরিয়ে আসা। চাকরি দিয়ে অর্থ নেওয়া, ক্যাম্পাসে না থেকে সুযোগ সুবিধা নেওয়া তথা আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে অভিযুক্ত অসৎ উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসন পরিচালনায় দক্ষ, আর্থিক-মানসিকভাবে সৎ ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সংবেদনশীল শিক্ষককে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে।’ সম্পূর্ণ সহমত কিন্তু মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন- আদৌ হবে কি?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজ্ঞান ও শিল্পের দেবী
পরবর্তী নিবন্ধসাইবার অপরাধের দুঃসহ গতিপ্রবাহ