হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া

| শনিবার , ২২ জুন, ২০২৪ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ডাচ কোয়ালিশন সরকার

গঠনে যত বিপত্তি : অবশেষে

ন্যাটো’র শীর্ষ পদ পাচ্ছেন

ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে

কথায় আছে ‘কম্বল ছাড়ি তো কম্বল আমারে ছাড়ে না’। ওলন্দাজ রাজনীতিতে কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতা হিসাবে পরিচিত খিয়ের্ট বিল্ডার্সের বর্তমান দশা অনেকটা তাই। একটা না একটা সমস্যা তার ক্ষমতায় যাবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তার দলের ক্ষমতারোহণ বিলম্বিত হচ্ছে। সাত মাস আগে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে মুসলিম ও ইমিগ্রেশন বিরোধী এই নেতা ও তার দল, ফ্রিডম পার্টি বিজয়ী হলো, যদিও বা এককভাবে সরকার গঠন করার মত আসন অর্জন করতে পারেনি। ডাচ রাজনৈতিক ইতিহাসে সেটি নূতন কোনো বিষয় না। উত্তর পাড়ের ছোট্ট কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অতি উন্নত এই দেশটিতে বরাবরই কয়েকটি বিজয়ী দলকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন হয়ে আসছে। স্বাভাবিক নিয়মে যে দলটি আসনানুপাতে অন্য দলগুলি থেকে এগিয়ে থাকে সেই দলের নেতা হন সরকার বা রাষ্ট্র প্রধান। সেই বিবেচনায় এবারের নির্বাচনে যেহেতু ফ্রিডম পার্টি জয়ী দলগুলির তালিকায় সর্ব প্রথমে সেই হেতু খিয়ের্ট বিল্ডার্সের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা। কিন্তু গো ধরলো তার সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করার জন্যে বাকি যে তিনটি ছোট ছোট দল আলোচনায় গেল তারা। তারা সবাই এক সুরে বললো, বিল্ডার্স যদি সরকার প্রধান হন, তাহলে আমরা সে সরকারে নেই। কেননা, তাদের ভাষায়, বিল্ডার্স ও তার দল যে উগ্র নীতিতে বিশ্বাস করে তাতে তাদের আস্থা নেই। বেচারা বিল্ডার্স দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলেন কবে আসবে সেদিন যেদিন প্রধান মন্ত্রীর আসন অলংকৃত করবেন। কিন্তু তরী যেন তীরে এসে প্রায় ডুবে গেল। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, ত্যাগ দিলাম। আমি প্রধানমন্ত্রী হবো না। তবু আমার দলের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠন হোক।’ ছয় মাসের দীর্ঘ সময় আলোচনা, পরামর্শ শেষে সরকার গঠন হলো। সবার মনে এক ধরনের স্বস্তি। কেননা একটি গণতান্ত্রিক দেশ চলছে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে সরকার ছাড়া। বিষয়টা গণতন্ত্রের জন্যে স্বাভাবিক না। যদিওবা গত সরকার ‘কেয়ার টেকার’ হিসাবে দেশ চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন কোয়ালিশনে মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগি হলো। স্বাভাবিক নিয়মে বিল্ডার্সের দল সব চাইতে বেশি মন্ত্রী পদ পেলো। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাজনীতির বাইরে থেকে এক দক্ষ আমলাকে মনোনীত করা হলো, যদিও বা এ নিয়েও নানা আলোচনাসমালোচনা উঠেছিল। সে সমস্যারও সমাধান হলো। ঠিক হলো নিয়মানুসারে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা দেশের রাজা উইলিয়ামের সাথে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার করবেন।

. সব কিছু ঠিকঠাক। দুয়ারে গাড়ি দাঁড়ায়ে। এমন সময় উঠলো আর এক ঝড়। খিয়ের্ট বিল্ডার্স আবারও সমস্যার মুখোমুখি হলেন। ডাচ গোয়েন্দা সংস্থা (আ ই ফেই দে) ‘ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিনিং’ করতে গিয়ে দেখতে পায়, কোয়ালিশন সরকারে উপ প্রধান মন্ত্রী হিসাবে বিল্ডার্স যাকে (গিডি মার্ক্সসভের) মনোনীত করেছেন তার সাথে ইসরাইলের গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদের যোগাযোগ রয়েছে। ফলে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকী, তাকে কিছুতেই সরকারের উচ্চ পদে বসানো যায়না। অবাক করা ব্যাপার যে দীর্ঘদিন ধরে ডাচ পার্লামেন্টে গিডি মার্ক্সসভের বিল্ডার্সের অনুগত ও আস্থাভাজন হিসাবে কাজ করেছেন। গেল বছর ডাচ পার্লামেন্টে তার অশোভন ও উগ্রবাদী মন্তব্যের জন্যে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন, এমন কী তার নিজের কট্টর রেডিক্যাল দলীয় সঙ্গীরা তার এই ধরনের মন্তব্যকে পছন্দ করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘হল্যান্ডের দিকে ‘আফ্রিকার জঙ্গল’ দল ধেঁয়ে আসছে।’ তিনি আফ্রিকীয় দেশ থেকে হল্যান্ডের দিকে আসা শরণার্থীদের লক্ষ্য করে এই মন্তব্য করেছিলেন। তার মত ব্যক্তিকে কোয়ালিশন সরকারে স্থান দেয়াকে অনেকে বিল্ডার্সের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ’ বলে আখ্যায়িত করেন। এখানেই শেষ নয় গিডি মার্ক্সসভের বাড়াবাড়ি। বিগত দিনে অস্ত্র বহন করার কারণে ডাচ পুলিশ তাকে একবার গ্রেপ্তার করে, যদিও বা এই নিয়ে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হয়নি। গিডি মার্ক্সসভের সম্পর্কে এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দলের নেতা বিল্ডার্স কী করে তাকে দলের মধ্যে এতো গুরুত্ব দিলেন এ নিয়ে সমালোচনা দেখা দেয়। দেরিতে হলেও এখন টনক নড়েছে বিল্ডার্সের। অনুমান করা হচ্ছে ডাচ গোয়েন্দা বিভাগ গিডি মার্ক্সসভের সম্পর্কে এমন কিছু সিরিয়াস তথ্য পেয়েছে যার কারণে বিল্ডার্স অবশেষে বাধ্য হয়েছেন উপ প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত তার দলীয় প্রার্থী গিডি মার্ক্সসভেরকে উইথড্র করতে। এক্স বা টুইটারে বিল্ডার্স লিখেছেন, ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেকে’ প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে তার প্রার্থিতা ফিরিয়ে নিতে হয়েছে।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘এই পদে এখন যাবেন ফ্রিডম পার্টির আর এক রাজনীতিবিদ, মারিওলিন ফাবের।’ এতে স্বাভাবিকভাবে ক্ষেপেছেন গিডি মার্ক্সসভের। তাকে সরানোর পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে মার্ক্সসভের দাবি করেন, কোন কারণ না দেখিয়েই তাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। এদিকে সংসদ থেকে তার পদত্যাগের দাবি উঠলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এখন দেখার বিষয় কোয়ালিশন সরকার কখন দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়। সব মিলিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা।

. ডাচ রাজনীতিতে যখন এই অস্থিরতা তখন উত্তর আটলান্টিক সামরিক জোট ‘ন্যাটোর’ শীর্ষ পদ পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে ছুটছেন পরপর তিনবারের ডাচ প্রধানমন্ত্রী, মার্ক রুতে। অকৃতদার, সুদর্শন এই ডাচ প্রধানমন্ত্রীর (বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান) পক্ষে ইতিমধ্যে ন্যাটোর ৩২ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সহ ২৭টি রাষ্ট্র তাদের সমর্থন দিয়েছে। এই পদের জন্যে মার্ক রুতেই একমাত্র প্রার্থী নন। এই পদের জন্যে দৌড়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস এবং এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী, কাজা ক্যালাস। কিন্তু দুজনেই দৌড়ে ক্ষান্ত দিয়েছেন, কেননা ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ হিসাবে মার্ক রুতের গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি তাদের চাইতে অনেক বেশি। সবচাইতে বড় কথা যুক্তরাষ্ট্রের নেক নজরে আছেন তিনি। কিন্তু হলে কী হবে। তাকে পছন্দ করেননা ন্যাটোর আর এক সদস্য রাষ্ট্র হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী, ভিক্টর ওরবান। ন্যাটোর এই শীর্ষ পদে কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোন সদস্যরাষ্ট্র আপত্তি জানালে তিনি সেই পদের জন্যে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। এটিই নিয়ম। মার্ক রুতে সবাইকে তার প্রার্থিতার পক্ষে আনতে সক্ষম হলেও ওরবানের সমর্থন পেতে সক্ষম হননি। ভিক্টর ওরবান প্রোরাশিয়ান হিসাবে পরিচিত এবং ইউক্রেনকে ইউরোপের সমর্থনদেয়াকে সমর্থন করেননা। অন্যদিকে ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে রুশবিরোধী এবং ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য দেবার পক্ষে। রুতের বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে কেউ কেউ বলেন, এর আগে ২০০৪ সালে হল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াপ দ্য হোপ স্ক্যাপার ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। তার আগে ছিলেন নরওয়ে ও ডেনমার্কের প্রার্থীরা। অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপ থেকে একজনকে এবার এই শীর্ষ পদে নিয়োগ দেয়া দরকার। যাই হোক, সব বাধা শেষে ডাচ প্রার্থী মার্ক রুতে আটকে যান যখন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী বেঁকে বসলেন। তবে সুখের খবর ওরবান তার মত পাল্টেছেন। দিন কয়েক আগে মার্ক রুতের সাথে তার (ওরবান) দীর্ঘ আলোচনা হয়। সমঝোতা হয় যে, মার্ক রুতে ন্যাটোর শীর্ষ পদ অলংকৃত করলে ইউক্রেনের ব্যাপারে তিনি হাঙ্গেরিকে কোন চাপ দেবেন না। ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিলে মার্ক রুতে তাতে হাঙ্গেরিকে যোগ দিতে বাধ্য করতে পারবেন না। রুতে সব শর্ত মেনে নেবার পর ওরবান রুতের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেন। অবশেষে ন্যাটো শীর্ষ পদে বসার জন্যে মার্ক রুতের সমস্ত বাধা দূর হলো। এখন দেখার বিষয় ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে তিনি রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন সমস্যার সমাধানে কী পদক্ষেপ নেন কিংবা কতটুকু সফল হন। ন্যাটোকে কতটা কার্যকর ও শক্তিশালী করে তুলতে পারেন। তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। কয়েক মাস বাদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং ন্যাটোর ব্যাপারে ট্রাম্পের নেতিবাচক মনোভাব কারো অজানা নয়। ক্ষমতায় আবার এলে ট্রাম্প ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির ওপর চাপ দেবেন যাতে তারা এই সংস্থার সদস্য হিসাবে তাদের দেয়া আর্থিক চাঁদার পরিমাণ বাড়ায়। একবার তিনি এই বলে মন্তব্য করেছিলেন যে, যে সমস্ত দেশ এই বাড়তি চাঁদা দেবে না, তাদের আক্রমণ করার জন্যে তিনি রাশিয়াকে উৎসাহিত করবেন। ‘আনপ্রেডিক্টেবল প্রেসিডেন্ট’ হিসাবে পরিচিত ট্রাম্পের পক্ষে সব কিছুই সম্ভব। ন্যাটোর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে সেটি দেখার জন্যে আমাদের আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিয়াল ফণী বড়ুয়া : সংগ্রামী জীবনের চেতনার প্রতীক
পরবর্তী নিবন্ধআল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)