হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৫ জুন, ২০২৪ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

গেল সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইউরোপের বাঘা বাঘা নেতারা ধরাশয়ী হলেন। এমন একটা ফলাফল হবে সে আগ থেকেই অনেকটা ধরে নেয়া হয়েছিল। এই নির্বাচন কট্টর ডান রেডিক্যাল দলগুলির জন্যে বয়ে আনে সুবাতাস, আনন্দ বার্তা। অন্যদিকে উদারপন্থী ও সবুজ অর্থাৎ গ্রীনদের জন্যে বয়ে আনে হতাশা, দুঃস্বপ্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে গত ৬ জুন থেকে ৯ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটাররা বাঘা বাঘা নেতা ও তাদের দল থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এই বাঘা বাঘা ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল মেক্রো ও জার্মানির চ্যান্সেলর ওলফ শুলজ। নির্বাচনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল ম্যাক্রোর রেনেসাঁ পার্টি মাত্র ১৫,% ভোট পেয়ে গোহারা হারলে, তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে আগাম জাতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেন। অন্যদিকে, জার্মান চ্যান্সেলরের দলের পরাজয়ের পর জয়ী দলগুলি আগাম নির্বাচনের দাবি করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে হল্যান্ডের ইসলাম ও মাইগ্রেন্টবিরোধী রেডিক্যাল নেতা খিয়ের্ট বিল্ডার্স ও তার দল, ফ্রিডম পার্টি পাঁচ বছর আগের অর্জিত একটি আসন থেকে এগিয়ে এবার ছয়টি আসন লাভ করে। তবে মন্দ করেনি ডাচ লেবার পার্টি ও গ্রিন পার্টি। তাদের মোর্চা ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আটটি আসন লাভ করে হল্যান্ডের সব চাইতে বড় দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির দৃশ্যমান উত্থান ঘটলেও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নিজেদের কর্তৃত্বে নেবার মত আসন তারা অর্জন করতে পারেনি। তবে এটি সত্যি পার্লামেন্টের নীতি নির্ধারণে আগামী দিনগুলিতে দলগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। ফলাফলে হতাশ নন ইউরোপীয় কমিশনের সিটিং প্রেসিডেন্ট, উরসুলা ভন ডার লেইন। তার মধ্যডানইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) এখনো শক্ত অবস্থানে রয়েছে, ইউরোপীয় সংসদের সবচেয়ে শক্তিশালী দল ইপিপি। ফলাফল ঘোষণার পর তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এটি নিশ্চিত আমরা তাদের (রেডিক্যাল ডান) থামাব।’ অনুমান করা হচ্ছে তিনি এ দফায়ও কমিশনের প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যাবেন। এবারের ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন নানা কারণে বেশ আলোচিত ছিল। সাধারণ জনগণের মাঝে ছিল বাড়তি আগ্রহ। আমার নিজের কথাই যদি ধরি, তাহলে বলতে হয় বিগত ৩৩ বছর ধরে ভোটাধিকার থাকলেও এই প্রথমবারের মত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ভোটে অংশ নিলাম। সামপ্রতিক বছরগুলিতে ভূরাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং আসছে প্রতিনিয়ত, যা প্রতিটি ইউরোপীয়কে কোন না কোনভাবে এফেক্ট করে। তাতে নাগরিক অধিকার খর্ব থেকে শুরু করে জলবায়ু, মাইগ্রেন্টসবিরোধী নীতিমালা, এন্টি ইসলাম ও এন্টিইউরোপ মনোভাবাপন্ন শক্তির উত্থান, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক এমন অনেক বিষয় রয়েছে। ফলে অন্যান্য বারের চাইতে এবার ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে উপস্থিতির হার ছিল বেশি। বেশি ছিল তরুণদের উপস্থিতিও।

. হল্যান্ডে নির্বাচন হয় ৬ জুন। নির্বাচনের শেষ দিন অর্থাৎ ৯ জুন আমন্ত্রিত হয়ে আমাকে যেতে হয়েছিল বেলজিয়াম। সেখানে আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু প্রফেসর ড. উইলিয়াম ফান দার গেইস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এক পার্টির আয়োজন করা হয় তার সবুজেঘেরা ব্যাকইয়ার্ড গার্ডেনে। তার স্ত্রী প্রফেসর ড. তাজিন মুর্শিদ। তার আর একটি পরিচয় রয়েছে। তার বাবা হলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, কূটনীতিবিদ ও লেখক অধ্যাপক সারওয়ার খান মুর্শিদ। অনুষ্ঠান হবে দুপুরে। একই দিন রাজধানী ব্রাসেলসসে আমার কিছু জরুরি কাজ ছিল। ইউরোপীয় প্রেস ক্লাবের পরিচালক লোরেন ব্রিহের সাথে একটা মিটিং হবার কথা ঠিক হয়ে আছে সপ্তাহ খানেক আগ থেকে। ঠিক করলাম একই দিন হলে সময় এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হবে। ইমেইল পাঠিয়ে রোববার লোরেন প্রেসক্লাবে থাকবে কিনা জানতে চাইলে উত্তরে সুদর্শন এই ইউরোপীয় জানায়, ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের কারণে গোটা দিন ধরে ক্লাবে নানা অনুষ্ঠান। পার্লামেন্ট সদস্যদের টিভি সাক্ষাৎকার, মিটিং ইত্যাদি চলবে ক্লাবে। অতএব, ছুটির দিন হলেও আমি ক্লাবে থাকবো, চলে এসো।’ একটা সময় আমিও এই ক্লাবের সদস্য ছিলাম। বছর কয়েক ধরে আর সদস্যপদ নবায়ণ করিনি। কেননা ওদিকে তেমন আর যাওয়া হয় না, কেবল অর্থের অপচয়। যাই হোক, আগামী ২৩ জুন ইউরোপীয় প্রেসক্লাবে ‘দক্ষিণ এশিয়ায় উগ্রবাদের পুনরুত্থান, হুমকি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সম্মেলন হবে। সম্মেলনের আয়োজক তিনটি ইউরোপীয় বাংলাদেশি মানবাধিকার সংগঠনইউরোপীয় বাংলাদেশ ফোরাম, গ্লোবাল সলিডারিটি ফর পীচ ও ইন্টারন্যাশনাল হিউমেন রাইটস কমিশন, সুজারল্যান্ড। লোরেনের সাথে বসার লক্ষ্য সম্মেলনপ্রস্তুতি বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা। ব্রাসেলসসে স্থায়ীভাবে থাকে স্নেহভাজন মোর্শেদ মাহমুদ। মোর্শেদকে বলে রেখেছিলাম সে যেন উপস্থিত থাকে প্রেস ক্লাবের ওই মিটিঙে। অনুষ্ঠানের সেও অন্যতম আয়োজক। ঠিক হলো দুপুর দুটোয় আমরা বসবো। হল্যান্ডে যে শহরে (দি হেগ) আমার বসবাস সেখান থেকে ব্রাসেলস প্রেস ক্লাবের দূরত্ব দুশো কিলোমিটারের মত। সময়মত, অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ের আগে উপস্থিত থাকা আমার অভ্যেস। তাই কিছুটা আগ বাড়িয়ে বাসা থেকে গাড়িপথে রওনা দেই। একটানা গাড়ি চালালে এবং ট্রাফিক জ্যাম না হলে, ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু মাঝপথে হল্যান্ডবেলজিয়াম বর্ডারে খানিক দাঁড়িয়ে কফি খাওয়ার কারণে সোয়া দুঘন্টা লেগে যায়। আমার সাথে সহধর্মিনী সুমনা। সাথে থাকলে সুবিধে এই, দীর্ঘ গাড়িপথে হাতবদল হয়। তাতে একজনের ওপর চাপ কিছুটা কম পড়ে। যদিওবা দুশো কিলোমিটার ইউরোপের জন্যে খুব একটা দূরেরপথ নয়।

সে দিন ছিল চমৎকার রৌদ্রস্নাত দিন। একেবারে ঝরঝরে, যেন হাত বাড়ালেই হাতে ধরা দেয় সোনালী রোদ্দুর। সুমনা থামলো হল্যান্ডবেলজিয়াম বর্ডারে এক ফিলিং স্টেশনে। স্টিয়ারিংয়ের হাত বদল হলো। কফি খেতে খেতে গাড়ি চলতে থাকে, দ্রুত হয় গাড়ির গতি।

. প্রেস ক্লাবের কাছে পৌঁছে পার্কিং খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগলো। ক্লাবের রিভলভিং কাচের দরোজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে কাউকে চোখে পড়ে না। একটু বাদে কোথা থেকে হাজির হলো ক্লাবের পরিচালক লোরেন। ঠিক তখনই এসে উপস্থিত মোর্শেদ মাহমুদ। জানালে, এই মাত্র সে ভোট দিয়ে এলো, পোলিং সেন্টারে বেশ ভিড়। অথচ হল্যান্ডে যে সেন্টারে ভোট দিতে গিয়েছিলাম, সেখানে মিনিট দুয়েকের মধ্যে ভোট দেয়া শেষ আমাদের। বেলজিয়ামের ভোট কেন্দ্রে ভিড় হবার কারণও রয়েছে। হল্যান্ডে যেখানে ভোট দেয়া, না দেয়ায় কোন বাধ্যবাধকতা নেই, সে ক্ষেত্রে বেলজিয়ামের আইন ভিন্ন। সে দেশে ভোট দেয়া প্রতিটি নাগরিকের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। ভোট না দিলে আর্থিক জরিমানা দিতে হবে। বেলজিয়ামে ১৮ বছর ও তার ঊর্ধ্বে যারা তাদের ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক, তবে এ বছর থেকে ১৬ বছর থেকে ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ বছর মাত্র ১০ দিন আগে টিনএজারদের ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক করাকে অনেকে সমালোচনা করেছেন। বেলজিয়ামে একটানা ১৫ বছরের মধ্যে যদিও কোন ভোটার চার বার কোন ভোট না দেন, তাহলে তার ভোটাধিকার হারাবার আশংকা রয়েছে। যাই হোক, যে হলটিতে অনুষ্ঠান হবে সেখানে প্রেসক্লাব পরিচালক, মোর্শেদ সহ গেলাম। অনুষ্ঠানের তাবৎ অনুষঙ্গ ঠিক আছে কিনা দেখে আমরা চা খেয়ে বেরিয়ে এলাম ক্লাব থেকে। মোর্শেদের পরনে কমপ্লিট স্যুট, চোখে ‘ফটোক্রমিক’ চশমা, নায়ক নায়ক ভাব। জিজ্ঞেস করি, কী ব্যাপার একেবারে সাহেব যে? উত্তরে হেসে বলে, প্রথমবারের মত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়েছিলাম তো, তাই। মোর্শেদের সাথে পরিচয় দশ/বার বছরের কম নয়। যখন তার সাথে পরিচয় তখন সে ছিল ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্লিন সেইভড’। এখন গালভর্তি দাড়ি। তার যে বিষয়টা ভালো লাগে তা হলো, সে ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। একাত্তরের জেনোসাইড, অসামপ্রদাযিক বাংলাদেশ ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে সোচ্চার। আমার দেখায় মোর্শেদ বন্ধুসুলভ ও নির্ভেজাল সৎ। তার যে অবস্থান তাতে অন্য কেউ হলে, নির্ধিদ্বায় বলতে পারি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতো। যে পরিচয় সে সহজে দিতে চায়না নিজ থেকে তা হলো সে হলো, বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদের সে সহোদর। দুপুর দুটো। মোর্শেদ আমাদের এগিয়ে নেয় বাংলাদেশি মালিকানায় এক রেস্তোরাঁর দিকে। সেখানেই লাঞ্চ সারা আমাদের। জোর করে সেই বিল চুকায়। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকি। সামান্য দূরে রাস্তার পাশেই গাড়ি পার্ক করা। মোর্শেদকে বিদায় দিয়ে আমরা এগিয়ে যাই রোডে সেন্ট জেনেসির দিকে, বেলজিয়ামের ছোট্ট একটি শহর। প্রেসক্লাব থেকে বিশ কিলোমিটার দূরত্বে। গাড়ি এগিয়ে চলে। বাইরে চমৎকার আকাশ। সামার সামার ভাব। তবে কখন যে মেঘ নেমে আসে তার কোন ঠিক নেই।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ : স্পেশাল নয়, চাই স্থায়ী ট্রেন
পরবর্তী নিবন্ধদ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন মাত্রিকতা