দেশ থেকে ফিরে এসে ঠিক করেছিলাম চট্টগ্রামের একমাত্র দৃষ্টিনন্দন ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ নিয়ে লিখবো। এই লেখা হয়তো হতোনা যদি সবার জন্যে এখনো উন্মুক্ত করে না–দেয়া এই এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠা এবং এই পথ ধরে গাড়ি চালিয়ে আসার সুযোগ না পেতাম। এই সুযোগ যিনি করে দিয়েছেন তিনি তার এক লেখায় এই এক্সপ্রেসওয়ের আগে একটি বিশেষণ যোগ করে একে ‘স্বপ্ন ছোঁয়া’ প্রজেক্ট হিসাবে উল্লেখ করেছেন। বিশেষণটি যে শতভাগ সঠিক তা টের পেলাম যখন ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে চাটগাঁ শহরের দিকে এগিয়ে না যেতাম। আর এটি সম্ভব হয়েছে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক দৈনিক আজাদীর চীফ রিপোর্টার হাসান আকবরের কারণে। দেশে এই প্রথম তার সাথে শহর থেকে কিছুটা দূরে কোথায়ও যাওয়া। যদিওবা বিদেশে অর্থাৎ ইউরোপে একসাথে একই গাড়িতে আমাদের কেবল দূরে নয়, অনেক দূরে যাওয়া হয়েছে। সে প্রায় এক দশক আগের কথা। গল্প করতে করতে আমরা হেগ শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ইউত্রেক শহর ঘুরে–বেড়িয়ে, সেখান থেকে গিয়েছিলাম বেলজিয়াম। নেপোলিয়ান ১৮১৫ সালের ১৮ জুন যে স্থানটিতে (যুদ্ধক্ষেত্র) পরাজয় বরণ করেছিলেন সেই ‘ওয়াটারলু’ (তখন এই স্থানটি ছিল হল্যান্ডের অধীনে) ঘুরে এসে সন্ধ্যের দিকে ফিরে এসেছিলাম হেগ শহরে। সেদিন একই গাড়িতে ছিলেন একুশে পদক প্রাপ্ত বরণ্যে সাংবাদিক, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, তার স্ত্রী কামরুন মালেক, সাংসদ এম আবদুল লতিফের স্ত্রী, চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুর্শেদ ইব্রাহিমের স্ত্রী, জাতীয় পার্টির প্রাক্তন এম পি মাহজাবিন মুর্শেদ এবং সহধর্মিনী সুমনা। আমি সহ আমরা মোট সাতজন, বাহন ছিল সেভেন–সিটার ওপেল জাফিরা। দুশো কিলোমিটার গাড়ি–পথ পাড়ি দিতে আমাদের দু ঘন্টার মত লেগেছিল। অর্থাৎ ঘন্টায় ১ কিলোমিটার।
দেশে এতটা দূরত্ব এত কম সময়ে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। তাই নয় কি? কিন্তু না, সেটি দেখলাম সম্ভব। কেননা পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে উঠে টাইগারপাস দিয়ে বের হয়ে আসতে আমাদের লেগেছিল মাত্র ১২ থেকে ১৩ মিনিট। অবশ্য তখন সেখানে অন্য কোন যানবাহন ছিলনা। পতেঙ্গায় যে কাজোপলক্ষে যাওয়া সে কাজ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে ফিরে আসার সময় হঠাৎ আকবর ভাই বললেন, ‘এত কাছে এসে এই এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধরে শহরের দিকে না গেলে তো নয়।’ ড্রাইভার ইব্রাহিমকে বলা হলো গাড়ি ঘুরিয়ে এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা পয়েন্টে যেতে। আমাদের সহযাত্রী ছিলেন আমার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সাংবাদিক সহকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম খান। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাক্তন পরিচালক। সেদিন ছিল চমৎকার রৌদ্রস্নাত দিন। সহনীয় তাপ। আমাদের গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে পতেঙ্গা পয়েন্টে গিয়ে পৌঁছুলে দেখি এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠার পয়েন্টে ব্যারিকেড দেয়া যাতে সাধারণ যানবাহন চলাচল করতে না পারে। সিকিউরিটির যে কর্মচারীটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন হাসান আকবর। ফোন করলেন সিডিএ–র উর্ধ্বতন কোন এক কর্মকর্তাকে। নিজের পরিচয় দিয়ে তার সাথে কথা বলে সিকিউরিটির কর্মচারীটিকে ফোন ধরিয়ে দিলে আমাদের গাড়ির যাবার রাস্তা খুলে দেয়া হয়। ড্রাইভার ইব্রাহিম সহ আমরা সবাই বেশ এক্সসাইটেড। সবার এই প্রথম এই এলিভেইটেড এক্সপ্রেস হয়ে শহরের দিকে যাওয়া। তার উপর তখন পর্যন্ত এই পথটি সাধারণ যানবাহনের জন্যে খুলে দেয়া হয়নি। কেবল এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করছে তেমন কিছু গাড়ি সেখানে চলাচল করছে মাঝে মধ্যে।
পতেঙ্গা! বঙ্গোপসাগরের একটি সমুদ্র সৈকত। চাটগাঁ শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে, কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে। ধারে–কাছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নেভাল একাডেমি ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এক সময় যখন চাটগাঁয় সাংবাদিকতা করতাম তখন মাঝে মধ্যে এই এলাকায় আসতাম। স্টিল মিল, ইস্টার্ন রিফাইনারি এমন আরো কয়েকটা প্রতিষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহে যেতাম। এবার অনেক বছর পর পতেঙ্গা এলাকার ভেতরের দিকটায় গেলাম। অনেক বদলে গেছে গোটা এলাকা। গাড়ি, মানুষের ভিড় বেড়েছে ভীষণভাবে। বাড়িঘর, দোকান–পাট গড়ে উঠেছে অনেক। যার কাছে আমাদের যাওয়া তার সাথে আমাদের কারো জানা–শোনা, পরিচয় নেই। কিন্তু তার সাথে জানাশোনা আছে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী স্থানীয় এক ব্যক্তি, নাম ওয়াহিদ হাসান। তিনি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন পতেঙ্গা থানার কাছাকাছি একটি স্থানে। আকবর ভাই ওনাকে ভালো চেনেন। গাড়ি থেকে নেমে আমরা পতেঙ্গা থানার ঠিক উল্টোদিকে আমাদের গন্তব্যস্থল একটি অফিসের দিকে এগুতে থাকি। পরিচয় হলো ওই অফিসের সেকেন্ড–ইন–কমান্ড, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুনতাসির মামুনের সাথে। সফল এই এন্ট্রেপ্রেনিউরের সাথে বিজনেস কার্ড বিনিময় হতে বলি, আপনার নামটা মনে থাকবে সহজে, কেননা বাংলাদেশের নামকরা ইতিহাসবিদ হলেন অধ্যাপক মুনতাসির মামুন। গেল বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আমাদের এক সম্মেলনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। যাই হোক, দীর্ঘ আলাপের এক পর্যায়ে মুনতাসির মামুন জানালেন তিনি হল্যান্ড সহ ইউরোপের বেশ ক‘টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তার কিছু বর্ণনাও দিলেন। আমার কাছে যেটি ভালো লাগলো তা হলো, তিনি প্রাগ, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া সহ যে কটি দেশের কথা বললেন, খেয়াল করলাম উনি সে সমস্ত দেশের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয়, ঐতিহাসিক স্থানগুলির বিশদ বর্ণনা দিচ্ছিলেন। দেশ থেকে অনেকেই বিশেষ করে মুনতাসির মামুনদের মত বিত্তবানরা ইউরোপ আসেন– কেউ কাজে কেউ বেড়াতে। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই ওই সমস্ত দেশে গিয়ে, ঐতিহাসিক স্থানগুলির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেন এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন। তারা দেশ ঘুরেন বটে কিন্তু সত্যিকার অর্থে দেশকে তাদের জানা খুব একটা হয় না বলে আমার ধারণা। মুনতাসির মামুন যখন চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগের ঐতিহাসিক চার্লস ব্রিজের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন আমার চোখের সামনে ভাসছিল বছর আট আগে আমার দেখা ওই ব্রিজটার কথা। প্রাগ শহরের এক তৃতীয়াংশ এলাকার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা ‘ভেলটাভা নদীর’ ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ৬২১ মিটার দীর্ঘ এই ব্রিজ। জানতে চাইলাম, এতো স্পষ্ট মনে আছে কী করে, আমার তো অত মনে নেই। মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি তো গেলাম গেল বছরের নভেম্বর মাসে।’ আমার ল্যাপটপ–ব্যাগে দুটো বই ছিল, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। দৈনিক আজাদী সম্পাদক ও একুশে পদক প্রাপ্ত বরণ্য সাংবাদিক এম এ মালেক অতি যত্ন করে ‘হল্যান্ড থেকে’ বইটি গেল বছর তার প্রেস থেকে প্রকাশ করে আমাকে ঋণী করেছেন। যাই হোক, তখন ছিল রোজার মাস। আমি ছাড়া সবাই রোজা রেখেছেন। তারপরও মামুন সাহেব বার কয়েক মানা করা সত্ত্ব্েও চায়ের অর্ডার দিলেন। বিদায় মুহূর্তে বই দুটো মামুন সাহেব ও ওয়াহিদ হাসান সাহেবকে দিয়ে বলি, ‘এখানে নানা দর্শনীয় স্থানের বর্ণনা আছে, আপনাদের ভালো লাগতে পারে।’ মামুন সাহেব ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘বইয়ে লেখকের অটোড্রাফ পেলে ভালো লাগে।’ কলম এগিয়ে দিলেন, এমন সময় আকবর ভাই বললেন, ‘খেয়াল ছিল না, আমার নূতন বইটা নিয়ে আসতে পারতাম।’ আমাদের ফিরে আসার পালা। মুনতাসির মামুন ও ওয়াহিদ হাসান, নিষেধ করা সত্ত্বেও লিফট বেয়ে আমাদের সাথে নিচে নেমে এলেন গাড়ি তক। ভালো লাগলো তার আতিথেয়তা। যে কাজের জন্যে যাওয়া তা কদ্দুর হবে জানিনে, তবে এক ধরনের ভালো লাগা নিয়ে আমরা ফিরে আসি।
গাড়িতে উঠেই আকবর ভাই ড্রাইভার ইব্রাহিমকে গাড়ি ঘুরিয়ে পতেঙ্গা পয়েন্টের দিকে যেতে বলেন। বলেন, ‘এতদূর এসে সদ্য নির্মিত এই এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ে না দেখে ফিরে যাই কী করে। চলেন আমরা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকি।’ এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধরে যখন আমাদের গাড়ি শহরের দিকে এগিয়ে চলছিল তখন মনে হচ্ছিল আমরা ইউরোপের কোন এক হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলেছি। গাছ–গাছালি ঘেরা প্রাণের নগরী চট্টগ্রামকে ভূমি থেকে উঁচুতে তৈরি এই এক্সপ্রেসওয়ে থেকে দেখার মাঝে এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করছিলো। ভালো লাগছিলো এই ভেবে চট্টগ্রামের এই প্রথম এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামকরণ করা হয়েছে ভূতপূর্ব মেয়ের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে। এই নামকরণের মধ্যে দিয়ে সিডিএ কর্তৃপক্ষ তার প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেছেন, কেননা চট্টগ্রামের স্বার্থরক্ষায় তার (মহিউদ্দিন চৌধুরী) মত ত্যাগ, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা আর অন্য কোন মেয়র কিংবা চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে যে ছিলনা কিংবা নেই, সে তার শত্রুও স্বীকার করবেন। কর্ণফুলীর পাশ ঘেঁষে তৈরি নতুন রাস্তাটা হবার আগে এয়ারপোর্ট থেকে চাটগাঁ শহর পৌঁছুতে আড়াই–তিন ঘন্টা লেগে যেত। সেটি এখন কমে ৪৫ মিনিটে নেমে এসেছে। আর সেদিন ‘স্বপ্ন–ছোঁয়া’ মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধরে শহরে পৌঁছুতে আমাদের লাগলো মাত্র ১২–১৩ মিনিট। যানবাহন চলাচল শুরু হলে ১৬/১৭ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। আমরা যেদিন এলাম তখন এক্সপ্রেসওয়ের দু–পাশে বিদ্যুৎ বাতি লাগানোর কাজ চলছিল। চলছিল কিছু বাকি টুকটাক কাজ। আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে। আকবর ভাই ফেরার সময় সামনের সীটে বসেছিলেন মোবাইলে ভিডিও করার জন্যে। মাঝপথে এসে গাড়ি থামিয়ে আমরা তিন জন ছবি তুলি। আমাদের ছবি তুলে চালক ইব্রাহিম। আকবর ভাই তাকে বলেন, আপনিও আসেন, আপনার ছবি তুলে দেই। ফেরার পথে গাড়িতে বসা শফিকুল আলম খান আক্ষেপ করে বলেন, বাংলাদেশের এই যে দৃশ্যমান উন্নয়ন তা আমাদের অনেকে দেখেও না দেখার ভান করেন। তারা স্রেফ সমালোচনার জন্যে সমালোচনা করেন। অথচ তারাও এই উন্নয়নের ‘বেনিফিশিয়ারি’। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মনে মনে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট