চর্ম–বর্ণে নির্ভর করে মানুষের আচরণ
সুইজারল্যান্ডের ‘অভিবাসী’ সম্মেলন থেকে ফিরে এসে
বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া
মানুষের গায়ের রং কেমন তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। পশুর ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন নেই। সে কালো হোক আর ধলো কিংবা অন্য কোন বর্ণ, পশুর ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। যত সমস্যা মানুষের ক্ষেত্রে। মুখে বলি বটে ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙা।’ কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি। দেখি বিয়ে করতে গিয়ে পাত্র, পাত্রীর গার্জেন সবাই খোঁজে উজ্জ্বল বর্ণের পাত্রী। জন্মের পর ছেলে–মেয়ের গায়ের রং কেমন, ফর্সা না কালো কিংবা মন্দা হলো কিনা সেটিই অনেকেই প্রথমে জিজ্ঞেস করে জানতে চান। ইউরোপে পরিস্থিতি ভিন্ন। গায়ের বর্ণ বাদামি করতে সূর্যের দিকে মুখ বাড়িয়ে কিংবা উপুড় হয়ে ঘরের উঠোনে কিংবা সমুদ্র সৈকতে গায়ে বডি লোশন লাগিয়ে ঘন্টার ঘন্টা তাদের শুয়ে থাকতে দেখা যায়, সূর্যের দেখা মিললে। তবে মজার ব্যাপার হলো, নিজের গায়ের চামড়া কিছুটা কালো বা বাদামি যা এরা বলেন ‘ব্রাউন’, করার জন্যে মরিয়া হলেও, নিজের দেশকে ‘কালো–আদমী’ থেকে সাত হাত দূরে রাখতে চান তারা। কালো বর্ণের মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত ইউরোপে। তাদের কথা– ইউরোপ ইতিমধ্যে ‘কালোয়‘ ভরে গেছে। আর কালো চাই না।
কেবল চর্মের বর্ণের কারণে যে ইউরোপ যুদ্ধ–বিদ্ধস্ত, যুদ্ধলিপ্ত দেশ থেকে ছুটে আসা শরণার্থীদের প্রতি ভিন্ন আচরণ করে তেমন অভিযোগ উঠেছে গেল সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে অনুষ্ঠিত ‘অভিবাসী’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। চারদিন ব্যাপী এই সম্মেলনে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১২০ সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৫০০ সরকারি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি। সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন, আফ্রিকা থেকে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, হানাহানি এড়াতে যে সমস্ত ভাগ্যাহত মানুষ ইউরোপের দিকে ছুটে আসছেন প্রতিদিন, তাদের প্রতি সামান্যতম মানবিক আচরণ করা হয়না। এমনও দেখা গেছে সমুদ্রে ভাসমান নৌকা ও ট্রলার থেকে ইতালি ও আরো কয়েকটি দেশের নৌ–সেনা সদস্যরা সমুদ্র থেকে উদ্ধারের পরিবর্তে তাদের পানির দিকে ছুঁড়ে মারছে। অন্যদিকে সম্মেলনে প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে দু–হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে হল্যান্ড সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ। তাদের গায়ের বর্ণ ও ধর্ম যে একই। হল্যান্ডেই কেবল আশ্রয় পেয়েছেন প্রায় এক লক্ষ ইউক্রেনীয়। ইউরোপ এই সমস্ত ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের কেবল থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা যেন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন তার জন্যে স্থানীয় ভাষা শিক্ষা সহ, স্কুলে যাবার ব্যবস্থা, আবাসন ইত্যাদি আয়োজন করেছে। এমন কী তারা যেন সারাদিন বসে না থেকে কাজ করে আয় করতে পারেন তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এমনই যখন অবস্থা তখন এখানে আফ্রিকীয় দেশ কিংবা আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক ইত্যাদি অনুন্নত দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের অনেককে মানবেতর জীবনযাপন করতে দেখা যায়। হল্যান্ডের কোন কোন শহরে এই সমস্ত শরণার্থীদের থাকার জন্যে অব্যবহৃত বিল্ডিংয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প বানাতে চাইলে স্থানীয় ডাচ জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সরকারকে সে উদ্যোগ থেকে সরে আসতে বাধ্য হতে হয়।
জেনেভা সম্মেলনে অভিবাসীদের নানা সমস্যার কথা উঠে আসে। তবে বাস্তব চিত্র হচ্ছে ইউরোপীয় ও উন্নত দেশগুলি এই বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। তারা মুখে বলেন বটে অনেক কিছুই কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এমনকী এই ইস্যুতে সিভিল সোসাইটির সক্রিয় অংশ গ্রহণও তারা খুব একটা খোলা–মনে নিতে পারছে না। জেনেভায় গত ২২–২৫ জানুয়ারি যে সম্মেলন (গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট বা সংক্ষেপে জি এফ এম ডি) হয়ে গেল তাতে, আগেই উল্লেখ করেছি সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ১২০ জন। অথচ প্রতিবছর এক একটি দেশে অনুষ্ঠিত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৫০ সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। যে দেশে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সে দেশ হয় এই বিশাল যজ্ঞের আয়োজক ও চেয়ারম্যান। এবার সম্মেলন সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হলেও চেয়ারম্যান ছিল ফ্রান্স। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো (জার্মানি ব্যতিক্রম) ফ্রান্স চায় শরণার্থী যেন ইউরোপ–মুখী না হয়। শরণার্থীদের পক্ষে সোচ্চার সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলি ও তার প্রতিনিধিরা। এই প্রক্রিয়ায় তাদের প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে ফ্রান্স বললো, তারা ১২০ জনের বেশি সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধি গ্রহণ করবে না। পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত দুদিন–ব্যাপী ‘সিভিল সোসাইটি ডে’ পরিচালনা করার দায়িত্বে রয়েছে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট এক ইন্টারন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি বা আই এস সি। আমার সৌভাগ্য সেই কমিটির একজন সদস্য হিসাবে কয়েক বছর ধরে কাজ করার। জিএফএমডির যাত্রা শুরু ২০০৭ সালে, বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসসে। ফি–বছর এক একটি দেশে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যে সমস্ত দেশে এই পর্যন্ত এই আন্তর্জাতিক অভিবাসী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা হলো: বেলজিয়াম ২০০৭, ফিলিপাইন ২০০৮, গ্রীস ২০০৯, মেক্সিকো ২০১০, সুইজারল্যান্ড ২০১১, মরিশাস ২০১২, সুইডেন ২০১৪, তুরস্ক ২০১৫, বাংলাদেশ ২০১৬, জার্মানি ২০১৭, মরক্কো ২০১৮, একুয়াডোর ২০১৯ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০২০ (কোভিডের কারণে অনলাইন)। ইন্টারন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য হিসাবে আমার সুযোগ হয়েছিল এর প্রতিটিতে যোগ দেবার। বাংলাদেশে থাকার কারণে কেবল ২০১৪ সালে সুইডেনে উপস্থিত থাকতে পারিনি। যাই হোক, আমরা সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে অনেক দেনদরবার করলাম ফরাসী সরকারের সাথে, যাতে সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানো হয়। কিন্তু ফরাসি সরকার বললেন, ১২০ জনের বেশি কোনভাবেই নয়, এমন কী ১২১ জনও নয়। তারা যুক্তি দেখালেন জেনেভায় এতো অধিক সংখ্যক প্রতিনিধিদের এক করার জন্যে উপযোগী বড় হল নেই। কথাটি অনেকটা সত্য, তা পরে যখন উপস্থিত হলাম তখন টের পেলাম। জাতিসংঘ ভবনের অনতিদূরে এই বড় আকারের হল। জেনেছি সুইজারল্যান্ডের মধ্যে এটিই সব চাইতে বড় হল। তাতেও আমাদের আপত্তি বা সমস্যা ছিলনা। আমাদের ক্ষোভ তখনই দেখা দিল যখন দেখি ফরাসি সরকার এতদিনকার প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে বললো, মূল অনুষ্ঠান ছাড়া সরকারি অনুষ্ঠানে কেবল মাত্র দু–জন সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধি উপস্থিত থাকতে পারবেন, বাকিরা কেবল দর্শক, এমন কী মূল হলের ভেতরও প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। এতে ক্ষিপ্ত হলাম আমরা সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিরা। অবশ্য দেখা গেল পরবর্তীতে মূল হলের গ্যালারিতে সবাইকে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয়া হলো। মজার ব্যাপার হলো, দেখা গেল উদ্বোধনী দিনের পর থেকে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সরকারি প্রতিনিধিদের অনেকেই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত। তাদের অনেকেই ব্যস্ত সুইজারল্যান্ড দেখা ও শপিং করায়। ফলে বড় বড় হলগুলি রইলো ফাঁকা, উপস্থিতির সংখ্যা কম। যা খুব একটা শোভন ছিল না। তখন সরকারি আয়োজকরা সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিদের হলের ভেতর এসে অংশ নেবার জন্যে অনুরোধ জানাতে শুরু করলো।
এদিকে ফরাসি সরকারের দাবি আমাদের মেনে নেয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। কেননা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ১২০ প্রতিনিধিদের প্লেন ভাড়া, ৫–দিন হোটেল থাকা, ১৫–২০ হাজার টাকা জনপ্রতি হাত খরচ– সব মিলিয়ে বিশাল ব্যাপার। আর এর পুরোটাই অনুদান হিসাবে সিভিল সোসাইটিকে দিয়েছে ফরাসি সরকার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার। ফরাসি সরকার দিয়েছে ২ লক্ষ ইউরো অর্থাৎ প্রায় আড়াই কোটি টাকার বেশি, আর আরব আমিরাত দিয়েছে ৫০ হাজার ইউরো অর্থাৎ প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকা। অর্থের জন্যে কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হলে যে দাতার শর্ত মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না, সে বিষয়টি জেনেভায় সিভিল সোসাইটি সম্মেলনের দিন বক্তব্য রাখতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলাম এবং পরামর্শ দিয়েছিলাম আর্থিক অনুদানের জন্যে কেবল সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে প্রাইভেট ফাউন্ডেশনের দিকেও তাকানো দরকার। আশা করি আগামী সম্মেলনে, যেটি দক্ষিণ আমেরিকার কলোম্বিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে আমাদের তা করতে হবে। কেননা বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের অধিকার রক্ষা ও তাদের সম্মানজনক অবস্থানের জন্যে ২০০৭ সালে শুরু হওয়া এই আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মটিতে সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলির সক্রিয় উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ নিতান্ত প্রয়োজন। অভিবাসীদের কথা, তাদের সুখ–দুঃখের কথা উন্নত বিশ্বের সরকার বলবেন না, তারা বলছেন না। তারা কেবল চাইছেন কী করে উন্নত দেশগুলি, তথা ইউরোপ–আমেরিকা আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া থেকে প্রতিদিন পঙ্গপালের মত ধেঁয়ে আসা শরণার্থীদের ঠেকাতে পারেন সেই ব্যবস্থা নিতে। বলা বাহুল্য, অভিবাসন বা মাইগ্রেশনকে যদি দক্ষভাবে ‘ম্যানেজ’ করা যায় তাহলে তা যে ‘হোস্ট–দেশের’ আর্থিক উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর সেটি করার জন্যে আমাদের এই প্রচেষ্টা। (আগামীতে সমাপ্য)।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট