হল্যান্ড থেকে

বই পড়ুন, কিনুন এবং বই উপহার দিন

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৪ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বই পড়ার নেশা কবে, কে আমার ভেতর ঢুকিয়েছিল জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে এখন তা আর সঠিক মনে করতে পারছিনে। তবে এইটুকু হলফ করে বলতে পারি যে স্কুল বয়স থেকেই বইপড়ার নেশা মাথার মধ্যে ঢুকেছিল। সাথে টুকটাক লেখালেখির অভ্যেসও। কলেজিয়েট স্কুলে যাবার আগে ক্লাস সেভেন তক পড়েছিলাম বাসার অনতিদূরে এনায়েত বাজারের কাছাকাছি রেলওয়ে হাই স্কুলে। ছেলেমেয়ে আমরা সবাই একসাথে পড়তাম। সি আর বি সংলগ্ন রেলওয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হাতের বাদিকে যে ছোট্ট রাস্তা রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনির মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মিশেছে এনায়েত বাজার রাস্তায়, ঠিক সেখানেই চারদিকে উঁচু দেয়ালের ভেতর ছিল আমাদের এই ছিমছাম একতলা স্কুল। সামনে বড় মাঠ। সে মাঠে ফিবছর হতো বার্ষিক প্রতিযোগিতা। সে প্রতিযোগিতায় থাকতো খেলাধুলা ছাড়াও রচনা, কবিতা, গল্প। ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি সে বছর স্কুলের বার্ষিক রচনা প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। নিজ থেকেই সিদ্ধান্ত নেই তাতে অংশ নেবার। ক্লাস সেভেনের এক ছাত্রের পক্ষে দুঃসাহস বটে। ফলাফলে দেখা গেল ক্লাস টেনে পড়ুয়া স্কুলের সব চাইতে সুদর্শনা মেয়েটি (নাম মনে করতে পারছিনে) প্রথম হলো এবং আমি হলাম দ্বিতীয়। বার্ষিক অনুষ্ঠানের দিন উপহার হিসাবে পেলাম একটি বই। কোন এক মনীষীর উপর লেখা। সেই বই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বছর সাড়ে তিনেক চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা করার পর ঢাকা চলে যাবার আগ পর্যন্ত সযত্নে রাখা ছিল বাসার ছোট্ট একটি আলমারিতে। এরপর কোথায় যে সেই বই হারিয়ে গেছে তার হদিস আর পাইনি। মনেও ছিলনা। সেই বইটির কথা মনে এলো আজকের এই লেখা লিখতে গিয়ে। স্কুলের সেই দিনটি আমার কাছে আরো একটি কারণে স্মরণীয়। কেননা সেদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে গানও গাইলাম। অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগে স্কুল থেকে আমাকে বলা হলো স্কুলের সিনিয়র ছাত্রী, সবিতা চৌধুরীর কাছে গিয়ে গানটির তামিল নিতে। সবিতাদি গান গাইতেন। ওনার বাবা ছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সংগীত শিক্ষক অনিল চৌধুরী। সুদর্শন এই সংগীত শিক্ষক চাকরি করতেন রেলওয়েতে। দিদির (মাধুরী) জন্যে বাবা ওনাকে রেখেছিলেন গানের শিক্ষক হিসাবে। অনিল বাবু বিকেলের দিকে আমাদের বাসায় আসতেন দিদিকে গান শেখাতে। মা তার জন্যে আয়োজন করতেন ঘরেবানানো বিশেষ খাবার। যাই হোক, সেই যে আমার স্কুলমঞ্চে উঠে গান গাওয়া, এরপর আর দ্বিতীয়বার ওমুখো হইনি। আসলে হবার মত গুণ ছিলনা বলে হয়তো। সবার পক্ষে তো আর সবকিছু হয়ে উঠেনা। তবে বোধকরি বাবার ধারণা ছিল ভিন্ন। এর বছর খানেক পর দিদির বিয়ে উপলক্ষে আমরা সবাই গ্রামের বাড়িতে দিন কয়েকের জন্যে গিয়েছিলাম। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, নাইওরিদের আনাগোনা, হই চই। তখনকার দিনে বিয়ে, মেলা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ঘটা করে মাইক বাজানো হতো। রাতভর চলতো গান। লতা, হেমন্ত, সতীনাথ, সন্ধ্যা এদের গানই বাজানো হতো বেশি। জগন্ময় মিত্রের অতি জনপ্রিয় দুই পর্বের গান, ‘চিঠি’ (তুমি আজ কত দূরে..) তখন খুব বাজানো হতো। মাইক লাগানো হতে বাড়ির সামনে বা পেছনে উঁচু গাছের একেবারে মগডালে, যাতে গোটা গ্রাম ছাড়িয়ে আশপাশ গ্রাম থেকেও শোনা যায়। দিদির বিয়ের সময় আমাদের বাড়িতেও লাগানো হলো মাইক। সন্ধ্যের দিকে বাবা ডেকে বললেন, ‘যা, স্কুলে যে গানটি করেছিলি সেটি আবার কর’। উৎসাহে দৌড়ে গেলাম মাইকওয়ালার কাছে। বাবার কথা বললে মাইকের গান বন্ধ করে আমাকে ধরিয়ে দিলো। অতি উৎসাহে গলা ছেড়ে গাইলাম আবদুল আলীমের একটি জনপ্রিয় গান, ‘ঢেউ উঠেছে সাগরে, কেমনে ধরি পাড়ি রে….’। সেই আমার শেষ গানগাওয়া, কোন অনুষ্ঠানে।

যে কথা লিখতে বসা। লিখতে বসেছিলাম ‘বই’ নিয়ে। স্কুলবয়স থেকে খুব বই পড়তাম। আমরা যাকে বলি ‘বাইরের’ বই, পাঠ্যবই নয়। পাঠ্যবই সে নেহায়েৎ পরীক্ষায় পাশ দিতে হবে বলে এবং বাবার ভয়ে। কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হবার পর বাইরেরবই পড়ার নেশা বাড়তে থাকে। মনে পড়ে প্রতিদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে এসে, দুপুরের খাবার খেয়ে হেঁটে রওনা দিতাম আজকে যেখানে শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে তার ঠিক উল্টোদিকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের উদ্দেশ্যে। মাঝে দোতালা ইনস্টিটিউট, তার দুপাশে দুটি চমৎকার দৃষ্টিনন্দন লাইব্রেরি। মুসলিম ইনস্টিটিউটের গেইট গলিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ডানদিকে পাবলিক লাইব্রেরি আর বাদিকে ছিল পাকিস্তান কাউন্সিল। পাকিস্তান কাউন্সিলের পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী দিলারা জামানের স্বামী, হ্যাংলাপাতলা গড়নের ফখরুজ্জামান চৌধুরী। দুটো লাইব্রেরির মধ্যে বই কালেকশনের বিবেচনায় পাবলিক লাইব্রেরি ছিল অনেক সমৃদ্ধ। প্রতিদিন দুপুরে মৃদুপায়ে প্রবেশ করতাম অতি ছিমছাম পাবলিক লাইব্রেরিতে। ভেতরে পিনপতন নীরবতা। কোন শব্দ নেই, কারো সাথে কারো কথাবার্তা নেই। সবাই মাথা নীচু করে পড়ে চলেছে। কেউ কেউ রেফারেন্স বই থেকে নোট টুকে নিচ্ছে খাতায়। আমার লক্ষ্য গল্পের বই। শরৎচন্দ্র, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, বিমল মিত্র থেকে শুরু করে মাইকেল মধুসুধন দত্ত হাতের কাছে যা পেয়েছি তাই পড়েছি। বাদ পড়েনি দস্যু বনহুর আর দস্যু বাহরাম সিরিজও। মাসুদ রানা সিরিজ তখনও পড়ার বয়স হয়নি বলে পড়িনি। তবে এর বেশ কটি পড়েছি তারও অনেক পর। বই পড়া শেষ হোক আর না হোক একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাসায় ফিরে আসতে হতো। যেখানেই থাকিনা কেন সন্ধ্যের সময় বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পোস্টে বাতি জ্বলে উঠার আগে ঘরে ফেরা চাইএ ছিল বাবার অলিখিত নিয়ম। তিনি বলতেন, ‘ভদ্রলোকের ছেলেরা সন্ধ্যের পর ঘরের বাইরে থাকে না’। আর আমাদের সময় তো মেয়েদের বাইরে তো দূরের কথা, ঘরের সামনে যে বড় মাঠ সে মাঠেও বের হবার রীতি প্রচলন ছিল না।

যাই হোক, কয়েক ঘন্টায় তো আর শুরুকরা কোন বই শেষ হতো না। যেটুকু পড়েছি সেপৃষ্ঠায় ভাঁজ দিয়ে তা নির্দিষ্ট তাকে না রেখে লাইব্রেরির ভিন্ন একটি তাকে রেখে দিতাম, যাতে পরদিন এসে সেই বইটা পাই। এইভাবে প্রতিদিন স্কুল ফিরে এসে বইগুলি টেবিলে রেখে, তড়িঘড়ি করে মুখে কিছু গুঁজে দিয়ে অনেকটা দৌড় দিতাম পাবলিক লাইব্রেরির দিকে। এক সময় পাবলিক লাইব্রেরিতে আমার পছন্দের লেখকদের বই পড়া প্রায় শেষ। শুরু করলাম পাকিস্তান কাউন্সিলে যাওয়া। এইভাবে গোটা স্কুল বয়স কেটে গেল এক অন্ধ নেশার মত বইয়ের পেছনে। কলেজিয়েট স্কুলে যখন পড়ছি দিদির বিয়ে হলো গ্রামে। শহরে জন্ম ও বেড়ে উঠা দিদি গ্রামে (পিঙ্গলা) চলে গেল বেশ কয়েক বছরের জন্যে। সেই সময় বিয়েতে বই উপহার দেবার প্রচলন ছিল। দিদির শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমার কাজ হলো বিয়ে উপলক্ষে পাওয়া সমস্ত বই পড়ে শেষ করা। বই পড়তাম জানালার ধারে বসে আর দিদি বানিয়ে আনতো কখনো পিঠা, ডিম সেদ্ধ বা অন্যকিছু। দাদার বিয়ে হলো দেশ স্বাধীন হবার বছর কয়েক পর। বিয়ে অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন বড় বড় প্যাকেটে কী উপহার আছে তা খোলার জন্যে ব্যস্ত, তখন আমার ব্যস্ততা অনেকটা অবহেলায় একদিকে পড়ে থাকা বইয়ের স্তূপকে ঘিরে। এখন তো বিয়ে কেন, কোন জন্মদিনেও বোধকরি বই আর উপহার দেয়া হয়না। হল্যান্ডে বাংলাদেশ কম্যুনিটিতে প্রায় ফিসপ্তাহে কোন না কোন পরিবারে হয় বিয়েবার্ষিকী, নয় জন্মবার্ষিকী কিংবা অন্য কোন উপলক্ষে পার্টির আয়োজন হয়ে থাকে। বিগত ৩২ বছর হল্যান্ড অবস্থানে আজতক কখনো চোখে পড়েনি কাউকে উপহার হিসাবে বই দিতে। এমন কী শিশুদের জন্মদিনেও। সবাই দামি দামি উপহার নিয়ে আসেন, কার চাইতে কে বেশি দামি ও দর্শনীয় উপহার দিতে পারেন তার এক অলক্ষ্য ও পরোক্ষ প্রতিযোগিতাও দেখা যায়, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে। বাংলাদেশে বর্তমানে এই দৃশ্য ভিন্ন নয় বলে অনুমান করি। তবে আমার একটা জায়গায় সান্তনার ব্যাপার এই যে, আমার আত্মজা সপ্তর্ষির মধ্যে এই বইপড়ার নেশা ছোটকাল থেকে আজ অবধি খুব ভালোভাবেই প্রোথিত হয়ে আছে। আসলে এই অভ্যেস গড়ে তোলার বিষয়ও। আর এর জন্যে পরিবেশ, উদ্যোগ নিতান্ত প্রয়োজন।

আজকাল তো বই কেনা, বই পড়ার অভ্যেসও প্রায় উঠে গেছে। সুখের বিষয় চট্টগ্রামে সামপ্রতিক বছরগুলিতে এই ব্যাপারে বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে গড়ে উঠছে লেখক শ্রেণি, গড়ে উঠছে পাঠকও। এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম একাডেমির নাম উল্লেখ না করলেই নয়। একাডেমির কর্ণধার বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক রাশেদ রউফ। মৃদুভাষী এই কবি সাংবাদিক অনেকটা একক উদ্যোগে এই কাজটি নিভৃতে করে চলেছেন। নিভৃতেও বলা যাবে না। অনেককে জড়িয়ে, বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে তিনি বই পড়া, লেখালেখি, বইমেলার আয়োজন করে নবীনপ্রবীণদের উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। অনেক নবীন ও প্রতিভাবান লেখককে তিনি দৈনিক আজাদীর মত দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় স্থান দিয়েছেন। তাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। কারণ একজন নবীন লেখক যখন তার লেখা পত্রিকার পাতায় দেখেন তখন তার ভেতরে থাকে ভিন্ন অনুভূতি। তিনি আরো লেখার জন্যে অনুপ্রাণিত হন। এমন অনেককে জানি যাদের এই কবি সাংবাদিক সামনের সারিতে টেনে এনেছেন। বলা যায়, আজাদী লেখক সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে চলেছে। কিছু লিখতে গেলে পড়তে হয়, পড়তে গেলে বই হয় সংগ্রহ করতে হয়, নয়তো কিনতে হয়। চট্টগ্রাম একাডেমি এই বই পড়া ও কেনার অভ্যেস গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাঝে মধ্যে মূল্য ছাড় দেন। সেটিও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনে ‘বাতিঘরে’ গেলে ভালো লাগে। সেখানে কেউ কেউ বই কিনছেন, বই নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন, কেউ কেউ আবার বেশ সময় ধরে বই পড়ে চলেছেন। ভিন্নধারা এই বুকস্টলে প্রায়শ ভিড় থাকে বটে, তারপরও এই দৃশ্য ভালো লাগে। ভালো লাগার একটি স্থান, ‘বাতিঘর। তবে কখনোসখনো মনে হয়েছে কোন কোন তরুণতরুণী বাতিঘরকে তাদের মিটিংপয়েন্ট বানিয়ে তুলেছেন। তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বই দেখা বা পড়ার ভাণ করে দেদারসে কথা বলে চলেন লোভল্যুমে। তারপরও বলি, সেও ভালো বাইরে কোথায়ও আড্ডা না দিয়ে বইয়ের কাছাকাছিতো আছে। এই বা মন্দ কী! সবশেষে বলি, বই হোক আপনার আমার, আমাদের সকলের নিত্যসঙ্গী। বই কিনুন, বই পড়ুন এবং অন্যকে বই উপহার দিন।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রাথমিক শিক্ষায় নারী শিক্ষক গুরুত্ব
পরবর্তী নিবন্ধপরিশুদ্ধ রাজনীতিক মেধাবী উদ্যোক্তার পথিকৃৎ