হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

সকাল পৌনে দশটায় ফ্লাইট। দশটায় ফ্লাইট বটে কিন্তু উঠতে হবে ভোর সোয়া ছ’টায়। নিদেনপক্ষে ঘন্টা দুয়েক আগে এয়ারপোর্টে থাকা চাই। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠা আর হিমালয় পর্বতে উঠা এই দুয়ে কোন তফাৎ নেই আমার কাছে। হিমালয়ে হাজারো চেষ্টায়ও আমার উঠা হবেনা সে নিশ্চিত জানি, কিন্তু অনেক যুদ্ধ করে প্রয়োজনে খুব ভোরে ঘুম থেকে যে উঠতে পারিনে তা নয়। বাসা থেকে শিফল এয়ারপোর্টের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। গাড়ি, টেক্সিতে মিনিট চল্লিশে পৌঁছা যায়। দৌড়াদৌড়ি, টেনশন এড়ানোর জন্যে এয়ারপোর্টে আগ বাড়িয়ে উপস্থিত থাকা আমার সহজাত অভ্যেস। যুক্তি হলো ধীরে সুস্থে আগেভাগে পৌঁছে বসে কফি খাওয়া ভালো। গাড়ি নিয়ে গেলে সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ইউ নেভার নো। ট্র্যাফিক জ্যাম থাকতে পারে, গাড়ি বিগড়ে যেতে পারে, যদিও বা সাত সকালে ট্র্যাফিক জ্যামের সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। ফোনে টেক্সি অর্ডার দেব। ছেলেমেয়ে গিন্নী সবাই এক সুরে আপত্তি জানিয়ে বলে, তার কোন প্রয়োজন নেই। বাসা থেকে গাড়িতে ড্রপ দেয়া হবে হেগ সেন্ট্রাল রেল স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেনে আধ ঘন্টায় আমস্টারডাম এয়ারপোর্টের মাটির নিচে রেল স্টেশন। এস্কিলেটর বেয়ে উপরে এয়ারপোর্ট। দেরি হবার কোন সম্ভাবনা নেই। শেষ তক তাই হলো। ওদের কথাই মেনে নিতে হলো। ঠিক হলো সুমনা স্টেশনে আমাকে ড্রপ দিয়ে তার কাজে চলে যাবে। সাড়ে ছ’টায় বাসা থেকে বেরোলেও হতো, কিন্তু ওই যে আমার সহজাত স্বভাব, আগ বাড়িয়ে গন্তব্যস্থলে হাজির হওয়া। এবারের লক্ষ্যস্থলসুইজারল্যান্ড। পরদিন অর্থাৎ ১০ অক্টোবর জেনেভায় জাতিসংঘের সদর দফতরে বাংলাদেশের একাত্তরের জেনোসাইড ঘিরে ‘সাইড ইভেন্ট’। মূল ইভেন্ট, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ৫৪তম অধিবেশন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের এই অধিবেশন চলাকালীন সময়ে ‘সাইড ইভেন্টের’ নামে আয়োজন করে সম্মেলনের। তাতে মূলত বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়গুলি উঠে আসে, বক্তারা বক্তব্য রাখেন, দাবি জানান সরকারের কাছে, জাতিসংঘের কাছে। কিন্তু যাদের শোনার কথা, ব্যবস্থা নেবার কথা তারা কতটুকু শুনছেন বা আদৌ কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছেন কিনা সেটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়। এই ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন সরকারি প্রতিনিধি ছাড়াও বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিনিধিরা। তবে যে কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান চাইলেই জাতিসংঘ সদর দফতরের ভেতর এই ধরনের মিটিং বা সাইড ইভেন্ট করতে পারেনা। যে সমস্ত সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের বিশেষ স্ট্যাটাস বা ‘ইকোসক’ (ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল কাউন্সিল)-এর অধিকারী কেবল তারাই জাতিসংঘের ভেতর আলোচনা সভা বা অনুষ্ঠান করতে পারে। তেমনি ইউরোপবেইসড একটি সংগঠন আয়োজন করে বাংলাদেশের ওপর এই সম্মেলন। সাথে আরো তিনটি সহযোগী সংগঠন ছিল এই আয়োজনে। আর তাতে যোগ দেবার জন্যে আমার সুইজারল্যান্ড যাত্রা। আকাশপথে হল্যান্ড থেকে সুইজারল্যান্ড পৌঁছুতে সময় নেয় ঘড়ির কাঁটায় মাত্র এক ঘন্টা দশ মিনিট। প্লেন টেকঅফ করার পর চাকফি খেতে খেতে পৌঁছে যাওয়া হয় ‘ভূস্বর্গ’ বা ‘হ্যাভেন অন আর্থ’ হিসাবে পরিচিত সুইজারল্যান্ডে। কতজনের স্বপ্নের দেশ। দেশটির কোন সমুদ্র সৈকত নেই, কিন্তু রয়েছে অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে প্রাণভরে দেখার মত সবুজাভ প্রকৃতি, পাহাড়, পাহাড়ের গা ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া চমৎকার, চোখধাঁধানো রাস্তা, ছোট ছোট ট্রেন পাহাড় চিরে সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। অপূর্ব। ইউরোপ এসে সুইজারল্যান্ড বেড়িয়ে না গেলে ইউরোপের মূলআকর্ষণটা থেকে বাদপড়া। তাই এই ভুলটি করবেন না কখনো। আমার প্রথম আসা এই দেশটিতে খুব সম্ভবতঃ নব্বই দশকের প্রথম দিকে। এরপর অনেকবার আসা হয়েছে। বছরে কম করে হলেও বার দুয়েক যাওয়া হয়। কাজে ও বেড়াতে।

আর তাই, হল্যান্ড যদি হয় ‘সেকেন্ড হোম’, বলতেই হয় সুইজারল্যান্ড আমার ‘থার্ড হোম’। ভালো লাগার শহর জেনেভা, ‘গ্লোবাল সিটি’ হিসাবে পরিচিত জেনেভায় রয়েছে জাতিসংঘের সদর দফতর সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিস। এই শহরে রয়েছে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস, আই এল ও, ডব্লিউ টি ও, মানবাধিকার সংস্থা সহ আরো অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস। এই সমস্ত কারণে জেনেভাকে বলা হয় আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি ওয়ার্ল্ড সেন্টার। জেনেভা আমার প্রিয় শহরের অন্যতম এই কারণে, এই শহর অনেকটা নিরিবিলি, ঝামেলা নেই, রাতবিরোতে পথচলায় সমস্যা নেই, তার ওপর রয়েছে এর চমৎকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা। রয়েছে ট্রাম, বাস, ট্রেনের চমৎকার নেটওয়ার্ক। সব চাইতে মজার বিষয় হলো, এয়ারপোর্ট থেকে নেমে জেনেভা শহরে যেতে চাইলে আপনি টেক্সি বা বাস নিতে পারেন। তবে এয়াপোর্টের আন্ডারগ্রাউন্ড প্লাটফর্ম থেকে কিছুক্ষণ পর পর ট্রেন ছাড়ে জেনেভার দিকে। এর একটিতে চড়ে বসলেই হলো। ট্রেন জেনেভায় যাবে কিনা সে জন্যে নবাগতদের কোন দুশ্চিন্তা করতে হবেনা। কেননা সবকটি ট্রেন জেনেভা হয়েই অন্যদিকে এগিয়ে যাবে। এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে পরবর্তী স্টেশন হলো জেনেভা সেন্ট্রাল স্টেশন। অতএব জেনেভা স্টেশন মিস করার কোন সম্ভাবনা নেই। নিজের জ্ঞানের ওপর ভর করে একবার নিউ ইয়র্ক মাটির নিচের এক স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম। পরে দেখা গেল আমার নির্দিষ্ট স্টেশনে সেটি থামছে না। অনেকক্ষণ পর যখন থামলো তখন আমি আমার হোটেল থেকে অনেক দূরে। তড়িঘরি করে স্টেশন থেকে বের হয়ে উল্টোদিকে ট্রেন নেব, সেই ভরসা আর পাইনি। চলন্ত একটি ইয়োলো ক্যাবকে হাতের ইশারায় থামিয়ে শ’ খানেক ডলার খসিয়ে তবেই হোটেল পৌঁছা। সেই টেক্সী চালক ছিল এক বাংলাদেশি তরুণ। যাই হোক, বছর কয়েক আগেও জেনেভা এয়ারপোর্টে জেনেভায় যাবার জন্যে বিনে পয়সায় ট্রেনের টিকেট পাওয়া যেত। এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার মুখে যে দুটি অটোমেটিক মেশিন ছিল তার একটির নির্দিষ্ট বোতাম টিপলেই বেরিয়ে আসতো টিকেট। ইউরোপের আর কোন দেশে এই সুবিধাটি পাইনি, চোখে পড়েনি। তবে বছর কয়েক থেকে এই ফ্রিটিকেট দেয়ার মেশিন আর নেই। এখন গাঁটের পয়সা খরচ করে টিকেট কাটতে হয়। জেনেভায় আর একটি যে সুবিধা আছে পর্যটকদের জন্যে তা হলো, আপনি যে হোটেলে চেকইন করবেন, সে হোটেল থেকে আপনাকে শহরে বাস ট্রামে ঘুরে বেড়ানোর জন্য দেয়া হয় টিকেট। যেদিন চেক ইন করবেন সেদিন থেকে যতদিন হোটেলে থাকবেন ততদিনের জন্যে বিনে পয়সার এই টিকেট। ফলে বাস বা ট্রাম স্টপেজে গিয়ে সুইস ফ্রাঙ্ক খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না, কোথায় টিকেট পাবেন তার ভাবনাও থাকে না।

জেনেভায় আমার আছে একটি নির্দিষ্ট হোটেল। স্টেশন লাগোয়া। স্টেশন থেকে বেরিয়ে মিনিট চারেক হাঁটলেই হোটেল। নাম হোটেল ক্রিস্টাল। নয় তলার এই হোটেল সাইজে খুব বড় নয়। চমৎকার, ছিমছাম, পরিছন্ন। কামরায় টিভি, টেলিফোন, ওয়াইফাই, ওয়ারড্রোব থেকে শুরু করে একজনের থাকার যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে লেখালেখির জন্যে ছোট্ট টেবিল, টেবিল ল্যাম্প, চায়ের ছোট্ট কেতলি, আর ট্রেতে কয়েকটি টিব্যাগ, চিনি, কফি, দুধ ইত্যাদি। বাথরুমে থরে থরে সাজানো কয়েকটি টাওয়েল, সাবান, শ্যাম্পু। একজন পর্যটকের জন্যে এর চাইতে আর বেশি কী চাই।

যাই হোক, ফিরে আসি মূল বিষয়ে। একই হোটেলে উঠেছেন বেলজিয়াম থেকে আসা বৃটিশ সাংবাদিক ও ই ইউ টুডের প্রকাশক গেরি কার্টরাইট ও তার ইউক্রেনীয় স্ত্রী এবং আলিনা খান। দুজনেই জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত। আলিনা খানের ব্যাকগ্রাউন্ড খুব ইন্টারেস্টিং। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এই তরুণীর জন্ম ও বেড়ে উঠা আমেরিকায়। সেখানেই পড়াশুনা করে উচ্চতর পড়াশুনার জন্যে হল্যান্ডের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে এবং সে সময় ‘ইন্টার্নশীপ’ করার জন্যে হেগ শহরে অবস্থিত ডায়াসপোরা সংগঠন, বাসুগএ আবেদন করে। তার পাঠানো বায়োডাটা দেখে আগ্রহী হই। তার মাস্টার্সের থিসিসের বিষয় ছিল একাত্তরের বাংলাদেশ গণহত্যা। তার সাথে যখন কথাবার্তা হয় তখন মনে মনে ঠিক করি এই তরুণীকে জেনোসাইডের ওপর বক্তব্য রাখার জন্যে কোন এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাবো। এরপর বছর পেরিয়ে যায়। গেল সপ্তাহে সে সুযোগ এলো। ততদিনে সে মাস্টার্স শেষ করে হল্যান্ডের নামকরা লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র লেকচারার হিসাবে যোগ দিয়েছে। তাকে জেনেভায় অন্যতম বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ জানালে সে অতি আগ্রহের সাথে রাজি হয় এবং বারবার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানায় জাতিসংঘের মত একটি প্লাটফর্মে আয়োজিত সম্মেলনে তাকে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে। পরিচয় যেদিন হলো সেদিন তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ে তার আগ্রহ জন্মালো কেন এবং কী করে জন্মালো। উত্তরে শ্যামলা রংয়ের হ্যাংলাপাতলা গড়নের এই মার্কিনপাকিস্তানি তরুণী জানালো, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা হয়েছে তা সে জানতে পেরেছে অনেক বড় হয়ে এবং তা জেনেছে তার মায়ের কাছ থেকে। তার মাও বিষয়টা জানতে পেরেছে অনেক পরে। কেননা পাকিস্তানের পাঠ্যবই বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কোন বর্ণনা নেই। তার মায়ের জন্ম পাকিস্তানে। আলিনা জানায়, তার মা যখন বাংলাদেশে সংঘটিত একাত্তরের গণহত্যার কথা জানতে পারে তখন থেকে তিনি (তার মা) পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। অনেক কথার মধ্যে এই কথাগুলি সে গত ১০ অক্টোবর শুনিয়েছিল জেনেভায় জাতিসংঘের সদর দফতরে হলভর্তি দর্শকদের। এই ব্যাপারে পরবর্তী সংখ্যায় আরো লেখার ইচ্ছে রইলো।

লেখক : সাহিত্যিত, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবীর মুক্তিযোদ্ধা মোখতার আহমদ
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণই মুখ্য