রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ভাগনারের’ প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের তথাকথিত উড়োজাহাজ–দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা এই কথাই নতুন করে প্রমাণ করে যে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ পার পাবে না। প্লেন দুর্ঘটনায় প্রিগোশিন ও তার কয়েক বিশ্বস্ত সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে বলে রুশ কর্তৃপক্ষ জোর গলায় দাবি করলেও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সহ বিশ্বের অনেকেই, এমন কী খোদ রাশিয়ার অনেক নাগরিকও তা বিশ্বাস করেননি। এই মৃত্যুকে তারা পরিকল্পিত হত্যা হিসাবে দেখছেন। তবে দুর্ঘটনায় প্রিগোশিনের এই মৃত্যুতে কেউ খুব একটা অবাক হননি। বরঞ্চ পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেও তিনি যে এতদিন (প্রায় দু‘মাস) বেঁচে ছিলেন তাতেই তারা অবাক হয়েছেন। কেননা এক সময়কার কেজিবির কর্নেল ভ্লাদিমির পুতিন, যিনি কেজিবির উত্তরসূরী সংস্থা, এফ এস বি–র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অতি মাত্রায় প্রতিশোধপরায়ণ হিসাবে জগৎখ্যাত। প্রিগোশিনের বিদ্রোহের দিন পুতিন তার টেলিভিশন ভাষণে ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এর আগে এক সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি কাউকে ক্ষমা করতে পারেন কিনা। মুখে কিছুটা হাসি এনে উত্তরে বলেছিলেন, হ্যাঁ, তবে ‘বিশ্বাসঘাতকদের’ নয়। তিনি ক্ষমা করেননি প্রিগোশিনকে। কেবল সমালোচকদের নয়, তিনি ক্ষমা করেননি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধীদেরও। ক্ষমা করেননি পুতিন ও ক্রেমলিনের কট্টর সমালোচক, আলেক্সান্ডার লিডভিনেঙ্কোকে। আলেক্সান্ডার ছিলেন এফ এস বি (প্রাক্তন কে জি বি)-এর সংঘটিত অপরাধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তিনি মাদক ও অর্থ পাচারের অভিযোগ এনেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে। পরিণামে তাকে রাশিয়া ছাড়তে হয়েছিল এবং যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যে একটি অত্যন্ত বিরল এবং ব্যয়বহুল বিষ তেজস্ক্রিয়, পোলোনিয়াম–২১০ মেশানো চা পান করার পর তিনি যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয় সেটি ছিল পুতিনের কাজ। এ রকম উদাহরণ আরো বেশ কিছু রয়েছে। পুতিনকে যারা চ্যালেঞ্জ করেছেন তাদের হয় জেলে ঢোকানো হয়েছে কিংবা দেশছাড়া হতে হয়েছে। কিন্তু তাদের কেউ কেউ দেশ ছাড়লেও ছাড়া পাননি পুতিনের ‘লম্বা হাত’ থেকে। তবে ক্রেমলিন ও পুতিন উভয়েই এই ধরনের অভিযোগকে কল্পনাপ্রসূত ও মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
ভাগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন তার হিসাবে ভুল করেছিলেন। কেউ কেউ তাকে বলেন ‘বোকা’। বোকা এই কারণে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন তার এক সময়ের বিশ্বস্তভাজন পুতিনকে। বিশ্বাস করে ভুল করেছেন। আর সেই ভুলের খেসারত দিতে হলো মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। পুতিনের হাত ধরেই প্রিগোশিনের উত্থান। পুতিনের পাচক হিসাবে তার ছিল পরিচিতি। সেই সূত্রে পুতিনের বিশ্বস্তভাজন হওয়া এবং ব্যবসায়িক সাফল্যের দিকে তার এগিয়ে চলা। এক সময় গড়ে তোলেন বিশাল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী, পরবর্তীতে যার উপর ভর করে ইউক্রেনে রাশিয়ার জন্যে অনেক সফলতা এনে দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, প্রিগোশিন ছিলেন একজন দাগী আসামী এবং নানা অপরাধে জেল খেটেছেন অনেক বছর। প্রিগোশিনের ওয়াগনার সামরিক কোম্পানি যখন রাশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী কাঠামোতে পরিণত হয়েছিল, তখন পুতিন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের উপর ক্রমশ তার (প্রিগোসিন) উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এখন দেখা যাক, কীভাবে প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে জেলখাটা এক দাগী আসামী থেকে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রধান হয়ে উঠা প্রিগোশিনের এই সম্পর্ক গড়ে উঠলো।
পুতিন ও প্রিগোশিন– দুজনেই রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী, সেন্টস পিটার্সবুর্গ থেকে আসা। তাদের সম্পর্ক ঠিক কখন কবে শুরু তা জানা যায়নি। তবে যা জানা গেছে তা হলো প্রিগোশিন জেল থেকে যখন বেরিয়ে আসেন তখন পুতিন পূর্ব জার্মানির একটি মিশন থেকে সোভিয়েত নিরাপত্তা পরিষেবা, কেজিবির অফিসার হিসাবে ফিরে এসেছেন এবং রাজনীতিতে প্রবেশ করার পথ খুঁজছিলেন। উল্লেখ্য, প্রিগোশিন অপরাধের জন্যে যখন দোষী সাব্যস্ত হন তখন তার বয়স ছিল ১৭। এরপর ১৯৮১ সালে ডাকাতির জন্যে তাকে দীর্ঘ কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল। তিনি ও তার দুই সহযোগী সহ রাস্তায় এক মহিলার ঘাড় ধরে তার (মহিলা) শীতের বুট এবং কানের দুল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে তাকে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন বলে প্রকাশ। অবশেষে এলো ১৯৯০। ভিন্ন এক রাশিয়া। পুরানো সোভিয়েত প্রধান মিখাইল গর্বাচব ক্ষমতায়, বার্লিন দেয়া গেল পড়ে, শুরু হলো পেরেস্ট্রোইকা (পুনর্গঠন)। ইতিমধ্যে প্রিগোশিন সেন্ট পিটার্সবুর্গ হট–ডগ সেলসম্যান হিসাবে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি রেস্তোরাঁ খোলেন। সেখানেই সম্ভবত এই দুই রতনের (পুতিন ও প্রিগোশিন) সাক্ষাৎ। প্রিগোশিনের খাবার মেন্যু স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও শহরের মেয়র, আনাতোলি সোবচাককে আকৃষ্ট করেছিল। তখন ৪০ বছর বয়সী পুতিন সোবচাকের ডেপুটি হিসেবে সেখানে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে উত্থান শুরু এক সময়ের দাগী আসামি প্রিগোশিনের। তিনি গড়ে তোলেন একক রেস্তোরাঁ চেইন। শতাব্দীর শুরুতে পুতিন যখন প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন এই দুই ব্যক্তি ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে উঠেন। ইতিমধ্যে প্রিগোশিন দেশে মিডিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন যা রাশিয়ার ভেতর ও বিদেশে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে নিয়োজিত থাকে।
ওয়াগনার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি দীর্ঘদিন পুতিনের সমর্থনে কাজ করে আসছিলো। কেবল ২০১৩–১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের পর ওয়াগনার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানির নাম উঠে আসে। ওয়াগনার ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেনের পূর্বে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, রাশিয়ার আইনে ভাড়াটে সেনা বাহিনী বা সংস্থা নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রিগোশিন এবং তার ভাড়াটে বাহিনী পুতিনের কর্তৃত্বকে দৃঢ় করার জন্য ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আইনে নিষিদ্ধ ছিল বিধায় ২০২২ সালের মে মাস তক ক্রেমলিন এই ভাড়াটে সেনা বাহিনীর সাথে কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করে আসছিল। ক্রেমলিন বরাবর দাবি করে আসছিলো প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে প্রিগশিনের বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। অথচ ওয়াগনার বাহিনী কেবল ইউক্রেনে নয়, সিরিয়াতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছিলো। এছাড়াও এই দুর্ধুর্ষ দলটি লিবিয়া এবং মালি থেকে শুরু করে মধ্য আফ্রিকীয় প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে কয়েক বছর ধরে সক্রিয় ছিল এবং রয়েছে। অবশেষে সব জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে খোদ পুতিন নিজেই গেল জুন মাসে স্বীকার করলেন যে ওয়াগনার বছরের পর বছর ধরে প্রচুর রাষ্ট্রীয় তহবিল পেয়েছে এবং এর ভাড়াটেরা যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে।
এখন দেখা যাক পুতিনের এতো কাছের জন হয়েও প্রিগোশিনের এই করুণ পরিণতি কেন? প্রিগোশিন গেল নভেম্বর সেন্ট পিটার্সবুর্গে ‘ওয়াগনার সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং এই প্রতিষ্ঠান থেকে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রচুর সমালোচনা করতে থাকেন। বিশেষ করে ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীকে পিছু সরে আসতে হলে তার রুশ সেনা নেতৃত্বের সমালোচনা তীব্র আকার ধারণ করে। তিনি তাদের পদত্যাগ দাবি করেন। এতে রুষ্ট হন রুশ সেনা কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার সেনাবাহিনী নিয়ে মস্কোর দিকে এগুতে থাকলে পুতিন ভীষণ ক্ষেপে যান। তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে তার সমালোচনা করেন। বিদ্রোহ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার আগে বেলেরুশ প্রেসিডেন্টের মধ্যস্থতা প্রিগোশিন তার বাহিনীকে নিয়ে ফিরে যান বেলেরুশে। পুতিনকে প্রিগোশিনের সাথে ‘সমঝোতা’ করতে হয় গোটা পরিস্থিতি সামাল দিতে। ওই পরিস্থিতিতে পুতিনকে খুব অসহায় ও দুর্বল মনে হচ্ছিল। কেননা তাকে প্রিগোশিনের ‘তেতো ট্যাবলেট’ গিলতে হয়। তবে সপ্তাহ কয়েকের মধ্যে পুতিন নিজেকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তখন সবাই ধরে নিয়েছিলেন প্রিগোশিনের দিন ঘনিয়ে আসছে। কেননা পুতিন সহজেই এই অপমান ও তাকে চ্যালেঞ্জ করা ব্যক্তিকে যে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেবার পাত্র নন তা তার আগের কার্যকলাপে প্রমাণিত। প্রিগোশিনের বিশ্বাস ছিল, বিদ্রোহের ঘটনায় তিনি ক্ষমা পেয়ে যাবেন। তিনি ভেবেছিলেন রুশ সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার বাহিনীর যোদ্ধাদের নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করার ঘটনায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁকে ক্ষমা করে দেবেন। রাশিয়ার কয়েকটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক আইএসডব্লিউ (ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার) এমন দাবি করে। আইএসডব্লিউ বলে, ভাগনারের বিদ্রোহ, মস্কো দখল প্রচেষ্টা এবং সামরিক কমান্ডারদের উৎখাতের মধ্য দিয়ে পুতিনকে যে ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা হলো, তা হয়তো প্রিগোশিন খুব একটা গুরুত্ব দেননি। আর তারই মাশুল দিতে হলো তাকে। প্লেন দুর্ঘটনায় প্রিগোশিনের বিদায়, চিরকালের জন্যে। প্রিগোশিন–বিহীন ওয়াগনার বিশাল বাহিনীর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে তা এখন দেখার বিষয়। তবে যেহেতু ওয়াগনার প্রমাণ করেছে যে এই দলটি খুব কার্যকর, হয়তো এটিকে বিলুপ্ত নাও করা হতে পারে এবং এদের ইউক্রেন যুদ্ধে লাগানো যাবে, মন্তব্য মিলিটারি পর্যবেক্ষক ডেভিড জেন্ডেলম্যান।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট