হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

মাগ শট! কখনো শুনিনি, নেভার হার্ড’

মাগ শট! আমি কখনো এই শব্দগুলি শুনিনি, নেভার হার্ড।’ না, এ আমার কথা নয়। আমেরিকার ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমপ্রতি উচ্চারিত কটি শব্দ। কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্প নয়, অনেকের মত আমিও এর আগে শব্দগুলি শুনিনি। বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলায় গত ২৪ আগস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আটলান্টার ফুলটন কাউন্টি জেলে আত্মসমর্পণ করলে, সাধারণ অভিযুক্ত অপরাধীদের মত তারও ছবি তোলা হয়। অন্যান্য অপরাধীর মত তার আঙুলের প্রিন্টও নেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ২০২০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এখন দেখা যাক সমপ্রতি বহুল উচ্চারিত এই ‘মাগ শট’ শব্দ দুটির অর্থ কী? অভিযুক্ত অপরাধীর কাঁধের উপরের অংশের তোলা ছবিকে বলা হয় ‘মাগ শট’। এই বিশেষ ধরণের ছবির পেছনে অপরাধীর সাথে জেল কর্তৃপক্ষের ‘লোগো’ও দেখা যায়। এই ধরণের ছবি দেখা যায় বিভিন্ন থানায়, দেয়ালে সাঁটানো থাকে এই ছবি। বাংলাদেশের থানাগুলিতেও যদ্দুর জানি অপরাধীদের এই ধরনের ছবি টাঙানো থাকে। ইন্টারপোলও পালিয়ে থাকা অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে এই ধরনের ছবি তুলে থাকে ও প্রচার করে। এই ধরনের ছবিকেই পুলিশি ভাষায় বলা হয়, ‘মাগ শট’। মাগ শটের মূল উদ্দেশ্য ছিল আইন প্রয়োগকারীকে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির ফটোগ্রাফিকরেকর্ড রাখার অনুমতি দেওয়া, যাতে ভিকটিম, জনসাধারণ এবং তদন্তকারীরা অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারেন। ফটোগ্রাফি আবিষ্কারের মাত্র কয়েক বছর পরে অর্থাৎ ১৮৪০ সালে অপরাধীদের ছবি তোলা শুরু হয়েছিল, কিন্তু ১৮৮৮ সালে ফরাসি পুলিশ অফিসার আলফোনস বার্টিলন এই প্রক্রিয়াটিকে বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে আসেন। ‘মাগ’ হলো ইংরেজি শব্দ ‘ফেইস’ বা বাংলা ‘চেহারা’র অপ্রভ্রংশ বা অপভাষা, যার অর্থ বিশেষ কারণে ব্যবহার করার জন্যে কোনো ব্যক্তির ক্ষুদ্রাকৃতি ছবি। বেলজিয়ামে জেলের কয়েদীদের প্রথম এই মাগ শট ছবি তোলা হয় ১৮৪৩ সালে। যুক্তরাজ্যে এর প্রচলন শুরু হয় আরো পর, ১৮৪৬ সালে।

রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল ১৯৮৯ সালে নির্মিত জর্জিয়ার অধীনে আটলান্টা ফুলটন জেল। এই জেলে ১১২৫ অপরাধীর থাকার ব্যবস্থা থাকলেও এখন আছে প্রায় তিন হাজার সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ডোনাল্ড ট্রাম্প জেলে আত্মসমর্পণ করলে ২০ মিনিটের জন্যে তাকে আটকে রাখা হয়। অতপরঃ দুই লক্ষ ডলারের বিনিময়ে তিনি জামিনে মুক্তি পান। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প হলেন প্রথম প্রেসিডেন্ট যার ‘মাগ শট’ তোলা হয় এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। কোন বিবেকবান, এমন কী কোন ব্যক্তি নিজ মান সম্মানের ব্যাপারে সামান্যতম সচেতন তার পক্ষে এই ধরনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। এতো অনেকটা মরণশামিল। ট্রাম্প, তিনি তো স্বাভাবিক ব্যক্তি নন। তিনি সাথে সাথে এই ‘মাগ শট’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিলেন। দাবি করলেন তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। ইতিমধ্যে তিনি এই ছবিকে ব্যবসার কাজে লাগান। রাতারাতি আমেরিকার বাজার ছেয়ে গেল ট্রাম্পের মাগ শট সম্বলিত টিশার্ট, মগ, চায়ের কাপ এবং নানা ধরনের স্যুভেনিয়র। ঝানু ব্যবসায়ী বটে ট্রাম্প! তার সমর্থকদের মাঝে একটি বিষয় তিনি ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হলেন যে, তার বিরুদ্ধে যে একটির পর একটি মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে তা নিছক তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে। তার ভোটক্যাম্প তার এই ট্যাবলেট গিলতে দেরি করলো না এবং দিন যত যাচ্ছে এবং ২০২৪ সালের নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা দলের অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেক পিছিয়ে রেখে ছুটন্ত ঘোড়ার মত এগিয়ে চলেছে। জামিনে মুক্ত হয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আজ জর্জিয়ার ফুলটন কাউন্টির কুখ্যাত হিংসাত্মক কারাগারে, কোন অপরাধ না করা সত্ত্বেও আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমেরিকার জনগণ জানে যা ঘটেছে তা ন্যায়বিচারের প্রতারণা এবং নির্বাচনী হস্তক্ষেপ।’

সবাই কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন মামলার রায় কী হয় তা দেখার জন্যে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্প কি নির্বাচন করতে পারবেনএই প্রশ্নও অনেকের। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এ নিয়ে কোন আইনি বাধানিষেধ নেই। তিনি যদি জেলেও থাকেন সেখান থেকেও নির্বাচনে লড়তে পারবেন, যদি তিনি রিপাবলিকান পার্টি কর্তৃক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হন। মার্কিন ইতিহাসে দেখা গেছে দেশদ্রোহী অপরাধে ১০বছরের সাজাপ্রাপ্ত মার্কিন সোসালিষ্ট নেতা, ইউজিন ভি ডেভস ১৯২০ সালে জেলের সেল থেকে দলের প্রার্থী হিসাবে প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে লড়ে প্রচুর ভোট পেয়েছিলেন। এর আগেও তিনি বার কয়েক প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে লড়েছিলেন সোসালিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসাবে। কিন্তু কখনই নির্বাচিত হতে পারেননি। ডেভসের মত ইতিমধ্যে মার্কিন টিভি ব্যক্তিত্ব, জো মালডোনান্ডপ্যাসেজ যিনি হত্যার চেষ্টা ও পশু নির্যাতনের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত, আগামী ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত মামলার পরবর্তী শুনানি হবে আগামী বছরের ৪ মার্চ। মাঝে অনেকটা সময়। ইতিমধ্যে জর্জিয়ার চাতাহুচ্ছি ও ফ্লিন্ট নদীতে অনেক পানি গড়িয়ে যাবে। এই দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক পট কোনদিকে মোড় নেয় এই মুহূর্তে কিছুই বলা সম্ভব নয়। মামলার রায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি যে আপীল করবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবং সে সময় ট্রাম্প মুক্ত থাকতে পারবেন কিনা তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বিচারকের উপর। ফেডারেল আইনে মুক্ত থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে জর্জিয়ার আইন বলে ভিন্ন কথা। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যাপক এলিজাবেথ টেক্সেলকে উদ্ধৃত করে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প জর্জিয়ায় দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাকে যদি পাঁচ বছরের বেশি সাজা দেয়া হয়, তাহলে তিনি জামিনের অযোগ্য হবেন। যদি তিনি পাঁচ বছরের কম সাজাপ্রাপ্ত হন তাহলে বিচারক ফেডারেল আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিচার করতে পারেন এবং সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক এই বিচার ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে শেষ হবে কিনা এই নিয়ে সন্দেহ পোষন করেন। কেননা ট্রাম্পের সাথে আরো ১৮ সহযোগী আছে, যারা একই অভিযোগে অভিযুক্ত।

এতগুলি বিচার প্রক্রিয়া এই অল্প সময়ে সম্ভব নয় বলে তার ধারণা। রায় যাই হোক না কেন, ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, নদীর পানি যেদিকে গড়াক না কেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন। এ তার অনেকটা ‘বাঁচামরার লড়াই’। যদি তিনি জেল থেকে লড়াই করেন তাহলে আগামী নির্বাচনপরিস্থিতি যে একটি নতুন আকার ধারণ করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কেমন হয় সেটি হবে দেখার মত বিষয়। আর তা দেখার জন্যে আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। আফটার অল রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোন কথা নেই।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজলবদ্ধতা ও আমাদের দায়িত্বহীনতা
পরবর্তী নিবন্ধনারী উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ