হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২২ জুলাই, ২০২৩ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

ইউরোপ জ্বলছে। গরমে মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। আক্ষরিক অর্থে ইউরোপের অনেক দেশে অনেকের রজনী এখন কাটছে নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধ দিন, আরাম গেছে নির্বাসনে। সামার এলে ইউরোপের লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। ছুটির আনন্দে সবাই নেচে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়। কেউ যায় পর্বতে, কেউ নদীর ধারে, কেউ জঙ্গলে, কেউবা বরফআচ্ছাদিত পাহাড়ে, স্কী খেলতে। এক এক জনের এক এক শখ। কিন্তু এবার চিত্র ভিন্ন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গোটা ইউরোপে অস্বাভাবিক গরম পড়ছে। ইতিমধ্যে যারা সামারকে টার্গেট করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন তারা পড়েছেন সমস্যায়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, বেলারুশ, স্পেনে যারা বেড়াতে গেছেন তারা ছুটি উপভোগ তো দূরের কথা, কী করে সেখান থেকে ফিরে আসবেন নিজ ঘরে সেই ভাবনা তাদের পেয়ে বসেছে। হল্যান্ডের দশাও ভিন্ন নয়।

হল্যান্ডের আবহাওয়া যখন এমন উত্তপ্ত, তখন তার চাইতেও বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ছোট এই দেশটির শান্তরাজনীতির আবহাওয়াও। কয়েক সপ্তাহ ধরে ডাচ রাজনীতিতে অভাবনীয় উত্থানপতন, রাজনৈতিক নেতাদের দল থেকে পদত্যাগ, অনিশ্চয়তা, পলিটিক্যাল ডাইভার্শন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে গত ৭ জুলাই হল্যান্ডের সব চাইতে দীর্ঘদিন (এক টানা ১৩ বছর) প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় থাকা ফেই ফেই ডে বা পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসির নেতা, ৫৬ বছর বয়েসী অকৃতদার মার্ক রুটে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়ার পর থেকে। সামপ্রতিক সময়ে হল্যান্ডে শরণার্থী ইস্যুকে ঘিরে মার্ক রুটের নেতৃত্বাধীন চার দলীয় ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন সরকারের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে চলমান পরিস্থিতিতে এক পর্যায়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। হল্যান্ডে শরণার্থীআসা নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে মার্ক রুটে কিছু শর্ত আরোপ করেছিলেন যা কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরীক দল, ক্রিশ্চিয়ান ইউনিয়ন মেনে নিতে রাজি হয়নি। তাদের মতে শরণার্থী আসাকে নিরুৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে রুটে যে সমস্ত পদক্ষেপ নেবার প্রস্তাব করেছেন তা অমানবিক। মার্ক রুটের এই কোয়ালিশন সরকারে আরো যে তিনটি রাজনৈতিক দল রয়েছে তা হলো, লিবারেল দল যা ডি৬৬ হিসাবে পরিচিত, ক্রিশ্চিয়ান ইউনিয়ন এবং সিডিএ বা ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক এপিল। মার্ক রুটের হঠাৎ করে ক্ষমতা এবং পাশাপাশি দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় সরকারের পতন হলো। প্রথানুযারী প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে ডাচ রাজা ইউলিয়াম আলেকজান্ডারের সাথে দেখা করে লিখিতভাবে তার সরকারের পদত্যাগ পত্র দেন। রাজা উইলিয়াম প্রধান মন্ত্রী ও তার মন্ত্রী পরিষদকে আগামী নির্বাচন তক কাজ চালিয়ে যাবার জন্যে অনুরোধ জানান। মার্ক রুটে বর্তমানে ‘কেয়ার টেকার’ গভর্মেন্টের প্রধান হিসাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। পদত্যাগের ঘোষণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘গতকাল সকালে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি আর দলের নেতা হিসেবে থাকবো না। নির্বাচনের পর যখন নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নেবে, তখন আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব। সামপ্রতিক সময়ে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’

যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো, দীর্ধদিন ধরে মার্ক রুটে ক্ষমতায় থাকলেও ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা খুব একটা কমেনি। দলের মধ্যে তার শক্তিশালী কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নেই, নেই বিরোধী দলের মধ্যেও। ফলে বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি ইস্যুকে ঘিরে কট্টর সমালোচনার মুখে পড়লেও বারবার তিনি পার পেয়ে গেছেন। তার ভুলের জন্যে তিনি বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে সাধারণের কাছে এবং পার্লামেন্টে সদস্যদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে দেখে মনে হয়েছিল এই বুঝি তিনি তার গদী হারালেন। কিন্তু টিকে গেছেন প্রতিবারই। যে কথাটা বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাইছি তা হলো, মার্ক রুটে চাইলে সহজেই দলের নেতৃত্বে থাকতে পারতেন। কিন্তু অনেককে অবাক করে তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি কেবল ক্ষমতা থেকে নয়, দল থেকে, এমন কি রাজনীতি থেকেও সরে দাঁড়াবেন। আসন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রচারণায়ও তিনি নেতৃত্ব না দেবার কথা ঘোষণা দেন। মজার ব্যাপার হলো, রুটের এই ঘোষণার সাথে সাথে হল্যান্ডের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেও ধস নামতে শুরু করেছে।

ইতিমধ্যে, ডি৬৬ নেতা সিগ্রিড কাগ, সিডিএর হোপকে হোয়েকস্ট্রা, মন্ত্রিসভার সদস্য: উপধানমন্ত্রী ক্যারোলা শৌটেন (ক্রিশ্চিয়ান ইউনিয়ন), অভ্যন্তরীণ ও রাজ্য সম্পর্কের মন্ত্রী হ্যাঙ্ক ব্রুইনস স্লট (সিডিএ), আবাসন মন্ত্রী হুগো ডি জং (সিডিএ) এবং স্টেট সেক্রেটারি ফর ফাইন্যান্স মার্নিক্স ভ্যান রিজ (সিডিএ) জানিয়েছেন যে তারা আসন্ন নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। এখানেই শেষ নয়। হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের বেশ কয়েকজন বর্তমান সদস্য ইতিমধ্যে তাদের অবসর ঘোষণা করেছেন। পদত্যাগের পেছনে এদের কয়েকজন যে কারণ বা যুক্তি দেখিয়েছেন তা আমাদের জন্যে অবাককরা ব্যাপার। একজন জানালেন, তিনি দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন কারণ তিনি তার পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না। ডি৬৬ এর নেতা সিগ্রিড কাগ যিনি এক সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং কিছুদিন আগেও অর্থমন্ত্রী ছিলেন, পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বলেন, চরম ডান উগ্রবাদীদের প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে তিনি এবং তার পরিবার অনিরাপত্তায় ভুগছেন এবং পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তাই তিনি দলনেতার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আগামী নির্বাচন হবে চলতি বছরের ২২ নভেম্বর। হঠাৎ সরকার পতন না হলে সাধারণ নির্বাচন হবার কথা ছিল আরো দুই বছর পর ২০২৫ সালে। দেশের ২০টি রাজনৈতিক দল সংসদের ১৫০টি আসনের জন্যে লড়বে। ইতিমধ্যেএই নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন দলের মধ্যে ‘মোর্চা’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আলোচনাদেন দরবার চলছে। লেবার পার্টি ও গ্রিন পার্টির মধ্যে আঁতাত সৃষ্টি হয়েছে। আগামী নির্বাচনে কোন দল বিজয়ী হয়ে আসবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে কয়েক বছর আগে সৃষ্ট অপেক্ষাকৃত ছোট দল, বিবিবি (বুর বুর্গার বিভেইকিং) ইংরেজিতে যা কৃষকনাগরিক মুভমেন্ট হিসাবে পরিচিত আগামী নির্বাচনে চমক দেখতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সপ্তাহ কয়েক আগে দেশে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে এই দলটি প্রথম স্থান দখল করে আশাতীত সফলতা অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের রাজনীতি থেকে অবসর নেয়া আগামী নির্বাচনে তার দলের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। দলের ৭১% ভাগ ভোটার মনে করেন তিনি দলের নেতৃত্বে থাকলেও তাদের কোন সমস্যা ছিল না, যদিও বা তিনচতুর্থাংশ ভোটার মনে করেন এখন তার তল্পিতল্পা নিয়ে চলে যাবার উপযুক্ত সময়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৮% সমর্থন নিয়ে মার্ক রুটের ফেই ফেই ডে এবং প্রোকৃষক দল বিবিবির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে আগামী নির্বাচনে। অন্যদিকে, খের্টস গিল্ডার্সের চরম ডান দল, পেই ফেই ফেই বা পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসি ১০% ভোট পেয়ে পরবর্তী স্থানে অবস্থান করবে। গ্রিন পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ডি৬৬, লেবার পার্টি ৮% ভোট পাবে। তবে এ সবই গত জুন মাসে পরিচালিত এক জরিপের আগামবার্তা। রাজনীতিতে মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তন হতে পারে। নির্বাচনের আরো প্রায় চার মাস বাকি। দেখা যাকএই সময়ের মধ্যে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বজুড়ে অভিবাসন এবং ধনীদের দেশ ত্যাগ : হুমকির মুখে অর্থনীতি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে বিদেশিরা নির্ভার