চিকিৎসা, ভালো ব্যবহার– দেশে বিদেশে, কিছু প্রশ্ন
দেশ থেকে ফিরে এসে দিন কয়েকের মাথায় গতকাল হাসপাতালে যেতে হলো। চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল। দেশ থেকে আসার আগেই এই এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা। দিন কয়েক আগে আমার মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সে কথা মনে করিয়ে দেয়। যেন গরজটা তাদের। আপনার মনে না রাখলেও চলে। বাসার অনতিদূরে চমৎকার অতি আধুনিক এই হাসপাতাল। রৌদ্রস্নাত দিন। হেঁটে গেলে বড়জোর পনের থেকে বিশ মিনিট। দেশে প্রায় মাস খানেক অবস্থানের সময় হাঁটা একেবারে হয়নি। হাঁটবো কোথায়? হাঁটার রাস্তা নেই। যা ছিল তা বেদখলে গেছে ফেরিওয়ালাদের দখলে। বেআইনিভাবে বসা এই সব ফল–সবজি, মাছওয়ালা ইত্যাদিরা ফুটপাত, এমন কী গাড়ি–চলার রাস্তার অনেকটা দখল করে ব্যবসা করার ‘অধিকার’ আদায় করে নিয়েছে পুলিশ থেকে শুরু করে স্থানীয় মাস্তান, রাজনীতিবিদদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে। যাই হোক, হাঁটার পথ ধরে নিশ্চিন্তে হেঁটে পৌঁছে যাই হাসপাতালে। ঝকঝকে, তকতকে, কোথায়ও কোন সামান্যতম ময়লা নেই। দেশের প্রায় হাসপাতালে ঢোকামাত্র যে একটা ভোঁটকা গন্ধ নাকে আসে তা অনুপস্থিত। চক্রাকারে ঘোরা দরোজা ঠেলে হাসপাতালের প্রবেশ মুখের ডানদিকে কয়েকটি রিসেপশন কাউন্টার, তাতে কয়েকজন মহিলা কর্মী বসে, বাদিকে ক্যাফেটেরিয়া। কাউন্টার পেরিয়ে হাতের ডানদিকে ছয়/সাতটি এটিএমের মত মেশিন। হাসপাতালের কয়েক কর্মী বিশেষ পোশাকে ধারে–কাছে অপেক্ষমান সাহায্য করতে, যদি কারো লাগে। এগিয়ে যাই মেশিনের দিকে। একটি মেশিনের স্ক্রিন হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই ডাচ ভাষায় নির্দেশাবলী-‘আপনার পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স রাখুন’। পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে মেশিনে রাখতেই একটা স্লিপ বেরিয়ে আসে। তাতে লেখা– আপনার এপয়েন্টমেন্ট অমুক সময়ে, আপনি ওই কামরার দিকে যান। সেখানে একটি স্ক্যানিং মেশিন। তাতে স্লিপটি ধরতেই পর্দায় আর এক নির্দেশ– অমুক নম্বর কামরার সামনে গিয়ে বসুন। সেখানে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করি। নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পাঁচেক পর এক মহিলা ডক্টরস এসিস্টেন্ট এসে আমার নাম ধরে ডাকতেই তাকে অনুসরণ করি। কাছে যেতেই তিনি ডাচ ভাষায় ‘শুভ সকাল’ বলে কামরায় ঢুকতে বলেন। বিনয়ের সাথে মেশিনের সামনে বসতে বলে আমায় বলেন, ‘মেশিনে আমি আপনার চোখ পরীক্ষা করে দেখবো। তার আগে চোখে কিছু ড্রপ দেব। এরপর ডাক্তার আপনাকে দেখবেন’। তিনি দেখলেন। পরীক্ষা করলেন। কম্পিউটারে কিছু লিখলেন। সব মিলিয়ে সময় নিলেন বড়জোড় মিনিট দশেক। তারপর কামরা থেকে বেরিয়ে হাত দিয়ে পাশের কামরার দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘আপনি ওখানে গিয়ে বসুন, ওখানে আপনার চোখের স্ক্যান করা হবে’। সেখানে গিয়ে বসতেই পাশে বসা এক ডাচ মহিলা দর্শণার্থী আমাকে দেখে বললেন, ‘শুভ সকাল’। আমিও তাকে শুভেচ্ছা জানাই। ভালো লাগে। অথচ আমরা এখনো এই সামান্য ভদ্রতাটুকু শিখিনি, শেখার বা চর্চা করার কোন ইচ্ছে বা লক্ষণও আমাদের আছে বলে মনে হয় না। কিছুদিন আগে বাসায় লিফটের সামনে অপেক্ষা করছি। একটু বাদে নেমে এলেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক। তাকে সালাম দিলাম। তিনি কোন উত্তর না দিলে পাশ কেটে নেমে গেলেন। মনে মনে তাকে ‘অভদ্রের’ তালিকায় রেখে উপরে উঠে গেলাম। দেশে দেখেছি বস–গোছের যারা তারা এই সামান্য ভদ্রতা ও সৌজন্যতা দেখান না। তাদের অধস্থনরা যখন সালাম দেন বা শুভেচ্ছা জানান, তখন তারা কোন উত্তর না দিয়ে এমন কী যারা সালাম দিচ্ছেন তাদের দিকে দৃষ্টিপাত না করে গটগট করে হেঁটে যান। পশ্চিমে এটি চিন্তার বাইরে। যাই হোক– অপেক্ষা করছি, মিনিট পাঁচেক পর স্ক্যানিং–কামরা থেকে এক মহিলা বের হয়ে আমার নাম ধরে ডাকলেন। তাকে অনুসরণ করি। ‘শুভ সকাল’ বলে আমায় বললেন, ‘আপনি চাইলে আপনার কোটটা ওই হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতে পারেন’। আমার সামার–কোটটা হাতে ধরা ছিল। মুখে হাসি মেলে ব্যাখ্যা করলেন কী করবেন। স্ক্যানিং শেষে তিনি কামরা থেকে বের হয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি ওই পাশের কামরায় নীল রঙের চেয়ারে গিয়ে অপেক্ষা করুন। ডাক্তার আপনাকে ডাক দেবেন ও পরীক্ষা করবেন। সেখানে গিয়ে সবে বসেছি, এমন সময় হাসপাতালের এক তর্কি মহিলা কর্মী, মাথায় হিজাব, আমায় বললেন, ‘আপনি চা–কফি কিছু খাবেন’? তিনি তখন ট্রলিতে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়েটিং–রুমে গিয়ে অপেক্ষমাণ দর্শণার্থী ও রোগীদের বিনা–পয়সায় এই সার্ভিস দিচ্ছিলেন। অপেক্ষমাণ রোগীদের জন্যে হল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে এই সার্ভিস দেয়া হয়। তাকে বলি, চিনি দুধ ছাড়া কফি। কফি আমার ভালো লাগে না, খুব কম খাই। বাসায় কদাচিৎ। কিন্তু শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল, ভাবলাম কফি খেলে একটু চাঙ্গা হবে। কফিতে চুমুক দিয়েছি, এমন সময় ডাক্তার (চক্ষু বিশেষজ্ঞ) তার কামরা থেকে বের হয়ে মিঃ চৌধুরী বলে ডাক দিলেন। তাকে আগে থেকেই চিনতাম, তিনিও আমাকে। বছর কয়েক আগে তিনি আমার ডান চোখ অপারেশন করেছিলেন। কাছে যেতেই বললেন, ‘শুভ সকাল’। তার চেম্বারে প্রবেশ। আজকের আমার এই চোখ–দেখানোর প্রক্রিয়ায় তিনি লাস্ট পয়েন্ট। তিনি ইতিমধ্যে অনলাইনে আমার চোখের স্ক্যানিং রিপোর্ট পেয়ে গেছেন। তা আমাকে দেখালেন, ব্যাখ্যা করলেন কী হয়েছে, কী করণীয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তার পাশে এক ডাচ তরুণী। বুঝতে পারি তিনি ইন্টার্নি। সব দেখে, পরীক্ষা করে ডাক্তার পরামর্শ দিলেন এই বলে, ‘বা–দিকের চোখে ছানি পড়েছে, সেটি অপারেশন করলে ভালো হয়। অপারেশন বড় কিছু নয়, তারপরও আপনি সিদ্ধান্ত নিন, করবেন কিনা, না আরো কিছুদিন ভেবে দেখবেন। এখন করলেও ওয়েটিং লিস্ট অনেক বড়’। জানতে চাই, যদি করি, কদ্দিন অপেক্ষা করতে হবে। ‘মাস চারেক’, বললেন তিনি। উত্তরে বলি, তাহলে কয়েকটা দিন ভেবে দেখার সময় নেই। তখন তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে আপনি সপ্তাহ তিনেক চিন্তা করে দেখুন, তারপর আমার সাথে দেখা করে জানান’। তার সাথে আমার কাজ শেষ। এরপর ডাক্তার তার কামরা থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে দিক নির্দেশ করে বলেন, ‘ডান দিকে কাউন্টারে গিয়ে আপনি তিন সপ্তাহ পরের জন্যে একটা এপয়েন্টমেন্ট করে যান, আর বা–দিকে ২৪ নম্বর রুমে গিয়ে চোখে ইনজেকশন দেবার জন্যে আলাদা এপয়েন্টমেন্ট করে যাবেন। হাত বাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি আবার তার চেম্বারে ঢুকলেন। ডানদিকে কাউন্টারে পৌঁছে সেখানে বসা এক তরুণীকে আমার নাম বলা মাত্রই বললেন, ‘জুলাই মাসের ৩ তারিখ সকাল আটটা বিশে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে পারেন’। বুঝতে পারি আমি তার কাছে পৌঁছার আগেই ডাক্তার ইমেইল বা তাদের ইন্টারনাল–সিস্টেমে জানিয়ে দিয়েছেন অমুক নামের লোকটি এপয়েন্টমেন্ট এর জন্যে যাবেন। তরুণীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলি, দিন ঠিক আছে, কিন্তু একটু দেরিতে দিলে ভালো হয়। (সকালে ঘুম থেকে উঠা আমার কাছে হিমালয় পর্বতে উঠার চাইতেও কঠিন কর্ম বলে মনে হয়) তরুণীটি কম্পিউটার চেক করে বলেন, না, খালি নেই। কী আর করা। সেখান থেকে ২৪ নম্বর কামরা। সেখানে পৌঁছুতেই এক ডাচ মহিলা কর্মী এগিয়ে এসে সম্ভাষণ জানিয়ে বলেন, ‘বলুন কি করতে পারি আপনার জন্যে’? ভদ্রতার কী অপূর্ব নমুনা। সেখানে কাজ শেষে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে চা আর স্ন্যাকসের অর্ডার দেই। তারপর হেঁটে বাসায় ফেরা।
ভাবছেন এই দীর্ঘ–বর্ণনা কেন দিলাম। সব কিছুর পেছনে কারণ থাকে। বর্ণনা দিলাম এই কারণে এই গোটা প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লেগেছে সর্বমোট সোয়া ঘন্টা। কোথায়ও নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বিরক্তিকর অপেক্ষা নেই। ডাক্তারের এসিস্টেন্ট থেকে শুরু করে স্বয়ং ডাক্তার এবং অন্যান্য কর্মীদের আচরণ, পরম ধৈর্য্যের সাথে সব বুঝিয়ে দেয়া– এতে রোগীর রোগ অর্ধেক ভালো করে দেয় বলে ধারণা। যে কাজটি আমার ঘন্টা দেড়েক সময়ে ঝামেলাবিহীন শেষ হলো, তা দেশে করতে কত গলদঘর্ম পোহাতে হতো, কতটা সময় ব্যয় হতো সে কথা ভাবতেই ভয় লাগে। রোগীদের যে কী হয়রানি সে দেখেছি কত। এবারও দেখলাম ঢাকায় এক তথাকথিত পাঁচ তারকা হাসপাতালে আমার নিকট আত্মীয়দের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করা। দেখে কষ্ট হয়। দুঃখ লাগে। ক্ষোভও হয়। এক রোগীর জন্যে কয়েক পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করে তাদের দিয়ে ওই নামকরা হাসপাতালে ফোন করানো। দেশে বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেখানে প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে রোগীকে ‘আই সি ইউ’–তে ঢোকানো হয়, কেবল মাত্র বাড়তি অর্থ কামানোর জন্যে। এ অভিযোগের সত্যি–মিথ্যা কতটুকু জানা নেই, তবে শুনি হরহামেশা। ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট পেতেও ক্লিনিকের কর্মচারীদের এক্সট্রা টাকা দিতে হয় বলে শুনেছি। যে সময় ও ধৈর্য্য ধরে বিদেশে একজন ডাক্তার তার রোগীদের দেখেন, তাদের কথা শোনেন, তেমনটি কি দেশে ঘটে? হয়তো ঘটে, তবে তা কেবল সুবিধাশ্রেণী রোগীর ক্ষেত্রে। জানিনা এটি কি আমাদের ‘জিনের’ মধ্যে রয়েছে কিনা। একই চিত্র দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে লন্ডনের হাসপাতালগুলিতে যেখানে ডাক্তার এশিয়ান– বাংলাদেশী, পাকিস্তানী কিংবা ভারতীয়। লন্ডনে থাকা আমাদের পারিবারিক বন্ধু বুলবুল জামান বলেন, ওদের কথাবার্তা, রোগীর সাথে আচরণ, অনেকটা আমাদের দেশের মত। সেই কারণে আমার যখন হার্টের প্রব্লেম ধরা পড়লো, আমি চলে আসি আমস্টারডাম, সেখানে ডাচ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে অপারেশন করাই‘। দেশে রেফারেন্স ছাড়া কোন রোগী ডাক্তারের কাছে গেলে শুনেছি খুব একটা ভালো আচরণ পান না, এমন কী কোন কোন ক্ষেত্রে ভালো করে রোগীর সমস্যার কথাও শুনতে প্রস্তুত নন। প্রশ্ন– এমনটি কেন হবে?
চিকিৎসা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ পেশা। তাদের উপর নির্ভর করে রোগীর বাঁচা–মরা, যদিও বা আমরা বলি সব উপরওয়ালার উপর। কোন রোগী যখন মরণপ্রায় তখন একমাত্র ভরসা উপরে উপরওয়ালা, নিচে ডাক্তার। আমার অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে, বেশ কজন আত্মীয় ডাক্তার, আমার ঘরেও ডাক্তার। সব ডাক্তার এমনটি করেন তা ঠিক নয়। অনেক ডাক্তার আছেন রোগীর আর্থিক অবস্থা দেখে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করান। আবার কোন কোন ডাক্তারকে দেখেছি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে দুর্গম এলাকায় গিয়ে বিনে–পয়সায় চিকিৎসা করতে ও সেবা দিতে। উপমহাদেশের প্রতিথযশা ডাক্তার দেবী প্রসাদের নাম অনেক শুনেছি। ছবিতে, ভিডিওতে দেখেছি, সামনা–সামনি দেখিনি। প্রার্থনা করি তাকে যেন দেখতে না হয়, প্রার্থনা করি যেন কোন ডাক্তারকে না দেখতে হয়। এই প্রসংগে একটি কৌতক শেয়ার না করলেই নয়। দেখা হতেই ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন এক ভদ্রলোককে, ‘কেমন আছেন?’ উত্তরে সে লোক বলেন, ‘ভালো, আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি’। ডাক্তার হেসে বলেন, ‘আপনি ভালো আছেন মানে আমি ভালো নেই। আপনারা ভালো থাকলে তো আমাদের না–খেয়ে মরতে হবে’। শুনছি দেবী প্রাসাদের ব্যবহার গুনেও নাকি অনেক রোগীর অর্ধেক রোগ সেরে যায়। বাংলাদেশেও নিশ্চয় কোথায়ও না কোথায়ও এমন ডাক্তার শেঠী আছেন, যাদের কথা হয়তো আমার জানা নেই। আছে কি?
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট










