শূন্যে উড়ছি আর লিখছি। উড়া তো আমার নয়। সে সম্ভবও নয়। যার উড়ার কথা সেই উড়ছে, দ্রুতবেগে। উড়ছে ইয়া বড় এক উড়োজাহাজ। সে জন্যে একটু ঘুরিয়ে বলা যে উড়ছি আর লিখছি। লিখছি প্লেনে বসে। যখন এই লেখা শুরু করি, তখনও কাতার এয়ারওয়েজের বিশাল উড়োজাহাজটি মাত্র এগার হাজার ফুট উচ্চতায়। গতিবেগ ঘন্টায় ৮৮৫ কিলোমিটার। তাকে আরো তিনগুণ উঁচুতে উঠে, গতিবেগ বাড়িয়ে উড়ে যেতে হবে গন্তব্যস্থলে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছার লক্ষ্যে। হল্যান্ডের আমস্টারডাম এয়ারপোর্ট থেকে উড়াল দেবার পর তখন সবে ৩৫ মিনিট পার হয়েছে। আমাদের উড়োজাহাজটি যখন ‘টেক–অফ’ করে তখন বাহনটি একটু এদিক–ওদিক নড়ে–চড়ে, যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। ঠিক যেমন বৃষ্টিতে–ভেজা মুরগী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে তেমনি। ভাবছেন সময়, গতিবেগ, উচ্চতা নিয়ে কী করে এত নিশ্চিত করে বলতে পারছি? প্রতিটি যাত্রীর সীটের পেছনে মিনি–টিভি স্ক্রীন। তাতে সব তথ্য ভেসে উঠে প্রতি মুহূর্তে।
আমরা চলেছি এই মুহূর্তে জার্মানির লিপজিগের উপর দিয়ে। বাইরে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি, ভেতরে ঠিক কত অনুমান করে মনে হলো ৬/৭। আমার গায়ে কোট, গলায় মাফলার। যাত্রীদের প্রায় কারো মাঝে তার কোনোটাই নেই। কেবল হাতে গোনা গোটা কয়েক যাত্রীর গলায় মাফলার। টেক–অফ করার পর প্লেন যখন বেশ উচ্চতায় তখন সুদর্শনা এক বিমানবালা কাছে এসে যখন জানতে চায় কী ড্রিংক করবো, বলি, ‘মে আই হ্যাব এ কাপ অফ টি?’ তরুণীটি উত্তরে বলে, ‘এই মুহূর্তে আমরা কেবল কোল্ড ড্রিঙ্কস সার্ভ করছি।’ ‘ঠিক আছে, ম্যাংগো জুস্ প্লিজ’। জুস বাড়িয়ে দিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে তরুণীটি বলে, ‘আপনার কি ঠান্ডা লেগেছে?’ আমার মুখের ম্যাক্সটি খুলে তাকে বলি, না। তারপর ম্যাক্সটি মুখে আটকে না রেখে পকেটে রাখি। গলায় মাফলার, গরম চা চাওয়া, মুখে মাস্ক – এইসব দেখে তরুণীটি হয়তো ধরে নিয়েছে আমি অসুস্থ, কিংবা ঠান্ডা লেগেছে। বিমানবালাটি যে একেবারে ভুল তা ঠিক নয়। ভেতরে ভেতরে একটু একটু ঠান্ডা লাগছিল। যদিওবা জ্বর বা ওই জাতীয় কিছু নয়। কিন্তু শরীরটা তখনও কিছুটা ‘কাঁচা’। সপ্তাহ দুয়েক আগে লন্ডন থেকে হল্যান্ড ফিরে পাক্কা আটদিন ঘরের তেতলায় এক ধরনের ‘স্বেচ্ছা–নির্বাসনে’ ছিলাম। বিছানায় ছিলাম দিন দুয়েক। ‘কোভিড’ আমায় পেয়ে বসেছিল দ্বিতীয়বারের মত, চার চারটি ভ্যাকসিনও তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কী তার শক্তি! নাকি আমি শক্তিহীন, দুর্বল? তবে দিন পাঁচেকের মধ্যে ‘নেগেটিভ’ রিপোর্ট এলো। আরো দিন কয়েক ঘরে কিছুটা বিশ্রাম, কাজের মাঝেও– সব মিলে শরীরটা তার পূর্বাবস্থানে ফিরতে আরো কটা দিন নিলো। লন্ডনের যাবার মাত্র দিন দশেক আগে দেশ থেকে ফিরেছিলাম এক মাস পর। এই গোটা সময়টায় শরীরের উপর কম ধকল যায়নি। ‘তার’ তো এই সময়টুকুতে প্রকৃত অর্থে কোন ‘বিরাম’ মেলেনি। বেচারা শরীরের আর কী দোষ! মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলোনা। আর সেই কথাটা শরীরের মালিকের মনে থাকেনা বলেই এই দশা। যাই হোক– এবার আমার দেশে যাওয়া ফি–বারের মত ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’। কাজের প্রেসারটা প্রচণ্ড, আর সেই প্রেসারকে নিচের দিকে রাখার জন্যে কিছুটা এদিক–ওদিক ঘোরাঘুরি। আমার আসা একটু আগ বাড়িয়ে। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এক ইউরোপীয় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং ডেলিগেশনের সদস্য হিসাবে। উদ্দেশ্য একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান যে গণহত্যা ঘটিয়েছে সেই সম্পর্কে কাছ থেকে আরো কিছু জানা, একাত্তরের ‘জেনোসাইডের’ সাক্ষী, স্বজনহারা পরিবারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি সরকার ও বিভিন্ন পেশার লোকজননের সাথে কথাবার্তা বলা। এই দলে আছেন হল্যান্ডের ২০ বছর ধরে ডাচ পার্লামেন্ট সদস্য হেরি ফান বোমেল, আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এন্থোনি হোলস্ল্যাগ, ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে ‘ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ’ পদক পাওয়া বৃটিশ সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন ও লন্ডন থেকে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী আনসার আহমদ উল্লাহ। জেনোসাইড নিয়ে সম্মেলন হবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনসহ রাজধানীতে যে কটি অনুষ্ঠান হবে সেগুলোর আয়োজনে রয়েছে ‘আমরা একাত্তর’ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি গোটা দেশব্যাপী, এমনকী দেশের বাইরেও একাত্তরের ‘জেনোসাইড’ নিয়ে কাজ করে চলেছে। ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় এটিএন বাংলায় একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ঢাকায় হল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎকার। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হবে দুটি সম্মেলন। একটি চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাবে, অন্যটি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে। ইউরোপীয় থিংক ট্যাংক, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের উদ্যোগে আয়োজিত এই সফরের অংশ হিসাবে অনুষ্ঠিতব্য এই দুটি সম্মেলনের আয়োজনে রয়েছে ক্লাব দুটি। ইউরোপ থেকে যারা আসছেন তারা সবাই নিজ নিজ পেশায় নামধারী। তিন ইউরোপীয়দের মধ্যে দু’জনের এই প্রথম বাংলাদেশ সফর। প্রাক্তন পার্লামেন্টারিয়ান হেরি ফান বোমেল অবশ্য ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু এশীয় দেশ ভ্রমণ করেছেন। দুদিন বাদে তারা ঢাকা এসে পৌঁছুবেন। তাদের প্রশ্নেরও শেষ নেই, যেমন, ঝড়ের খবর কী, মশা কেমন, গরম কী খুব বেশি, মশারি থাকবে কিনা হোটেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের আশ্বস্ত করে বলি, ‘আমার আসার পর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম আছি। এই দুই শহরের যে দুটি বাসায় আমার অবস্থান সেখানে এখনো মশার চেহারা দেখিনি। চিন্তার কোন কারণ নেই। হোটেল কর্তৃপক্ষকে আলাদাভাবে লিখে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বলেছি‘। ঢাকার অনুষ্ঠানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমরা একাত্তরের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান। স্বল্পভাষী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহবুব জামান ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)-এর প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। ঢাকায় আরো সহযোগিতা করছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তান, প্রজন্ম একাত্তরের প্রধান আসিফ মুনীর। চাটগাঁয় সিনিয়র্স ক্লাবের অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করছেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট বন্ধুপ্রতিম ড. সেলিম চৌধুরী। তার অফিসটাকে ক‘দিন নিজের অফিস বানিয়েছি। তার আন্তরিকতার শেষ নেই। অনেকেই বললেন বন্ধুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব। ঝড় থামার পর দিন কয়েক চাটগাঁয় গ্যাস ছিল না। ঢাকায় নিকটজনেরা উদ্বিগ্ন, সেখানে গিয়ে কী খাবো, কোথায় খাব ইত্যাদি। চাটগাঁর পৌঁছে বাসার সামনে গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তে দেখি পেছনে ড. সেলিম চৌধুরীর গাড়ি। সালাম জানিয়ে এগিয়ে এলো আরিফ, তার নিজস্ব ড্রাইভার, হাতে বড় টিফিন ক্যারিয়ার। সে খাবার এখনো শেষ করতে পারিনি। কী বলবো একে? ঢাকা থেকে মেজদা বিষয়টা জেনে লিখেছে, চট্টগ্রামের লোকরা এমনই। তাকে লিখি, সবাই না।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠান আয়োজনের পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন প্রেস ক্লাব প্রেসিডেন্ট সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা ও সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক। দুজনেই আন্তরিকতার সাথে রাজি হয়েছিলেন যখন তাদের কাছে এই অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। আরো যারা সক্রিয় ভাবে শুরু থেকে সহযোগিতা করে চলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম, ঢাকায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজা জেসমিন ও চট্টগ্রামে বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার দত্ত। ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার দত্তেরও রয়েছে ব্যথাভরা স্মৃতি। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাকে ও তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় হানাদার পাক বাহিনী। শারীরিক নির্যাতনের পর তিনি ভাগ্যক্রমে ছাড়া পেয়ে গেলেও, জীবন নিয়ে ফিরতে পারেননি তার বাবা। তিনি পাক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। সেই যে ক্ষত বুকে ধারণ করে এখনো এগিয়ে চলছেন ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করা মেধাবী ছাত্র ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার দত্ত তা টের পাই জেনোসাইড ইস্যুতে তার কমিটমেন্ট ও নিরলস পরিশ্রম দেখে। দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায়, বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমে এই বিষয়ে তিনি বেশ কিছু লেখা লিখেছেন, যা প্রশংসিত হয়েছে। একই কষ্ট বহন করে চলেছেন আসিফ মুনীর, তৌহিদ রেজা নূর এবং এনাদের মত আরো কত জানা–অজানা পরিবারের সদস্য। তাদের কেউ বাবা হারিয়েছেন, কেউ মা, কেউ বা বোন, অনেকে গোটা পরিবার। যারা এই দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছেন কেবল তারাই অনুক্ষণ টের পান কী তীব্র তাদের যন্ত্রণা, ব্যথা, কষ্ট। ডাচ সাংসদ হেরি ফান বোমেল যিনি দিন কয়েক বাদে বাংলাদেশ সফরে আসবেন একাত্তরের জেনোসাইড নিয়ে তার লেখা এক প্রবন্ধে বলেন, ‘এই সমস্ত পরিবারের সদস্যদের প্রিয়জন হারানোর কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে, যদি একাত্তরের গণহত্যা ও জেনোসাইডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হয় এবং বিশ্ব এই জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেয়’।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট