রাজা আসে রাজা যায়। ইংল্যান্ডে রানী গেলেন প্রায় মাস আটেক আগে, ৯৬ বছর বয়সে। কেবল সিংহাসন ছেড়ে নয়, তার বিশাল সাম্রাজ্য, সম্পদের পাহাড় ছেড়ে এমন কী এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে তিনি চলে গেলেন ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, চিরকালের তরে। বৃটিশ মসনদে এলেন তার ৭৪ বছরের সন্তান, চার্লস। রানী হিসাবে নয়, রাজা হিসাবে। ইংল্যান্ডের নূতন রাজা চার্লস তৃতীয়। রাজাকে বরণ করে নেবার অনুষ্ঠানটিও ছিল এক বিশাল যজ্ঞ। রাজার অনুষ্ঠান বলে কথা। একেবারে এলাহী কাজ–কারবার। বৃষ্টি ও মেঘলা আবহাওয়াকে ভ্রুক্ষেপ না করে প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল রাজাকে বরণ করে নেবার অনুষ্ঠান দেখার জন্যে। রাজ পরিবার, পরিবারের সদস্য এবং রাজবাড়ীর প্রতি ইংরেজদের রয়েছে এক ধরনের অন্ধ ভালোবাসা। সে ভালোবাসায় ভাটা পড়তে শুরু করে নূতন রাজা চার্লসের প্রথম স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়ানার সাথে তার ও রানী এলিজাবেথের সম্পর্ক যখন মন্দের দিকে যেতে থাকে তখন থেকে এবং ডায়ানার মৃত্যুর পর তা বেড়ে যায়। জনগণের বিশাল একটি অংশের ধারণা, ডায়ানা রাজ পরিবারে সঠিক মর্যাদা পাননি এবং সেটি পাননি রানী এলিজাবেথ ও চার্লসের কারণে। বৃটিশ রাজ পরিবারের বর্তমান দশা অনেকটা বর্তমান বৃটেনের মত। দুশো–আড়াইশো বছর আগের সেই জৌলুস আর নেই। এক সময় একটা কথা প্রচলিত ছিল– বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত যায়না। এত বিশাল ছিল এই সাম্রাজ্য যে পৃথিবীর এক রাজ্যে সূর্য ডুবলে, আর এক রাজ্যে উঠতো। বৃটেনের সেই সোনালী দিন আজ আর নেই। কৌতুক করে আমার ইংরেজ বন্ধুদের বলি, এখন তোমাদের আছে কেবল বৃটেন, গ্রেট বৃটেনের ‘গ্রেট’ গেছে টাইটনিকের মত ডুবে, অনেক আগে। ইংরেজরা আমাদের শাসন করেছে দুশো বছরেরও বেশি। কেবল শাসন বলি কেন, শাসনের পাশাপাশি শোষণ, নির্যাতন করেছে সমানে, লুঠ করেছে আমাদের দেশের সম্পদ। ইংরেজদের যে ‘রাজমুকুট’ সেটিও তো ভারতবর্ষ থেকে লুট করে আনা। ইংরেজদের পক্ষে সাফাই গাওয়াদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, ‘তারা (ইংরেজ) ছিলেন বলেই আজ আমরা আধুনিক শিক্ষা–দীক্ষায় এগিয়ে আছি। না হলে আমাদের দশা হতো আফগানিস্তানের মত, যেখানে এখনো ছেলে–মেয়েদের সারিবদ্ধ মাটিতে বসে, মাথা সামনে–পেছনে দুলে–দুলে পুঁথি পড়তে দেখা যায়। তারা আরো যুক্তি দেখান এই বলে, ‘ইংরেজরা আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন করেছিলেন বলেই, রাজা রাম মোহন রায় থেকে শুরু করে রবি ঠাকুর, মধুসূদন দত্ত এমন অনেকেই বিলেত গিয়েছিলেন, রবি ঠাকুর ‘নোবেল’ ছিনিয়ে এনে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন’। অবশ্য, রাজা রাম মোহন রায় বিলেত গিয়েছিলেন ‘সতীদাহ প্রথা’ বাতিল করার জন্যে ইংরেজদের কাছে ধর্ণা দিতে। তার বিলেত যাবার বিরুদ্ধে সে সময় ভারতীয় সমাজ উঠে পড়ে লেগেছিল। যখন রাজা রাম মোহন রায় বিলেত যান, সে সময় ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল যে, একজন হিন্দুর সমুদ্র পাড়ি দেয়া পাপ। ভারত ছেড়েছে ইংরেজরা, সে আজ থেকে ৭৬ বছর আগে, ১৯৪৭ সালে। আর আজ ইংরেজদের দেশ শোষণ নয়, শাসন করছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত রাজনীতিবিদ, ঋষি সুনাক। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ।
যাই হোক– লন্ডন যখন এসে পৌঁছি তখন কিন্তু রাজ্যাভিষেক নিয়ে নগরীতে তেমন সাজসাজ রব চোখে পড়েনি। কেবল হল্যান্ড ফেরার দিন স্ট্যান্সটেসড এয়ারপোর্টে মাঝারি আকারের বিলবোর্ডে রাজ্যাভিষেককে ঘিরে ইউনিয়ন জ্যাক সহ কিছু বাণী, স্লোগান। বাড়াবাড়ি কিছু নেই। রাজাকে স্বাগত জানাতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে যেমন সেদিন প্রচুর লোকজন উপস্থিত ছিল, ঠিক তেমনি সংখ্যায় কম হলেও রাজা ও রাজতন্ত্রকে পছন্দ করেন না তেমন অনেকেই ছিল উপস্থিত। ‘তুমি আমার রাজা নও’, ‘রাজতন্ত্র চাই না’, এই ধরনের লেখা সম্বলিত ব্যানার সহ অনেকেই প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন উচ্চৈস্বরে। একটি ব্যানার ছিল বেশ মজার। তাতে ইংরেজিতে লেখা– The only Good King is Burger King অর্থাৎ “বার্গার কিং হলো একমাত্র ভালো কিং”। নিরাপত্তা রক্ষীরা তাদের বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াতে দেননি। চ্যাংদোলা করে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয়। পুলিশের এই আচরণে অনেকেই নিন্দা জানিয়ে বলেন, আমরা কথা বলার অধিকার হারিয়েছি।
এখন দেখা যাক, নতুন রাজা চার্লস তৃতীয় তার প্রজাদের মাঝে কেমন জনপ্রিয়? কিংবা তিনি আদৌ জনপ্রিয় কিনা? এমনিতে দীর্ঘদিন ধরে রাজপরিবার ও রাজতন্ত্রের উপর সাধারণ জনগণের আস্থা কমতে শুরু করেছে। অনেকেই মনে করেন একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাজতন্ত্র মানায় না। আর বৃটিশ প্রজাদের মাঝে নতুন রাজা চার্লসের জনপ্রিয়তা তো একেবারে তলানীতে। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে এক গবেষণায় মোট ১১টি কারণ দেখানো হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম, ডায়ানার সাথে চার্লসের বিবাহোত্তর–সম্পর্ক। প্রিন্স চার্লস প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে বিয়ের পরও তার সাথে ক্যামিলা পার্কারের সম্পর্ক ছিল। ক্যামিলা বর্তমানে ইংল্যান্ডের রানী, চার্লস তৃতীয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। অন্যদিকে তার প্রাক্তন স্ত্রী ও তার দুই সন্তানের মা, প্রিন্সেস ডায়ানা এখনো সর্ব সাধারণের হৃদয়ে রয়েছেন। তারা চান ডায়ানার সন্তান উইলিয়াম রাজ সিংহাসনে বসুক, চার্লস নয়। উইলিয়ামের স্ত্রী কেইটের মিষ্টি চেহারা, তার পার্সোনালিটি, পোশাক, আভিজাত্যের ছাপ, তার সব কিছুর মাঝে তারা প্রিন্সেস ডায়ানাকে খুঁজে পান। যে ১১টি কারণ দেখানো হয়েছে তার মধ্যে আরো হলো, চার্লস রাজা হিসাবে উপযুক্ত নন, ডায়ানার মাঝে যে চার্ম ও উষ্ণতা ছিল তা চার্লসের মাঝে নেই, তিনি ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্নব’, অর্থাৎ নাক–উঁচু স্বভাবের। পশুদের প্রতিও তার তেমন ভালোবাসা নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজা চার্লস রাজ সিংহাসনে বসলেন এমন এক সময় যখন কমনওয়েলথ–ভুক্ত রাষ্ট্রগুলির অনেকে বৃটিশ রাজতন্ত্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার চিন্তা ভাবনা করছে। এই তথ্য প্রকাশ করে দি ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের বারবাডোস রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রানী এলিজাবেথকে ২০২১ সালে সরিয়ে ফেলে এবং প্রায় ৪০০ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেকে প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা দেয়। অস্ট্রেলিয়ায়ও একই সুরের ধ্বনি শোনা যায়। জানা যায় সেখানেও জনমত নতুন রাজার পক্ষে তেমন জোরালো নয়। প্রশ্ন, রাজার ভূমিকা রাষ্ট্রে আদৌ কতটুকু? রাজার ক্ষমতা কী? রাজতন্ত্রে, যা যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, রাজা বা রানী হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। তবে যুক্তরাজ্যে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থাকায়, আইন প্রণয়ন ও আইন পাস করার ক্ষমতা রাজার পরিবর্তে সংসদের। সরকারে রাজার যে ভূমিকা তা হলো প্রতীকী। রাজা বা রানী ফি–বছর সংসদ উদ্বোধন করেন তার ভাষণের মধ্যে দিয়ে। সরকার যখন কোন বিল পাস করেন তখন তিনি অনুমোদন না দেয়া পর্যন্ত এটি আইনে পরিণত হতে পারে না। এই প্রক্রিয়া ‘রাজকীয় সম্মতি’ হিসাবে পরিচিত। বাস্তবে, ১৭০৮ সাল থেকে কোনো রাজা রাজকীয়–সম্মতি দিতে অস্বীকার করেননি. কেবল সেই সময় রানী অ্যান মন্ত্রীদের নির্দেশে একবার তা করেছিলেন। জানা যায় প্রায় এক হাজারটিরও বেশি সংসদীয় বিল সংসদে অনুমোদিত হবার আগে তা রানী এলিজাবেথ দ্বারা ‘পরীক্ষা’ করা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে নতুন রাজা এই ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় নাক গলাবেন না। এই প্রসঙ্গে ২০১৮ সালে চার্লস বলেছিলেন, তিনি সিংহাসনে বসলে সরকারি কাজে কোন ধরণের হস্তক্ষেপ কিংবা সাংসদদের সাথে কোন ধরনের ‘লবি‘ করবেন না। উল্লেখ্য, রাজা কোন ধরনের ইনকাম ট্যাক্স, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ক্যাপিটাল বা সম্পত্তির উপর কোন ট্যাক্স দিতে আইনগতভাবে বাধ্য নন। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার সাক্ষাৎ করে সরকারকে পরামর্শ দেবেন। আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি তার দেয়া ভাষণের মধ্যে দিয়ে সংসদের কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। তবে তার সে–বক্তব্য তৈরি করে দেবে ক্ষমতাসীন সরকার। মূলতঃ তাকে চলতে হবে প্রধান মন্ত্রীর পরামর্শে। বড় প্রশ্ন, রাজা কি চাইলে প্রধান মন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারেন? টেকনিক্যালি রাজা চাইলে তা পারেন। এমনটি একবার ঘটেছিল ১৮৩৪ সালে যখন রাজা ইউলিয়াম চতুর্থ লর্ড মেলবোর্নকে বরখাস্ত করেছিলেন এবং স্যার রবার্ট পীলকে সরকার গঠন করতে বলেছিলেন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের সরকার ও সংবিধানের অধ্যাপক, রবার্ট হ্যাজেল দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাজা একজন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারেন যদি তিনি অনাস্থা ভোটে হেরে যাবার পরও পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। তবে তিনি এমনটি তখনি করবেন যখন হাউস অফ কমন্স স্পষ্টভাবে বরখাস্তকৃতের স্থানে কাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেয়া উচিত তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন। এই নিয়ে আরো লেখা যেতে পারে, তাতে লেখার পরিসর কেবল বাড়বে, বাড়বে পাঠকের বিরক্তি। তাই এখানেই আপাতত ক্ষান্ত দেয়া। সবশেষ : লন্ডন থেকে ফিরবো, তার দিন দুয়েক আগে দেখা আরিশ ও মাদিয়ার। এদের একজন বাংলাদেশী–ডাচ–বৃটিশ, অন্যজন জন্মসূত্রে বৃটিশ, বাংলাদেশি মা–বাবার ঘরে। একজন কথা বলে প্রচুর, ক্ষণে ক্ষণে রাগ, অন্যজন কথা একেবারেই বলে না। দুজনের মাঝে কী অদ্ভুত বৈপরীত্য। আগামী সংখ্যায় লিখবো এদের নিয়ে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট