দিন কয়েক আগে নিস্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হয়েছিল। অনুষ্ঠান ছিল বিশ্ব অটিজম সচেতনা দিবস উপলক্ষে। চলতি বছরের বিষয় হলো, ‘রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্বগঠন’। কঠিন বাংলা– আমার মত অনেকেরই এর মর্মার্থ বুঝে উঠতে সময় লাগবে। সেদিন সকালে বাসা থেকে বের হবো। ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা, সিনিয়র সাংবাদিক এম নাসিরুল হক ফোন করে জানতে চাইলেন কী করছি, কোথায় আছি। বললেন, চলে এসো টিআইসি–এ। কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল ‘টিআইসি’ কী তা বুঝে উঠতে। যখন বললেন রাইফেলস ক্লাবের পাশে তখন টের পেলাম।
অনেকের মত ওনারও বোধকরি বদ্ধমূল ধারণা যে দেশে এলে আমার কেবল বেড়ানোই হয়, এদিক–ওদিক ঘুরি। দেশে আসি বটে ঘনঘন, তবে সে বেড়ানোর কারণে নয়। আমার ব্যাপারটা ‘রথ দেখা কলা বেচার মত’। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘোরা, আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া।
নাসির ভাইকে হতাশ করে বলি, ‘আমার অন্য কাজ আছে, সময় পেলে একবার ঘুরে আসবো’। কিন্তু একবারও বললেন না কেন যেতে বলছেন, কী হেতু, অথচ এরপর একবার নয়, বার কয়েক ফোন করে জানতে চাইলেন কোথায়, আসছি কিনা। হাতের কাজ অর্ধ–সমাপ্ত রেখে যখন চট্টগ্রাম থিয়েটার ইন্সিটিটিউট চত্বরে পৌঁছি দেখি সেখানে বাইরে বেশ কটি প্রাইভেট কার, মাইক্রো দাঁড়িয়ে। সিঁড়ি, লিফটের প্রবেশ মুখে ব্যানার, ফেষ্টুন দিবসকে ঘিরে। ফোন করতেই বললেন লিফটের তিনে চলে এস। লিফটের ভেতরে গিয়ে তিন খুঁজি, দেখি কেবল দুই, তিনের কোন অস্তিত্ব নেই। বের হয়ে লিফটের মুখে দেখি নাসির ভাই দাঁড়িয়ে।
আক্ষরিক অর্থে হাত ধরে, যেন কোন অটিস্টিক শিশু, আমায় মঞ্চে নিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো এক মহিলা, পরে জেনেছি নাম কানিজ ফাতেমা লিমা, তার পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ভেতরে ভেতরে একটু ‘আন–ইজি’ ফিল করছিলাম। বিষয়টা উনি আগে বললেই পারতেন। কোন অনুষ্ঠানে কিছু বলতে গেলে কিছুটা মানসিক প্রস্তুতিরও তো প্রয়োজন। ইতিমধ্যে প্রকৃতির খামখেয়ালির কারণে ভিন্নভাবে জন্ম নেয়া শিশু–কিশোরদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে।
মঞ্চে যখন আমাকে হাত ধরে দাঁড় করানো হলো তখন প্রধান অতিথি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম সহ অন্যান্য অতিথিদের ফুলের মালা ও কিছু উপহার সামগ্রী দিয়ে বরণ করে নেয়া হচ্ছিল। সবাই মঞ্চে দাঁড়িয়ে। তাদের সাথে আমিও।
সামনে দর্শকের সারিতে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেই। এক ঝাঁক শিশু–কিশোর তাদের মা–বাবা, নিকট জনের সাথে চেয়ারে বসা। প্রথম দেখায় মনে হবে আর পাঁচ–দশটা স্বাভাবিক ছেলে–মেয়েদের মত এরা। কিন্তু একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, এদের মাঝে কিছুটা অস্বাভাবিকতা আছে, কারো একটু বেশি, কারো কম। কোন কোন মা–কে দেখলাম তাদের অস্থিরমতি সন্তানদের আসন থেকে উঠে গিয়ে টেনে পাশে বসাচ্ছেন।
আবার এদের কাউকে কাউকে দেখলাম কী চুপচাপ, আসনে বসে আছে, কোন বিরক্তি নেই, কোন অস্থিরতা নেই। যে অদৃশ্যমান ‘বিরাট শিশু’ আনমনে তার অদ্ভুত খেলার জন্যে এই সমস্ত শিশুদের এইভাবে জন্ম দিয়েছে তার কথা ভাবি। কেন এমনটি হবে? মেলেনি উত্তর। মনে মনে কেবল আওড়েছি– ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে/বিরাট শিশু আনমনে,/প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা/নিরজনে প্রভু নিরজনে’। জানলাম বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জনে এক থেকে তিন শিশু ‘অটিজম–বৈশিষ্ট সম্পন্ন’ এবং মেয়েদের চাইতে ছেলেদের মাঝে অটিজম হয়ে থাকে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি।
সেদিনের অনুষ্ঠানে জানতে পারি, গোটা বিশ্বে প্রায় এক কোটি লোকের অটিজম হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের এক সরকারি পরিসংখ্যানে জানা যায় সামপ্রতিক বছরগুলিতে অটিজমের বিস্তার বেড়েছে ১০ থেকে ১৭ শতাংশ। এই যে বেড়ে যাবার প্রবণতা তার কোন নির্দিষ্ট কারণ জানা না থাকলেও, উন্নত ও যথাযথ রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়ার অভাব, পাশাপাশি পরিবেশগত প্রভাব এর জন্যে দায়ী বলে নিষ্পাপ অটিজম ফাউডেশনের এক রিপোর্টে জানতে পারি। পরিস্থিতি যে ভয়ানক তা বলা বাহুল্য। কেননা যে পরিবারে অটিজম–সিম্পটম নিয়ে শিশু জন্মায় সে পরিবারের উপর নেমে আসে ঘনঘোর অন্ধকার।
গোটা পরিবারের উপর বিশেষ করে অটিস্টিক শিশুর মা–বাবার উপর মানসিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক, এমন কী সামাজিক চাপ একটা সময় অসহনীয় হয়ে উঠে। অতি কাছ থেকে আমি দেখেছি এমনি এক অটিস্টিক কিশোরীকে। সে কথা বলতে পারতো না, মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ করতো। জন্মের পর তার মা–বাবা নিশ্চয় পরম আদরে তার একটি সুন্দর নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সেই নামটি আমার মত, আমার মামার বাড়ির গ্রামের– কেউ বোধকরি জানতো না।
তাকে সবাই, এমন কী তার নিকট আত্মীয়রা ডাকতো ‘বোবানি’। অদৃশ্যমান অথচ ‘অমনিপোটেন্ট’ ও ‘অমনিপ্রেজেন্ট’ বিরাট শিশুর খামখেয়ালির কারণে যে শিশুটির এই দশা তাকে সারাটা জীবন এই দুর্বিষহ বোঝা, গ্লানি বইতে হয়েছে। জানিনে আমার কিশোর বয়সে দেখা সেই ‘বোবানি’ এখন কোথায়, কেমন আছে, বেঁচে আছে কিনা, কিংবা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে কিনা। মরে গিয়ে বেঁচে আছে কিনা এই কথাটা এই কারণে বলছি যে আমাদের এই নিষ্ঠুর সমাজে সে এতটুকু স্নেহ, এতটুকু করুণা, এতটুকু ভালোবাসা পায়নি, সমাজ ব্যবস্থা তাকে পেতে দেখিনি। আজ এতটা সময় পেরিয়ে এসে আমার নিজের মনে প্রশ্ন জাগে– যখন এই কিশোরীটিকে দেখেছিলাম সে সময় আমার মনে কি ওই ‘বোবানির’ জন্যে কোন মায়া, ভালোবাসা জন্মেছিল? জানিনে। কেবল মনে মনে প্রার্থনা করি যদি সে এখনো বেঁচে থাকে সে যেন ভালো থাকে।
সুখের বিষয় দিন বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের চিন্তাধারা। অস্বাভাবিকভাবে জন্ম ও বেড়ে–উঠা এই সমস্ত নিষ্পাপ শিশুদের এক সময় মনে করা হতো সমাজে অপাংতেয়। এখন তেমনটি হয়না। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে, মানুষের চিন্তাধারার মাঝেও পরিবর্তন আসছে। এই সমস্ত শিশু–কিশোরদের জন্যে চাই তিনটি বিষয়। তা হলো, ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা। এদেরকে মায়া, স্নেহ, আদর–যত্ন নিয়ে মূল–ধারায় ফিরে আনার তাবৎ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে জন্ম নেয়া নিষ্পাপ শিশু প্রসঙ্গে প্রধান অতিথি এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, অনেকে এদের লক্ষ্য করে বলেন ‘পাগল’। কিন্তু এরা তা নয়। বরঞ্চ আমরা সমাজে যারা নিজেদের স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে করি, দাবি করি, আমরাই অনেক সময় পাগলের মত আচরণ করি। অন্যের ক্ষতি করি।
এই নির্বোধ শিশু–কিশোররা তা করেনা। এরা অন্যের ক্ষতি করেনা। তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষ কিছু না কিছু প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। এদের অনেকের মাঝে প্রতিভার যে বিকাশ দেখেছি, তা অনেক স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে নেই। আসলেও তাই। আমি এবং আমার মত অনেকেই অবাক হই যখন নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারি ইঞ্জিনিয়ার ঝুলন দাসের কিশোর ছেলেটি কী চমৎকার সুরেলা কণ্ঠে পুরো গান গেয়ে শোনালো।
সে এতটুকু আঁটকালো না কোথায়ও, গানের মাঝে। অথচ আমি তা কল্পনাও করতে পারিনা। শুধু তাই নয়, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ডাক্তার বাসনা মুহুরী জানালেন, এই শিশুদের তৈরি খেলনা, পেইন্টিংস, পুঁতির মালা ইত্যাদি গেল মেলায় বিক্রি করে আশি হাজার টাকা আয় হয়েছে।
ভাবতেই অবাক লাগে। আমি দেখেছি অতি কাছ থেকে তাদের আঁকা পেইন্টিংস। সে বছর কয়েক আগের কথা, যখন প্রথমবারের মত নিষ্পাপ সেন্টারে যাই, পরিচিত হই তাদের কার্যক্রমের সাথে। শুনে খুব ভালো লেগেছিল যে চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির মেয়র থাকাকালীন গোটা সময়টা তার মাসিক বেতনের পুরোটাই দান করেছিলেন এই নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনে। দেশে অনেক অর্থবান রয়েছেন।
প্রাক্তন মেয়র নাছিরের মানবিক উদারতায় অনুপ্রাণিত হয়ে সবাই না হলেও যদি কেউ কেউ এগিয়ে আসেন তাহলে সমাজে অবহেলিত ও একপাশে রেখে দেওয়া গোষ্ঠীর কল্যাণে অনেক কাজ করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস। কেবল মিথ্যে ‘আশ্বাসবাণী’ শোনানো নয়, বাস্তবে তা করে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। আশা করবো জেলা পরিষদের নতুন চেয়ারম্যান ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে উদার হস্ত বাড়িয়ে দেবেন। সুখের বিষয় এই ব্যাপারে তিনি তার আশ্বাসও দিয়েছেন সেদিনের অনুষ্ঠানে।
পিতামাতা–সন্তানের সম্পর্ক প্রতিটি শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশকে লালন করে। এই সম্পর্ক একটি অনন্য বন্ধন, যা প্রতিটি শিশু ও মা–বাবা উপভোগ এবং লালন পালন করতে পারে। এই মধুর সম্পর্ক শিশুর ব্যক্তিত্ব, জীবনের পছন্দ ও সামগ্রিক আচরণের ভিত তৈরি করে। আমরা টাকার পেছনে অন্ধের মত ঘুরি, ভাবি সন্তানদের জন্যে অঢেল সম্পদ, অর্থ রেখে যেতে পারলেই জীবনের সার্থকতা, পিতা–মাতার সার্থকতা বলে মনে করি। অথচ পিতা–মাতার সর্বোত্তম উত্তরাধিকার বা ইনহেরিটেন্স হলো– প্রতিদিন তার সময়ের কয়েকটা মিনিট সন্তানের জন্যে ব্যয় করা।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট