‘দাঁড়াও পথিক বর’। যথার্থ বাঙালি যদি তুমি হও
ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধি স্থলে।
এখানে ঘুমিয়ে আছে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা,
এদেশের মুক্তিদাতা, বাংলার নয়নের মণি।
শত দুঃখ জ্বালা স’য়ে, জীবনের বিনিময়ে যিনি
বাঙালির দিয়ে গেছে স্থান, বিশ্বের দুয়ারে।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাধি প্রাঙ্গণ প্রবেশ মুখের (গেইটের) একদিকের দেয়ালে ৩৩ লাইন কবিতার কিছু অংশ। ‘একটি অমর সমাধি’ শিরোনামে এই কবিতার লেখক সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদ, ১৯৮৪ সালের ১৪ জুন তারিখে লেখা। অনেকের মত আমিও ক্ষণিক দাঁড়িয়ে পুরো কবিতা পড়ি। গা শিহরিত হয় এই ভেবে এই স্থানে চির শায়িত বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, এদেশের মুক্তিদাতা, বাংলার নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমার সাথে ১১ বছরের তুষার। ঢাকার এক স্কুলে পড়ে, সম্পর্কে আমার নাতী। তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘জানো ইনি কে?’ একটু একটু, তার উত্তর। এর পর বলে, ‘ওনার নাম কি খোকা’? টের পাই ভালো করে জানেনা। সংক্ষেপে তাকে বলি এই খোকার কাহিনী। খোকা থেকে কী করে তার গোটা জাতির পিতা বনে যাওয়া এবং তার নির্মম জীবন-সমাপ্তির ইতিহাস। এগিয়ে যাই গেইট গলিয়ে। ভেতরে ঢুকতেই এক ধরনের নীরবতা, যেন পঁচাত্তরে শুরু হওয়া নীরব কান্না এখনো ভেসে বেড়ায় প্রকৃতি-ঘেরা খোকার সমাধিস্থলে। গেইটের বাইরে বঙ্গবন্ধুর ছবি-সম্বলিত বড় সাইনবোর্ড, বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা- ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধি’।
অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম দেশের এই মহান সন্তানটির শেষ আশ্রয়স্থলটিতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসবো। সময় কিছুতেই সময় করে দিচ্ছিল না, এই স্থানটিতে ঘুরে আসতে। ঢাকা এসেছি বিশেষ কাজে। বছরের শেষ দিন হওয়ায় সব অফিস-ব্যাংক বন্ধ। ভাইপো ঋত্বিক প্রস্তাব রাখলো পদ্মা সেতু ঘুরে আসার। পদ্মা সেতুর কাছাকাছি গিয়ে সে বলে, এদ্দুর যখন এলাম তখন টুঙ্গিপাড়া ঘুরে এলে কেমন হয়। তার প্রস্তাব লুফে নেয়া হলো। উত্তরা চার নম্বর সেক্টরে তার বড়সর ফ্ল্যাট। কাছেই থাকে ছোট বোন মনিকা, ডাকনাম মানী। বাবা যে কেন আমার এই ছোট বোনটির নাম মানী ডাকনাম রেখেছিলেন জানিনে। কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি, যখন জিজ্ঞেস করার সুযোগ ছিল তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। মাকেও না। এখন ওদের দুজনের কেউ নেই। যাই হোক, মানী তার স্বামী সুবীর সহ ঋত্বিকের বাসায় এলো সকাল সাড়ে আটটায়। কথা ছিল ন’টার মধ্যে বেরুবো। কিন্তু বেরুতে বেরুতে দশটা বেজে গেল। আমাদের দল ভারী। ঋত্বিকের কিশোর-বয়েসী দুই ছেলে- সৌর ও তুষার, ওদের মা এনি, চালক ঋত্বিক, পাশের সীটে লেখক। চমৎকার এলাকা উত্তরা। আমার গায়ে কেবল শার্ট, অন্যদের গায়ে শীতের কাপড়।
গাড়ি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে পদ্মা ব্রিজের দিকে। পদ্মা সেতু পেরিয়ে টুঙ্গি পাড়ার দিকে যেতে পুলিশ ইশারায় গাড়ি থামালো। ঋত্বিকের লাইসেন্স, গাড়ির ডকুমেন্ট চাইলো। পুলিশ জানালো স্পীড লিমিট ছিল ৬০ কিন্তু গাড়ির গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৮৩ কিলোমিটার। অতএব, জরিমানা। জরিমানা দিতে ঋত্বিকের আপত্তি নেই। কিন্তু পুলিশ ততক্ষণে ‘কেইস’ করে দিয়েছে। তার মানে ওকে আবার এই গোপালগঞ্জ থানায় আসতে হবে লাইন্সেস ফিরিয়ে নিতে। অগত্যা সে তার খুব কাছের, পরিচিত ডিসি ট্রাফিককে কল করে পুলিশকে ফোনটা ধরিয়ে দেয়। পুলিশ অপরাধীর সুরে ঋত্বিককে বলে, ‘আপনি শুরুতে যদি স্যারের কথা বলতেন তাহলে আমরা তো কিছু করতাম না। এখন তো কেইস দিয়ে দিয়েছি’। ঋত্বিক বলে, আপনারা জরিমানা নিন, সেটি আমি দিচ্ছি, কিন্তু ‘কেইস’ ক্যানসেল করেন। পুলিশ তাই করলো এবং বারবার বলতে লাগলো, আপনি যদি প্রথমেই স্যারের কথা বলতেন তাহলে আমরা কিছুই করতাম না। মিনিট পনের পর আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করে টুঙ্গিপাড়ার দিকে। ঋত্বিক একটু সংযত হয়। তারপরও বলে, এমন রাস্তায় ৬০ কিলো চালালে কেমন লাগে।
পদ্মা সেতু- আমার প্রথম আসা। তাই কিছুটা কৌতূহল ছিল। এই সেতুকে নিয়ে কী না হইচই গেল। মাস ছয়েক আগে, জুন-জুলাই নাগাদ, তখন আমরা দেশে। পুরো ঢাকা রঙিন সাজে সেজেছিল। অনেকে এই সাজ-গোজকে বাড়াবাড়ি বলে সরকারের সমালোচনা করেছিল। বিশেষ করে এমন একটা সময় তা হয়েছিল যখন কেবল বাংলাদেশে নয়, গোটা ইউরোপ-জুড়ে বিদ্যুতের সাশ্রয়ে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। তা যে যাই বলুক এ কথা অনস্বীকার্য যে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের উন্নয়নে একটি মাইল-ফলক। প্রমত্ত পদ্মার উপর বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু (৬.১৫ কিলোমিটার), যা পদ্মা বহুমুখী সেতু হিসাবে পরিচিত। এর উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ১২০ মিটার (৩৯০ ফুট) গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু। আরো উল্লেখ করার মত যে এটি নির্মিত হয়েছে নিজ অর্থায়নে, যা বর্তমান সরকারের জন্যে ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকা থেকে মাওয়া প্রান্তে টোল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুতে আরোহণ করে এর উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশে এমন একটি সেতু ভাবতেই অজানা ভালোলাগায় পেয়ে বসেছিল। কেবল এই সেতু নয়, সেতুকে ঘিরে এর আগে ও পরে অনেকটা পথ এক কথায় অপূর্ব। আমাদের গাড়ি যখন দ্রুত বেগে পদ্মার উপর দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মনেই হচ্ছিলনা বাংলাদেশে আছি।
যাই হোক, সেতু অতিক্রম করে এক সময় আমাদের গাড়ি গোপালগঞ্জের দিকে এগিয়ে চলে। সড়কে বিভিন্ন পয়েন্টে স্পষ্ট অক্ষরে বাংলা-ইংরেজিতে দিক-নির্দেশনা যুক্ত সাইনবোর্ড এবং দূরত্ব। যশোর, টুঙ্গিপাড়া, পিরোজপুর, খুলনা ওই স্থান থেকে কতদূর তার উল্লেখ করে সাইনবোর্ড। তার একটিতে লেখা গোপালগঞ্জ, অন্যটিতে লেখা ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর-সমাধি, টুঙ্গিপাড়া । রাস্তার উপর দিক-নির্দেশনার জন্যে এটি আকারে ভারী। এটি আরো সংক্ষিপ্ত হতে পারতো। হতে পারতো, ‘বঙ্গবন্ধুর সমাধি, টুঙ্গিপাড়া’। তাতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোন অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হতোনা বলে আমার ধারণা। গোটা পথ জুড়ে সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্যে চালকদের প্রতি বেশ অনেকগুলি সতর্কবাণী। তার একটিতে লেখা, ‘মুজিব বর্ষের শপথ নিন, সড়ক দুর্ঘটনাকে বিদায় দিন’। কোথায়ও কোথায়ও লেখা ‘সর্বোচ্চ ওজনসীমা ২৭ টন’। গোটা পথের দুধারে এখনো উড়ছে আর্জেন্টিনার পতাকা, আর্জেন্টিনা দলের ফুটবল-প্রেমীদের।
গোপালগঞ্জ প্রবেশমুখে রাস্তার একপাশে বড় আকারের সাইনবোর্ড, তাতে লেখা ‘স্বাগতম গোপালগঞ্জ জেলা, তার নীচে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। গাড়ি এগিয়ে চলে মকসুদপুর ছাড়িয়ে টুঙ্গিপাড়ার দিকে। আমাদের আপাতঃ লক্ষ্যস্থল, ‘সাম্পান’। রাস্তার ধারেই বড়সড় খাবারের দোকান। আকারে বড় কিন্তু খাবারে কোন চমক নেই। সাদামাটা। পুরো নাম, ‘সাম্পান হাইওয়ে ইন রেস্টুরেন্ট এন্ড পার্টি সেন্টার’। রেস্টুরেন্টের- সাইনবোর্ডে লেখা ‘হিরনকান্দি (শতবর্ষী আমগাছের বিপরীতে), কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ’। আমাদের কেউ কেউ স্যান্ডউইচ, চা খেলো, সাবধানতার কারণে আমি কেবল চা-বিস্কুট। এই ‘সাম্পানে’ একটু জিরিয়ে এগুতেই ঘটে বিপত্তি, পুলিশের হস্তক্ষেপ। তখনও গোপালগঞ্জ পৌঁছানোর ৩৩ কিলো বাকি, খুলনা ৮৭ কিলোমিটার দূরে, বাগেরহাট ৯০, মংলা ১০৫ কিলোমিটার দূর। একটা ব্যাপার ভালো লাগলো, তা হলো রাস্তার দু-ধারে মাঝারি-বড় আকারের গাছ। এক স্থানে চোখে পড়ে শেখ সেলিমের লাইফ-সাইজ পোস্টার, তাতে বড় অক্ষরে লেখা ‘শেখ সেলিম ভাইয়ের আগতম, শুভেচ্ছা স্বাগতম’। নিচে স্থানীয় এক নেতার ছবি, নাম মওদুদ হোসেন (রিন্টু)। আরো কিছুদূর এগুতে দেখি রাস্তার এধার থেকে ওধার তক তোরণ, তার উপর বড় আকারের নৌকা। লেখা ‘গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন ২০২২ সফল হোক’।
গোপালগঞ্জ মানেই যে আওয়ামী লীগ তা এখানে এসে মনে হলো। ততক্ষণে আমরা গোপালগঞ্জ পৌরসভায় পৌঁছে গেছি। আর যে ব্যাপারটি ভালো লাগলো তাহলো পথের অনেক স্থানে সতর্কবাণী। এক স্থানে বড় সাইনবোর্ডে লেখা, ‘কখনো না পৌঁছানোর চেয়ে দেরিতে পৌঁছানো ভালো, সড়ক বিভাগ গোপালগঞ্জ’। তখনও বঙ্গবন্ধুর সমাধি পৌঁছানোর ২০ কিলোমিটার বাকি। যখন টুঙ্গিপাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে পৌঁছি তখন দিনের মধ্যপ্রহর। প্রবেশমুখের একদিকে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে লেখা কবিতা, অন্যপাশে ফলক। তাতে লেখা, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাধি সৌধ প্রাঙ্গণ। উদ্বোধন করেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বুধবার ১০ জানুয়ারি ২০০১’। আমরা গেইট গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। বঙ্গবন্ধু গেইট। দুপাশে ভাস্কর মৃনাল হকের পরশে বঙ্গবন্ধুর রঙিন ছবি যেন হাসিমুখে বরণ করে নিচ্ছে সবাইকে। ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিঘেরা স্থিরচিত্র সম্বলিত জাদুঘর। সেখানে তার সংগ্রামী জীবনের নানা পর্যায়ের ছবি, দেশ-বিদেশের নানা পত্রিকার ক্লিপিং, তাকে নিয়ে আঁকা নানা শিল্পীর কাজ। এরই মাঝে একটি কাঠের ‘কফিন’। থমকে দাঁড়াই। এই সাদামাটা কফিনে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যার পর সামরিক হেলিকপ্টারে নিয়ে আসা হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায়। খানিক দাঁড়িয়ে দেখি এই কফিনটিকে। মনে মনে গেয়ে উঠি,
‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই,
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো,
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই, তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা,
আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।’
লেখক : সাহিত্যিক