হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চাইতেও মহীয়ান। জননী গেছেন সে প্রায় এক যুগ আগে। এখন আমার আছে কেবল জন্মভূমি। আর এই জন্মভূমিই নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টানে আমাদের বারবার। সবকিছু হাতের-মুঠোয়-পাওয়া দেশ থেকে এসে অনেক-কিছু-নাই-এর দেশে এসেও ভালো লাগে আমাদের। জন্মভূমির টানটাই আলাদা। এ যে নাড়ির টান। শেঁকড় যেমন কাঁদে জলকতার জন্যে, তেমনি আমাদের মন কাঁদে দেশের জন্যে। অনুক্ষণ। দেশ ছেড়ে যাদের বাইরে দীর্ঘকাল অবস্থান, তাদের মাঝেই এই হা-হুতাশ প্রকট হয়ে দেখা দেয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আমি আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে আমার জন্মস্থানকে ভালোবাসতাম। কিন্তু যখন আমি ফিরে এলাম তখন এর প্রতিটি ধূলিকতাও আমার কাছে পবিত্র মনে হয়।’ আমাদের দশাও বোধকরি অনেকটা তাই। ঢাকা নেমে অপেক্ষায় থাকি কখন চাটগাঁ যাব। আশির দশকে ঢাকায় কিছুকাল কাজ করেছি, তারপরও চাটগাঁর মত রাজধানী আমায় তেমন টানেনা। একসময় রাজধানী ঢাকা ছিল ‘তিলোত্তমা’। এখন ঢাকা ঢেকে গেছে ধুলো-বালি, যানবাহনের ভিড় আর তাবৎ অনিয়মের ভিড়ে। চট্টগ্রামে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবনের অনেকটা সময়। এই শহরে আমার জন্ম, বেড়ে উঠা। এবার ঢাকা নেমে দিন দুয়েক ঢাকায় ছিলাম। গুলশান এলাকায় যে সময়টা ছিলাম কিছুটা ভালো লেগেছে। তবে গুলশান তো আর সমগ্র-ঢাকা নয়। বন্ধু ও সহকর্মী জিয়া (জিয়াউল হক) এসেছে ব্যাংকক থেকে, দুই ছেলে সহ। ওরা ব্যাংকক থাকে স্থায়ীভাবে। জানালে, ঢাকা এয়ারপোঁর্ট থেকে গুলশান এক নম্বর তার নিজস্ব বাসায় যেতে সময় লেগেছে পাক্কা ছয় ঘন্টা। ভাবা যায়! ছয় ঘন্টায় হল্যান্ড থেকে আকাশ পথে নিউ ইয়র্ক যাওয়া যায়।
এবার দেশে আসা কিছু কাজ নিয়ে। গেল ১৪ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছিল মিটিং। বিষয় একাত্তরের ‘জেনোসাইড’। এর আগে ছিল প্রজন্ম একাত্তরের সাথে আলোচনা। একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে এই সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে দেশে-বিদেশে প্রশংসামূলক কাজ করে চলেছে। এই নিয়ে পরবর্তী কোন এক সংখ্যায় লেখা যাবে। ঢাকা ছেড়ে মিনিট ত্রিশ আকাশে উড়াল দেবার পর যখন চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে নামলাম, তখন মনে হলো যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বিমান বন্দর ছাড়িয়ে গাড়ি যখন নতুন রাস্তা ধরে শহরের দিকে বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে তখন মনে হলো দেশ সত্যি এগিয়ে চলেছে। আমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী-ভাগ্য সুপ্রসন্ন। ঢাকা পৌঁছার পরপর দৈনিক আজাদী সম্পাদক বয়জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম এ মালেকের সাথে আলাপ হলে তিনি বলেন এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠাবেন। ফোন করে বলেন, কেবল এক ঘন্টা আগে বলবেন, গাড়ি পাঠিয়ে দেব। গাড়ি পাঠাতে চেয়েছিলেন বন্ধু ড. সেলিম চৌধুরীও। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সিনিয়র ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। বিনয়ের সাথে তাদের না করেছি। কেননা কাউকে অহেতুক বাড়তি ঝামেলা দিতে চাইনে। নেহায়েৎ অপারগ হলে সে ভিন্ন কথা। বাসায় পৌঁছে কিছু খেয়ে কেবল বসেছি মাত্র। এমন সময় কলিং বেল। খুলে দেখি ড. সেলিম চৌধুরীর ড্রাইভার। হাতে দু-প্যাকেট। ড্রাইভার বলে, স্যার পাঠিয়েছেন। বাসায় কেউ নেই জেনে সেলিম ভাই হয়তো ভেবেছিলেন অভুক্ত থাকবো। তাই প্যাকেট ভর্তি তান্দুরি চিকেন, নানরুটি আর কেক পাঠিয়েছেন। আমাদের অবাক হবার পালা, মুগ্ধও। প্রায় প্রতিদিন ফোন করে খবর নিচ্ছেন কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা। প্রতিবারের মত পরদিন সকালে দৈনিক আজাদী অফিস। চাটগাঁ এসে দৈনিক আজাদী অফিসে না আসা তক যেন পেটের ভাত হজম হয়না। আগে ফোন করা ছিল। গরম কফির সাথে গপ্পো দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদক প্রাপ্ত প্রবীণ ও বিদগ্ধ সাংবাদিক এম এ মালেকের কামরায়। তার পাশের কামরায় বসেন সহযোগী সম্পাদক বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি প্রিয়ভাজন রাশেদ রউফ। তার কামরায় খানিক আড্ডা। বিদায় নেব, মালেক ভাই বলেন, ‘ওদিকে আমি যাচ্ছি, নামিয়ে দেব’। জানি তিনি সেদিকে যাচ্ছেন না, কেবল আমাকে ড্রপ দেয়ার জন্যে বলা। তার আন্তরিকতার অন্ত নেই। তাকে যত কাছ থেকে জানছি তত মুগ্ধ হচ্ছি। আজাদীর কেউ কেউ বলেন, ‘স্যার আপনাকে কেন জানি বেশ পছন্দ করেন।’ এই কথাটিই লিখলেন মিতভাষী আমার পছন্দের লোক রাশেদ রউফ। মালেক ভাইকে সাথে নিয়ে দৈনিক আজাদী অফিসে তোলা ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলাম। তাতে মন্তব্য করেছেন রাশেদ ভাই এইভাবে, ‘দাদা, আপনাকে পেয়ে ভালো লাগলো। আপনি তো জনপ্রিয় একজন লেখক। আপনার সান্নিধ্য আমরা উপভোগ করি। আমাদের মাননীয় সম্পাদক আপনাকে খুব পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। হল্যান্ডে আপনি খুব সম্মান দিয়েছেন বলে তিনি আমাদের জানালেন। আপনার কারণেই নাকি তাঁর ওখানে যাওয়া।’ সেটি আমিও টের পাই। গেল মাসে হল্যান্ডে তাকে বিদায় দিতে গিয়ে তিনি যখন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, তখন স্বাভাবিক সময়ের চাইতেও আরো একটু বেশি সময় ধরে রেখেছিলেন। বুঝি প্রায় সপ্তাহ খানেক একসাথে অনেকটা সময় কাটানো, বেড়ানো, গল্প-আড্ডা দেয়ায় এক ধরনের মায়া জন্মে গিয়েছিল। তার অফিসরুমে বসে আছি। চমৎকার একটি হাতঘড়ি দেখিয়ে মালেক ভাই বললেন, ‘ইউরোপ থেকে ফেরার পথে দুবাই থেকে কেনা। মেশিনারি পার্টস ছাড়া পুরোটাই গাছের।’ তার কয়েকটি শখের মধ্যে হাতঘড়ি একটি বলে জেনেছি সমপ্রতি তার উপর প্রকাশিত ‘অগ্রপথিক এম এ মালেক সম্মাননা স্মারক’ বইয়ে। লন্ডন থেকে সামাজিক মাধ্যমে নূরুন নবী লিখেছেন, ‘স্যার ভীষণ আন্তরিক ও ব্যক্তিত্ববান একজন মানুষ, রাশেদ রউফ ভাই তো অতুলনীয়।’ আসলেও তাই। ভালো মানুষের সাথে সময়টা কাটে ভালো।’
চাটগাঁ অনেক বদলে গেছে। এই বদল হয়তো যারা নিত্যদিন দেখছেন তাদের চোখে তেমন করে ধরা পড়ে না, যেমনটি পড়ে আমাদের চোখে। দেখে মনে হয়, মেয়েরা অনেক মুক্ত, স্বাধীন। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে রাস্তায়। অনেক স্থানে তরুণ-তরুণীরা রাস্তার ধারে বা গাছ তলায় পাশাপাশি হাত ধরে বসে গল্প করে চলেছে। দেখে ভালো লাগে। আমাদের সময় মেয়ে কিংবা বন্ধুনীর হাত ধরে প্রকাশ্যে রাস্তায় হেঁটে-বেড়ানো ছিল কল্পনারও বাইরে। প্রেস ক্লাবকে ঘিরে জামালখান এলাকা খুব ভালো লেগেছে। যেন কিছুটা ঢাকা-বিশ্ববিদ্যলয়ের মিনি টি এস সি এলাকা। ডিসি হিল প্রবেশ-মুখে নোটিশ টাঙানো- তাতে লেখা স্কুল-কলেজের ড্রেস নিয়ে ছেলে-মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। জানিনে তাতে নগরবাসীর কী প্রতিক্রিয়া। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের ঠেকানোর জন্যে এই ব্যবস্থা হবে হয়তো। তবে ড্রেস-বিহীন স্কুল-কলেজগামী ছেলে-মেয়েদের জন্যে কি উন্মুক্ত দ্বার? ডিসি হিলের উল্টোদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির। নগরীর অনেক কিছুর মত আগের সৌন্দর্য্য হারিয়েছে এই মন্দিরটি আকর্ষণও। বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের গৃহী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিবাদ-কলহ এই বৌদ্ধ মন্দিরের উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানতে পারি জনান্তরে। নগরীতে বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে যানবাহন। কেউ কেউ ঢাকার সাথে তুলনা করেন বটে। তবে আমি বলি, এখনো চট্টগ্রাম অনেক ভালো, বাসযোগ্য। চট্টগ্রামে দিনে চার-পাঁচটি স্থানে এমন কী তার চাইতেও বেশি জায়গায় কোন প্রোগ্রাম থাকলে যাওয়া যায়। ঢাকায় তা চিন্তার বাইরে। এদিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যখন এসে পৌঁছি তখন বিশ্বকাপকে ঘিরে দেশ-জুড়ে উত্তেজনা। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের সমর্থকই বেশি বলে মনে হলো। বিভিন্ন এলাকায় বড় স্ক্রিনের সামনে উত্তেজিত দর্শক খেলা উপভোগ করে চলে। অনেক রাতে মাঝে মাঝে চিৎকার, হইচই। শ্লোগান। কোথাও কোথাও ড্রাম, ঢোল, বাজি। ফাইনালের দিন যত কমে আসে সমর্থকদের মাঝে বাড়ে তত উত্তেজনা। উত্তেজনা ভালো, কিন্তু উম্মাদনা নয়। ফুটবলে আমার তেমন আসক্তি নেই। ফাইনাল সহ বড়জোর সর্বসাকুল্যে তিনটি কী চারটি খেলা দেখেছি। তবে অস্বীকার করিনে যে ফাইনাল দেখতে গিয়ে অনেকের মত আমার মাঝেও পেয়ে বসেছিল এক ধরনের উত্তেজনা। ফাইনালের দিন কয়েক আগে বন্ধু ড. সেলিম ঠিক করলেন, তার বাসায় ফাইনাল ম্যাচ দেখবো সবাই মিলে। সবাই বলতে সেলিম ভাই ও তার স্ত্রী এবং আমরা দুজন- আমি ও সুমনা। ঠিক হলো খেলা শেষে ডিনার। ধরে নিয়েছিলাম ৯০ মিনিট শেষে অর্থাৎ রাত এগারটার দিকে ডিনার সারবো। এক্সট্রা টাইম শেষে খেলা গড়ালো ‘টাই-ব্রেকারে’। সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে ডিনার টেবিলে যখন বসি তখন ঘড়ির কাঁটা ভোররাত পৌনে একে। স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়ে যেমন বাদাম, চানাচুর ইত্যাদি খাওয়া হয়, সেলিম ভাইয়ের বাসায় ফাইনাল দেখতে গিয়ে ডিনারের আগে আয়োজন ছিল নানা মুখরোচক খাবার। মজার ব্যাপার হলো তিনি আর্জেন্টিনার সমর্থক। অন্যদিকে লিজা ভাবি ব্রাজিলের। সেই কারণে ভাবি চাইছিলেন ফ্রান্স জিতুক। মজার ব্যাপার হলো, আর্জেন্টিনা যেই না গোল দিলো, অমনি উত্তেজনায় সেলিম ভাই দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। তা দেখে কিছুটা বিরক্তি সহ লিজা ভাবি বলেন, ‘দাঁড়ানোর কী আছে, বসে দেখো।’ খেলা শেষে যখন অনেক রাত, সেলিম ভাইয়ের গাড়ি করে বাসায় ফিরছি। ওয়াসার মোড়ে এসে থেমে যায় গাড়ি। সামনে গোটা রাস্তা জুড়ে, গাড়ি চলাচল বন্ধ করে চলে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের বিরক্তিকর উল্লাস আর উন্মাদনা। অবাক হই ওই গভীর রাতেও তরুণীদের হই-হুল্লোড় করতে দেখে। কিছুটা ভড়কেও গিয়েছিলাম। এক সময় মনে হয়েছিল ওরা বুঝি গাড়ির উপর হুমড়ি খেয়ে না পড়ে। মনে মনে খুব বিরক্ত বোধ করছিলাম। যে আনন্দ আর উচ্ছাস নিয়ে একটু আগে বিশ্বকাপ দেখেছিলাম তা যেন মিইয়ে আসে উচ্ছৃঙ্খল সমর্থকদের কারণে। বিশ্বকাপকে ঘিরে বাংলাদেশীদের এই উম্মাদনা বা উত্তেজনা প্রসঙ্গে অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু প্রশ্ন রাখেন এই বলে, ‘বাংলাদেশে ফুটবল উত্তেজনা, না কি তা উন্মাদনা?’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ফুটবল উন্মাদনা দেখে আমি অবাক হই। কোন একটি খেলাকে ভালোবাসার কোন দোষ আমি দেখি না, কারণ আমি নিজেও খেলা দেখে আনন্দ উপভোগ করি, কিন্তু উন্মাদনা মোটেও ভাল লাগে না। ইউরোপের কোন জায়গায়ই বাংলাদেশের মত এত উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে না। আর বাংলাদেশে তো উত্তেজনা নয়, এটি হচ্ছে উন্মাদনা। এই উন্মাদনা সেদিন হবে স্বার্থক যেদিন আমরা দেখবো এত ফুটবল-প্রেমী বাংলাদেশ, বিশ্বকাপে খেলার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।’ আমরাও সেদিনের অপেক্ষায়। আসবে কি সেদিন? কিছুই অসম্ভব নয়। আশায় বাঁধি ঘর।
লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅ্যাডভোকেট ননী দাশগুপ্ত : মানবহিত ব্রতে সমর্পিত যে জীবন
পরবর্তী নিবন্ধসরকার পতনে জনগণের স্বার্থ কোথায়?