একাত্তরের গণহত্যা
বিশ্ব কতটুকু জানে (শেষ পর্ব)
গেল সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম হল্যান্ডের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ইউরোপীয় ছাত্রীর কথা। তারা এসেছিল হেগ শহরে ইউরোপীয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) আয়োজিত ‘১৯৭১ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ শীর্ষক সম্মেলনে যোগ দিতে। অনুষ্ঠান শেষে তাদের দু’জন কাছে এসে নিজ পরিচয় দিয়ে বলে, ‘জানতাম না যে বাংলাদেশে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছিল। আজকের সম্মেলনে তোমার ব্যক্তিগত ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। তোমার প্রতি রইলো আমাদের সমবেদনা।’ স্রেফ বলার জন্যে যে বলা নয় সে তার পরের কথা শুনে টের পাই। ওদের একজন বলে, ‘আমরা লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি। তুমি তোমার বক্তব্যে বললে যে তোমরা চাও বাংলাদেশ সহ গোটা বিশ্বের পরবর্তী প্রজন্মের ‘ইতিহাস’ জানা দরকার এবং সেই লক্ষ্যে তোমরা কাজ করছো। আমরা যারা ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস’ আছি আমরা এই বিষয়ে আরো জানতে চাই এবং আমাদের সহপাঠিদের জানাতে চাই। তোমার পক্ষে কি সম্ভব হবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা?’ প্রস্তাবটি সাথে সাথে লুফে নিয়ে বলি, ‘নিশ্চয়ই, আমরা তো চাই বিশ্ব জানুক পাকিস্তানের সহিংসতার কথা, বাংলাদেশে একাত্তর সালে যে গণহত্যা চালিয়েছে তার কথা। আমরা চাই বিশ্ব ৭১-এর গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিক, পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করুক যাতে পাকিস্তান বিনা শর্তে ‘ক্ষমা’ প্রার্থনা করে।’ একাত্তরের গণহত্যার জন্যে যদি পাকিস্তানের শাস্তি হতো তাহলে তারা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৫০ বছর পরও তাদের নিজ দেশে বেলুচ, পশতুন, হাজেরা ও ধর্মীয় হিন্দু ও খৃস্টান সমপ্রদায়ের উপর হত্যা, নিপীড়ন চালিয়ে যেতে পারতো না। অপরাধের বিচার হয়নি বলে তারা (পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই) এখনো অপরাধ চালিয়ে যাবার সাহস পাচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষে কফি খেতে খেতে এর-ওর সাথে আলাপ চলে। হেগ শহরের মধ্যেই ডাচ সংসদ ভবন। এই ভবনে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস সেন্টার, রেস্টুরেন্ট, যেখানে মিলিত হন ডাচ রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অনুষ্ঠানের সপ্তাহ দুয়েক আগে সেখানে গেলে দেখা ও স্বল্প আলাপ হয় হল্যান্ডের বর্তমান প্রধান মন্ত্রী, ৫৫ বছর বয়েসী অকৃতদার মার্ক রুতের সাথে। গণহত্যা বিষয়ে আলোচনার জন্যে যে স্থানটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। বোধকরি সেই কারণে ‘করোনা’র নানা বিধিনিষেধ থাকা সত্বেও সম্মেলনে অংশ নেবার জন্যে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল আশাতীত। এক পর্যায়ে আমাদের কাউকে কাউকে ‘না’ করতে হয়, কেননা সম্মেলন কক্ষে দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রেখে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়েছে। একই পরিস্থিতি লাঞ্চের সময়ও। সে কারণে প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ নিজ থেকে হল সংলগ্ন রেস্তোরাঁ ছাড়াও পৃথক একটি বড় হলের ব্যবস্থা করেছিল।
বলছিলাম ইউরোপীয় তরুণীদের কথা। পরদিন সকালে ল্যাপটপ খুলে বসতেই দেখি মনজু ভন রোসপাতের ই-মেইল। সম্মেলনে যোগ দেবার সুযোগ করে দেবার জন্যে পুনরায় ধন্যবাদ জানিয়ে তরুণীটি লিখেছে, “আমি ইতিমধ্যে ইউনিভার্সিটিতে আমার কয়েক সহপাঠীর সাথে আলাপ করেছি এবং আমরা খুব এঙসাইটেড যে এই ধরনের একটি আয়োজনে আমরা যোগ দিতে পেরেছি। আমরা ইতিমধ্যে তিনজন মিলে একটি গ্রুপ তৈরি করেছি সম্মেলন প্রস্তুতির জন্যে। আমরা চাই বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত ‘আনহার্ড’ (শোনা যায়নি) বা ‘চেপে-যাওয়া’ হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যার তার প্রকাশ ঘটুক, বিশ্ব জানুক। ‘স্পটিফাই’ নামে আমাদের একটি অনলাইন-প্লাটফর্ম আছে যেখানে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা দিক তুলে ধরে আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাক্ষাৎকারের আয়োজন করে থাকি। আমরা খুশি হবো তুমি যদি আমাদের এই আয়োজনে এই মাসেই (২৩ ডিসেম্বর) একটি সাক্ষাৎকার দাও। তুমি তাতে একাত্তরের কথা বলবে, বলবে তোমার অভিজ্ঞতার কথা, পাকিস্তান কী করেছে তার বর্ণনা, পাশাপাশি তোমার সংগঠনের কথা, হল্যান্ডে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের সুখ-দুঃখের কথাও।” আমার কিছুটা অবাক হবার পালা। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ‘পোডকাস্টের’ লিংক পাঠিয়ে মেয়েটি লিখেছে, সময় পেলে তুমি শোন। আজ দুপুরে তাতে কয়েকটি সাক্ষাৎকার শুনলাম। তার মধ্যে একটি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ প্রসঙ্গ। ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০২২ সালের ২৬ মার্চ একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে হল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী সম্মেলনের আয়োজন করবে, আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে যাবতীয় সহযোগিতা দেব। তাদের এই আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হই। তাদের ধন্যবাদ জানাবো কী, তারাই আমায় উল্টো লিখেছে, হত্যাযজ্ঞের সাক্ষীদের কাছ থেকে সরাসরি ইতিহাস জানার এই সুযোগ পাচ্ছে, সেই জন্য আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
বাংলাদেশ গণহত্যার ইতিহাসকে জানার জন্যে তাদের মাঝে যে উৎসাহ ও আগ্রহ, তার ছিটেফোঁটাও দেখিনে আজকালকার বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীদের মাঝে। এদের মাঝে বিষয়টাকে জানার চাইতে ‘অনুষ্ঠানিকতাটাই’ বড় হয়ে দেখা দেয়। দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। দেশের চাইতে বিদেশে এই দশা আরো শোচনীয়। খুব কম মা-বাবাকে দেখি এই বিষয় নিয়ে প্রবাসে জন্ম ও বেড়ে উঠা সন্তানদের মাঝে ‘দেশকে জানার’ প্রবৃত্তিটা প্রোথিত করতে। হল্যান্ডে ভূতপূর্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, চট্টগ্রামের সফল সন্তান শেখ মোহাম্মদ বেলাল দূতাবাস অনুষ্ঠানে এই বিষয়টার উপর প্রতি বছর জোর দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনুরোধ জানাতেন, বাংলাদেশকে ঘিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাদের সন্তানদের সাথে করে নিয়ে আসতে। খুব কমসংখ্যক বাংলাদেশিকে তার এই আবেদনে সাড়া দিতে দেখেছি। এই ব্যর্থতা আমার, আপনার আমরা যারা প্রবাসে আছি যুগের পর যুগ ধরে, আমাদের সবার। আমাদের ঘরে, ড্রয়িং রুমে এই নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়। ইবিএফ সম্মেলনে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দীন যথার্থই বলেছেন, “বাংলাদেশ জেনোসাইড ইজ নট এ সাবজেক্ট অফ আওয়ার ডাইনিং-টেবিল।” আসলেও তাই। খুব কষ্ট হয়, দুঃখ হয়, খারাপ লাগে। আমার চোখের সামনে দেখেছি পাক হানাদার বাহিনী আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে এসে, বাড়ির কাউকে না পেয়ে ‘গান-পাউডার’ ছিটিয়ে দিয়ে বড় বাড়িটি জ্বালিয়ে দিতে। দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখেছি বাড়িটি, পেছনের পুকুর পেরিয়ে ধানক্ষেতের ভেতর প্রাণভয়ে বাবা ও আরো অনেকের সাথে লুকিয়ে থেকে। সেদিনই নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম আর এক গ্রামে। কী করে ভুলি সে দিনের কথা। কিংবা সেই মুহূর্তের কথা- যেদিন কালুরঘাট ব্রিজের দক্ষিণ দিকে শহরমুখী আমাদের ট্রেনটিকে পাক হানাদার বাহিনী থামিয়ে যাত্রীদের লাইন করে দাঁড় করালো। সেটি খুব সম্ভবতঃ মে-জুনের দিককার কথা। বাবা আমাকে ২৬ মার্চ সকালেই পিসতুতো ভাই বাদলদার সাথে নিরাপত্তার কথা ভেবে গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। শহরে জন্ম ও বেড়ে উঠা আমি সেই বয়সে বাবার সরকারি রেলওয়ে বাসা থেকে পায়ে হেঁটে সন্ধ্যেয় হাজির হয়েছিলাম পিসির বাড়ি, পটিয়ার উনাইনপুরা গ্রামে। একই গ্রামে মামার বাড়ি। বেশ কিছুদিন সে গ্রামে থেকে চলে যাই নিজ গ্রামে। সেটিও পটিয়ায়, নাম করল। ততদিনে মা-বাবা শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। এক সময় পাক-সরকার ঘোষণা দিয়ে সরকারি কর্মচারী যারা কাজ থেকে চলে গেছেন, তাদের সহসা কাজে যোগ দিতে বললে, অন্যথায় ‘ব্যবস্থা’ নেয়া হবে। পাক হানাদার বাহিনীর ‘ব্যবস্থা’ মানে হত্যা। বাবার জমানো টাকা ছিল না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন শহরে ফিরে যাবেন, কাজে যোগ দেবেন, যদিও বা তাতে প্রাণের ভয় ছিল। আমাকে সাথে নিলেন। পটিয়া রেল স্টেশন থেকে বাবার সাথে আমিও চললাম। কালুরঘাট ব্রিজে ওঠার আগে দাঁড় করানো হলো ট্রেন। যাত্রীদের নামিয়ে সারিবদ্ধ দাঁড় করানো হলো। পাক সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি যাত্রীর কাছে এসে তার কাঁধে হাত দিয়ে, প্রশ্ন করে দেখে কোনটি তাদের চোখে ‘মুক্তি’ অথবা ‘হিন্দু’। ভীত সন্ত্রস্ত যাত্রীদের কাউকে কাউকে তারা লাইন থেকে আলাদা করে নেয়। বাবার সামনে এসে, বাবাকে এক নজর দেখে আমাকে দেখে। বাবা ছিলেন হালকা-পাতলা গড়নের, আমি আরো। পাক সেনারা ধরে নিলো, এরা আর যাই হোক না কেন, মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেনা। আমরা বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়। অনেকের সে-যাত্রা ছিল শেষ যাত্রা। তাদের আর আমাদের মত নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছানো হলোনা। এতদিনের ব্যবধানে আজ ঠিক মনে নেই, সেই সময় আমার কিংবা বাবার মনের পরিস্থিতি কী ছিল। বাবা বোধকরি তার চাইতে তার এই তৃতীয় পুত্র সন্তানের কথাই বেশি ভাবছিলেন। বাবাকে আর সে-কথা কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। আজ দুঃখ হয় কেন সেদিন কিংবা এরপর বাবাকে সে কথা জিজ্ঞেস করিনি। এমনি ভীতিকর পরিস্থিতির মুখে আরো বার কয়েক পড়েছি একাত্তরে। সে কথা মনে এলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর, পাক শাসকদের উপর তীব্র ঘৃণা জাগে। কষ্ট হয় যখন দেখি এই শাসকগোষ্ঠী কোন বিচার ছাড়াই পার পেয়ে গেছে। কষ্ট হয় যখন দেখি, একাত্তরের যুদ্ধ না- দেখা আজকের প্রজন্ম এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন, উদাসীন তাদের অনেক মা-বাবা। অথচ বাংলাদেশ থেকে সহস্র যোজন দূরে উত্তর সাগর পাড়ের দেশ হল্যান্ডে বিভিন্ন দেশ থেকে পড়তে আসা কটি বিদেশি তরুণীর কী তীব্র আকাঙ্ক্ষা অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মাঝে যদি নিজ ইতিহাস জানার চেতনা জাগ্রত না হয়ে থাকে সে ব্যার্থতা আমাদের, আমরা যারা পূর্বসূরী তাদের, আমাদের দেশ যারা চালান তাদের, রাজনীতিবিদদের। দেশকে জানা, দেশকে ভালোবাসার প্রদীপ যদি আমরা আগামী প্রজন্মের মাঝে প্রজ্জ্বলিত করতে না পারি, তবে আমরা আরো আরো অনেককে দেখবো দেশের বিভিন্ন স্টেডিয়ামে, গায়ে পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের জার্সি আর হাতে চাঁদ-তাঁরা খচিত পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে উল্লাস করতে। এই পাকিস্তান আমাদের ১৯৪৭ সাল থেকে বাঙালিদের উপর শোষণ-শাসন করে এসেছিল, একাত্তরে ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, দুই লক্ষেরও বেশি মা-বোনের ইজ্জত লুটে নিয়েছিল, হত্যা করেছিল দেশের বুদ্ধিজীবীদের, নিজ ভিটা-বাড়ি, দেশ ছেড়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাধ্য করেছিল এক কোটির বেশি লোককে। যারা এই হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা করেছিল তাদের স্থানীয় দোসরদের কারো কারো বিচার ও শাস্তি হলেও অনেকে এখনো বিচারের বাইরে রয়ে গেছে। পাকিস্তানি সেনা ও সিভিল শাসকরা যারা এই গণহত্যার জন্যে দায়ী তারা এখনো বিচারের বাইরে। ‘সিটি অব জাস্টিস’ হিসাবে খ্যাত দি হেগ শহর থেকে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সংগঠন, ইউরোপীয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) যে ‘আওয়াজ’ তুলেছে, একই আওয়াজ উঠুক বাংলাদেশ সহ গোটা বিশ্বে। গর্জে উঠুক শ্লোগান “একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই”।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট