পাকিস্তানীদের মত ইস্ট-ইন্ডিায়া কোম্পানি আমাদের শাসক ও শোষণ কর্তা হয়ে যুগপৎ অত্যাচার-নিপীড়ন যেমন করেছে তেমনি বিভিন্নভাবে কলঙ্কিত ও অপমানিত করার অপচেষ্টাও করেছে। তেমনি একটি কলঙ্কময় ঘটনা বা অধ্যায় হল কুখ্যাত ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’।
আর এই কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনের পথ ধরে ত্রিশ দশকের শেষার্ধে নেতাজী সুভাষ বসু ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে কলকাতার বুকে অনেক ছাত্রনেতার আবির্ভাব ঘটে যারা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাঝ দিয়ে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য রাজপথ-ব্যালট এবং আত্মাহুতি ও রক্তাক্ত সংগ্রামে বলিষ্ঠ আপোষহীন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। আবার এদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করে ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছেন।
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলা ও এদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার হীন লক্ষ্যে এক অবাস্তব ও কাল্পনিক ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তৎকালীন বৃটিশ শাসকরা কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে ১৯০২-র ৯জানুয়ারি বৃটিশ ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন মার্বেল পাথরের তৈরী কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট স্থাপন করেন। নবাবের অনুমতি সাপেক্ষে রবার্ট ক্লাইভসহ কলকতায় বসবাসকারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সদস্যবৃন্দের দৃষ্টতা, স্পর্ধা, ঔদ্ধত্য সীমাহীন হয়ে উঠলে তাদেরকে যথাযথ শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে নবাব সিরাজদ্দৌল্লা ১৭৫৬’র ১৬জুন কলকাতা সসৈন্য উপস্থিত হওয়ার সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির সৈন্যের এক বিরাট অংশ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে পালিয়ে যায়।
২০ জুন এক প্রকার বিনাবাধায় নবাব তাদের দুর্গ দখল করে নেন। এ সময় কোম্পানীর কাউন্সিল সদস্য জেড হলওয়েল এর নেতৃত্বে অবস্থানরত একটি ক্ষুদ্র অংশ নবাবের কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নবাব ইচ্ছা করলে এদেরকে নির্মম শাস্তি দিতে বা হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু কোনটাই যেমন করেননি তেমনি এদের কারো প্রতি কোনো দুব্যর্বহার করেননি বা করার আদেশও দেননি (মেজর বি.ডি. বসুর রাইজ অব দি খ্রিষ্টান পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া / পৃ:৫৮)। অথচ হলওয়েল প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে দাবী করে যে, একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ রেখে নবাবের নির্দেশে ১২৬ জন ইংরেজকে ২০ জুন রাত্রিতে হত্যা করা হয় (?)। এই কল্পকাহিনিই ইতিহাসে ‘অন্ধকূপ হত্যা’ নামে খ্যাত।
কিন্তু এই ‘ঐতিহাসিক মিথ্যুক’ জেড হলওয়েল নিজেই স্বীকার করে যে, ২০ জুন দুপুরের পূর্বে তার অধীনস্থ মোট ১৪৬ জনের মধ্যে ৩৯ জন সৈন্য নিহত, দুর্গ পতনের সময় ১৮ জন পালিয়ে যায়। প্রশ্ন হল : ২০ জুন যেই ১২৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে সে দাবী করেছিল তা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালনার বোর্ডের রেকর্ড অনুযায়ী স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ১৬ জুন রবার্ট ক্লাইভের সাথে বিরাট অংশ পালিয়ে যাওয়ার পর হলওয়েলের নেতৃত্বে দুর্গ রক্ষার্থে মাত্র ১৪৬ জন্য সৈন্য ছিল, যার মধ্যে হলওয়েলের দাবী অনুযায়ী ৫৭ জন নিহত ও পালিয়েছে। তাহলে অবশিষ্ট থাকে কত? বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-১৭৫৭ ইন্ডিয়ান রেকর্ড সিরিজ/ভীলয়ুম ১, পৃ: ১১৪/এস.সি. হীল)।
আবার ১৭৫৬’র ৩০ নভেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পরিচালনা বোর্ডের কাছে স্বহস্তে লিখিত এক বিবৃতিতে হলওয়েল ২০ জুন নবাব কর্তৃক দুর্গ আক্রমণকালে কোম্পানীর মাত্র ৬০ জুন সৈন্য ছিল বলে জানায়, তাই ১৯১৫ সালে অক্সফোর্ড হিস্টরী অব ইন্ডিয়ার তৃতীয় সংস্করণের ৪৭৯ পৃষ্ঠায় হলওয়েলের বর্ণনাকে ‘বিশ্বাস যোগ্যতাহীন’ বলে অ্যাখ্যা দেয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও রবার্টক্লাইভ কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং’র পশ্চিম দিকে হলওয়েলের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বক্তব্যকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তুলে। এর বিরুদ্ধে কলকাতাবাসীর তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণাকে উপলব্ধি করে লর্ড হেস্টিংস ১৮২১ সালে তা অপসারণ করলেও লর্ড কার্জন শ্রদ্ধানন্দ পার্কের একই স্থানে ১৯০২-এর ৯ জানুয়ারি মার্বেল পাথরের তৈরি হলওয়েল মনুমেন্টটি স্থাপন করেন।
আর এই কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্টর বিরুদ্ধে কলকাতার মানুষ ১৯৩৮ সাল হতে বিস্ফোরণন্মুখ হয়ে উঠে। ১৯৪০’র ২৯ জুন আলবার্ট হলে এক প্রতিবাদ সভায় নেতাজী সুভাষ বসু ৩ জুলাইয়ের মধ্যে মনুমেন্টটি অপসারণের দাবী জানান। এতে তৎকালীন ছাত্রনেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ২ জুলাই নেতাজী গ্রেফতার হন। ৩ জুলাই শ্রদ্ধানন্দ পার্কের জনসভায় বৃটিশ সরকার সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪১-এর ৩ জুলাই শ্রদ্ধানন্দ পার্কে ফজলুল কাদের চৌধুরীরর সভাপতিত্বে সংগ্রাম পরিষদের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী (২ এপ্রিল ’৩৭ – ২১ এপ্রিল ’৪৩) শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, সৈয়দ বদরুদ্দোজা প্রমুখ ভাষণ দেন। সভা শেষে বৃটিশ পুলিশের প্রবল বাধার মুখে এই কুখ্যা হলওয়েল মনুমেন্টটি শেরে বাংলা, নেতাজী সুভাষ বসু, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, ফজলুল কাদের চৌধুরীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে একদল যুবক এ কুখ্যাত মনুমেন্টটি ভেঙে চুরমার করে দেয়। এ সময় বৃটিশ সরকারের পুলিশ বাহিনী গুলি করতে উদ্ধত হলে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা, একে ফজলুল হক পুলিশের রাইফেলের সামনে এসে গর্জে উঠে বলেন – ‘সাহস থাকেত আমার বুকে গুলি চালাও’ (দৈনিক স্টেটসম্যান/ ৪ জুলাই ’৪১/১ম পৃষ্ঠা)।
লেখক : কলামিস্ট।