উর্দু কবি মাহির আল কাদেরি ‘কুরআন কি ফারইয়াদ’ কবিতায় লিখেছেন, “কিস বাযম মেঁ মুঝকো বার নেহি, কিস উরস মেঁ মেরি ধুম নেহিঁ। ফের ভি ম্যাঁয় আকিলা রাহতা হুঁ, মুঝ সা ভি কোয়ি মাযলুম নেহিঁ”– অর্থাৎ কোন মাহফিলে আমার অংশগ্রহণ নেই, কোন ওরসে আমাকে নিয়ে উৎসব নেই। তারপরও আমি একলা থাকি, আমার মতো মজলুম কেউ নেই।
মানুষের নিকট কুরআনের অনুশীলন ও মর্যাদার বাস্তব চিত্র পর্যবেক্ষণ করে উর্দু কবি মাহির আলম কাদেরি কুরআনের বিলঅপ উপস্থাপন করেছেন ‘কুরআন কি ফাইয়াদ’ কবিতায়। প্রচলিত রেওয়াজে সাধারণত কুরআনকে সুউচ্চ মর্যাদায় রাখা হয়। পরম পবিত্রতায় হাতে নিয়ে, মমতামাখা চুমু দিয়ে, মস্তক শিরে ধারণ করে এমন ভাব প্রদর্শন করা হয়, মনে হয় কুরআনের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধের যেন শেষ নেই। কিন্তু কবি মাহির আল কাদেরির ভাষায়, ‘আমাকে সম্মান করার নিছক দাবি করো না। আমাকে শুধু চোখের ছোয়া লাগিয়ো না; বরং আমাকে নিজেদের অনএতর জায়গা করে দাও। তোমরা সম্মান করো, তাহলে বাকিরাও সম্মান করবে।’
কবি মাহির আল কাদেরি ইসলাম ধর্মের পবিত্র ঐশীগ্রন্থ কুরআনকে মুখে নয়, অন্তরে, লোক সমাজে প্রদর্শনীর নিমিত্তে নয় বরং বিশ্বাসে এবং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গভীরভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি এবং সমাজ চরিত্রে জ্যোতিষ্ময় ধারা হিসেবে প্রতীয়মান করার আহ্বান জানিয়েছেন। কুরআন আরবী ভাষায় ছাপানো অবস্থায় সকল প্রকার সংশয়–সন্দেহ মুক্ত ঐশী কিতাব। এটি নাজিল হয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (দ.)’র পবিত্রতম নীতিমালা শুধুমাত্র পাঠ করে শোনানোর জন্যে তিনি আদিষ্ট হননি। বরং জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে, প্রতিটি কর্মে আল্লাহ্্র প্রতি পরম আনুগত্যের সবক অনুযায়ী তা কার্যকরের নির্দেশনাও তিনি প্রাপ্ত হন। সেই অনুযায়ী বিশ্বনবী (দ.) তাঁর ব্যক্তি এবং সামাজিকতায় পবিত্র কুরআনের শ্বাসতরূপ এবং পরম ঐশী সৌণ্দর্য হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) ছিলেন স্বয়ং জীবন্ত কুরআন।
নবুয়দ প্রকাশের পূর্ব থেকেই বিশ্বনবী (দ.) আত্মীয় পরিজন পরিচিত মহলে সবচেয়ে স্নিগ্ধ শুদ্ধতম মানব চরিত্র হিসেবে জ্ঞাত ছিলেন। পরিচিত সকলের নিকট তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত, আকর্ষনীয় পরম সত্যবাদী চরিত্র। তাই নবুয়ত প্রকাশের পূর্ব থেকেই অতি ঘনিষ্ঠরা তাঁর কথাবার্তায় অত্যন্ত আস্থাশীল। এমন কি কফিররা পর্যন্ত তাদের অর্থ–সম্পদ, স্বর্ণ– রৌপ্য তাঁর নিকটই আমানত হিসেবে জমা রাখত। নবুয়ত প্রকাশের পর চরম বৈরী কাফিররাও তাঁর কাছে মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত রাখত। নবুয়তের ঝলোয়া প্রকাশ পেলে ওহীর আলোকে উদ্ভাসিত এবং মিরাজের আলিঙ্গনে প্রেম তরঙ্গ বাহিত বিশ্বনবী (দ.) তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত ঘনিষ্ঠদেরকে তাওহীদ ও রেসালতের দাওয়াত পেশ করেলে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে কবুল করেন। এটিতাঁর বক্তি চারিত্রিক সৌন্দর্যের আকর্ষনীয় প্রভাব হিসেবে বিধৃত।
বিশ্বনবী (দ.) তাঁর অনুসারীদেরকে পবিত্র কুরআন শুধু পাঠ করা নয় বরং ব্যক্তি এবং সামাজিকতায় অনুশীলনে ঋদ্ধ হবার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ফলে তাঁর সাহাবীবৃন্দ নিজেরা পরিণত হয়েছিলেন আসমানের একেকটি নক্ষত্র। বিশ্বনবী (দ.) তাঁর পার্থিব জীবনকালেই ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করেছিলেন আল্লাহ্্র অনুপম নির্দেশে সাহাবাকেরামের আন্তরিক সহযোগিতায়। তিনি মদিনা নগর কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন মদিনা সনদের ভিত্তিতে। মদিনা সদন পৃথিবীর বুকে লিখিত সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। এই সংবিধানের মৌলিক ধারণা পবিত্র কুরআন থেকেই উদ্ধৃত। অর্থাৎ মদিনা সনদ আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের ফলিত রূপ।
পৃথিবীতে বসবাসরত বহু ধর্ম, বহু বর্ণ–ভাষা, সংস্কৃতি বিশ্বাসী মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গাইড লাইন হচ্ছে মদিনা সনদ। মদিনা সনদের ভিত্তিতে বিশ্বনবী (দ.)’র পর গড়ে ওঠে খোলাফায়ে রাশেদীন। মাত্র ত্রিশ বছর পর মানবসমাজের সুসভ্য অভিযাত্রার এই ধরনের অগ্রবর্তী সময়কালেরও অবসান ঘটে পার্থিব্য চাকচিক্য ভরা পারস্য– রোমান রাজতান্ত্রিক আদলে গড়ে ওঠা উমাইয়া–আব্বাসীয়া সামন্তবাদীতায়। তখন থেকেমানুষের চিন্তা– চেতনা এবং কর্মধারায় পবিত্র কুরআনের বিপ্লবী আবেদন ম্লান হতে শুরু করে।
মদিনার মসজিদে নববীতে বিশ্বনবী (দ.) কে ঘিরে গড়ে ওঠে সম্পূর্ণ অপার্থিব মননের ঐশী ধারা ‘আসহাবে সুফফা’। পৃথিবীর মায়ামোহের প্রতি বিন্দু পরিমাণ আকর্ষণহীন, জাগতিক প্রয়োজনের প্রতি আকাঙ্ক্ষাবিহীন নির্লোভ, নির্বিলাস, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্্র ধ্যানমগ্ন এই সাধকশ্রেণী প্রকৃত অর্থে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে খোদায়ী পরিবারের সদস্য। সাধারণ অর্থে যখন অনেকে পার্থিব সুখ সম্ভোগ এবং একটু আরাম আয়েশের সান্নিধ্য নিয়ে নিজেরা সামান্য হলেও ভোগবাদীতায় যাপিত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছেন তখনও এ ধরনের সংসার বিরাগী সাধক শ্রেণী পৃথিবীর নানা প্রান্তেনানা ভাষাভাষী মানুষের নিকট ছুটে গিয়েছেন তাওহীদের বাণী নিয়ে। তাঁরা অনেচা–অজানা লোকালয়ে পেশ করেছেন আল্লাহ্্র একক অবিনশ্বর অস্তিত্বের বাণী। তারা মানব সমাজে সংযুক্তি ঘটিয়েছেন সামা–ভ্রাতৃত্বের অনুপম অনুশীলন। ইসলাম ধর্মের নামে বাদশাহী মেজাজ যখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে সংক্রমিত তখন আসহাবে সুফফার আদর্শধারী আত্মীয় পরিজনের বন্ধন থেকে মুক্ত এ সকল মহৎ প্রাণ মহান সাধক ইসলাম ধর্ম এবং আল কুরআনের অনুশীলন সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ চরিত্র হিসেবে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আর্বিভুত হন। তাঁরা প্রকৃত অর্থে আল্লাহ্্র সৈনিক; আল্লাহ্্র দ্বীন প্রচার এবং একই আদর্শে জীবন যাপন করা তাঁদের ব্রত। তাঁরা হলেন পবিত্র কুরআনের আক্ষরিক উপামা। তাঁদের চারিত্রিক উজ্জ্বলতায় স্নাত হয়ে কোন প্রকার চাপ এবং শক্তি প্রয়োগ ব্যতীত অনেকে তাওহীদের শিক্ষায় দীক্ষিত হন। আসহাবে সুফফার জীবন প্রবাহ অনুশীলনে সমৃদ্ধ চরিত্রের উত্তরাধিকারী এই সকল মহান সাধকরা একটি মহৎ মিশন নিয়ে পরিচিত জন্মভূমির ছায়া–মায়া ত্যাগ করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যে দাওয়াতী কর্ম সম্পন্ন করেছেন তা তুলনা বিহীন। তাঁরা পবিত্র কুরআনকে চোখের ছোয়া লাগিয়ে গৃহের তাকে রেখে দেননি। বরং নিজেরা পবিত্র কুরআনের রোশনি হিসেবে বিকিরণ ঘটিয়েছেন অসংখ্য অচেনা জনপথে। হযরত সৈয়দ শাহজাহান শাহ (রহ.) হলেন এই ধরনের এক অনন্য রোশ্্নি– যাঁর চরিতাভিধান হচ্ছে ‘আল কুরআন’। মূলত ‘কুরআন কি ফারইয়াদের’ ফয়সালা পৃথিবীর বুকে করে থাকেন হযরত সৈয়দ শাহজাহান শাহ (রহ.) এর মতো আউলিয়া।










