চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার অন্তর্গত বড় কুমিরার পূর্ব পাশ্বে পাহাড়ের চূড়ায় হযরত শাহ্ সূফী সৈয়দ কমর আলী শাহ্ প্রকাশ হযরত ডাল চাল মিয়া শাহ্ (রহ.) এর মাজার শরীফ অবস্থিত। ৩৪১টি সিঁড়ি বেয়ে জিয়ারতের জন্য মাজারে যেতে হয়। প্রতি বছর ২৩ বৈশাখ ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই বার্ষিক ওরশ শরীফে অংশ গ্রহণ করেন।
১৬৬০ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ২য় পুত্র বাংলার সুবাদার শাহজাদা শাহ সুজা সিংহাসন অধিকারের যুদ্ধে তাঁর ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে পরাজিত হবার পর সেনাপতি মীর জুমলা পশ্চাদধাপন করলে তিনি আরকানে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সময়ে চট্টগ্রাম আগমনের কোনো স্থলপথ ছিল না বলে প্রথমে ঢাকা থেকে হাতিয়া আসেন। সুবাদার শাহ সুজার সাথে সফর সঙ্গী হিসাবে স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ ২০০ জন একান্ত অনুগামী, ১৮ জন সেনাপতি, ৩০০০ সৈন্য, ২২ জন উচ্চ পদস্থ কাজী, ওলামায়ে কেরাম অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। নদী পথে যাত্রা করে কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে কাটালী নগরে বা ভাটিয়ারী অথবা কুমিরা নগরে নৌবহর থেকে অবতরণ করেন তারা। তৎকালীন দেওয়াং পাহাড় ছিল আরাকানীদের রাজধানী ও সমুদ্র বন্দর যার মাধ্যমে বহির অঞ্চলের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য চলতো। কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে তেমন উল্লেখযোগ্য উন্নত স্থান ছিল না বিধায় দেওয়াং বন্দর হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের স্থলপথে তিনি আরকান যাওয়ার মনস্থির করেন। কিন্তু আরকান রাজার শর্ত মোতাবেক অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন এবং অল্প সংখ্যক দেহরক্ষী ছাড়া অন্য কাউকে সঙ্গী করা যাবে না বিধায় অনেকে বিশেষ করে উচ্চ পদস্থ কাজী সমাজ ও বুজুর্গানে দ্বীন কর্ণফুলী নদীর উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বসতি স্থাপন করেন। গবেষণায় দেখা যায়, অনেকে দেওয়াং পাহাড়ের আশেপাশে, বাঁশখালী, চুনতি এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গড়ে তুলেন। জনশ্রুতি আছে যে, তেমনি কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে হযরত মনছুর আলী শাহ (রহ.) আস্তানা গড়ে তুলেন এবং বসতি স্থাপন করেন ।
হযরত শাহ্ সূফী সৈয়দ কমর আলী প্রকাশ হযরত ডাল চাল মিয়া শাহ্ (রহ.) সুবাদার শাহ্ সুজার সফরসঙ্গী ছিলেন কিনা সেই সম্বন্ধে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জনশ্রুতি আছে, হযরত কমর আলী শাহ (রঃ) সুবাদার শাহ সুজাকে দাওয়াত করেছিলেন এবং মেজবান খাইয়েছিলেন। তিনি সামান্য পরিমাণ ডাল ও চাল মিশিয়ে রান্না করে শাহ্ সুজার সফর সঙ্গীসহ সবাইকে আপ্যায়ন করিয়েছিলেন। এরপর থেকে কমর আলী শাহ হযরত ডাল চাল মিয়া (রহ.) নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি কুমিরা এলাকায় অবস্থান করলেও সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না। লোকে মুখে শোনা যায় ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশ থেকে চট্টগ্রামে আসেন তিনি। পাহাড়ের ছড়ায় নির্জনে বসে সাধনায় রত ছিলেন, আল্লাহর এবাদতে মশগুল ছিলেন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছিলেন ।
আরো জনশ্রুতি আছে যে, তিনি বাঘের পিঠে করে চলাফেরা করতেন। তাঁহার ওফাত কত সনে হয়েছে তারও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তখন থেকে অসংখ্য ভক্ত নিয়মিত জিয়ারত করতেন। পাহাড়ে গভীর জঙ্গল থাকায় বিশেষ করে বাঘ ভাল্লুক এবং বিভিন্ন জীবজন্তু তার মাজার শরীফ পাহারা দিত বিধায় রাতের বেলায় কেউ মাজারে যেতেন না। শুধু দিনের বেলায় গিয়ে জিয়ারত করতেন।
কথিত আছে– একবার কয়েকজন মহিলা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মাজার শরীফে গমন করেছিলেন। কিন্তু তাদের চলাফেরা, আচার আচরণ, কথাবার্তা, পোশাক পরিচ্ছদ শালীনতার মধ্যে ছিল না। হঠাৎ তখন দেখা যায়, বিরাট এক অজগর সাপ তাদের দিকে ধেয়ে আসে, কিন্তু কোনো রকম ক্ষতি না করে অন্যদিকে চলে যায়। সাথে সাথে মহিলাগণ তাদের ত্রুটি বুঝতে পারেন।
হযরত ডাল চাল মিয়া শাহ্ (রহঃ) এর এ রকম অনেক কারামত বা অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে শোনা যায়।
বি:দ্র: ইমামে আহলে সুন্নত হাদিয়ে দ্বীনে মিল্লাত হযরত আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রঃ) রচিত দিওয়ান–ই–আজিজ এ হযরত শাহ্ সূফী সৈয়দ কমর আলী প্রকাশ হযরত ডাল চাল মিয়া শাহ্ (রহ.) সম্পর্কে ফার্সি ভাষায় লিখেছেন যার বাংলা তরজুমা হচ্ছে, ‘মজযুবে সালিক, মহাস্রষ্টার প্রিয়ভাজন, সৃষ্টির মিলন কেন্দ্র যুগের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ, আরিফবান্দাদের শিরমণি দুনিয়ার মোহত্যাগী বুযুর্গদের আদর্শ, কাশফ্ ও কারামতের ভাণ্ডার। উঁচু মর্যাদার আসনে আসীন, ফয়ুজাত ও কামালতের ভাণ্ডার চট্টগ্রামের কুমিরা নিবাসী হযরত ডাল চাউল মিয়াঁ আলায়হি রাহমাতু রাব্বিহিল বারীর প্রশংসা।’
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, তাহের মনজুর কলেজ












