হঠাৎ রাজনীতি

অভীক ওসমান | বৃহস্পতিবার , ১৫ জুন, ২০২৩ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

বেশ কবছর আগে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ একটা সিনেমা দেখেছিলাম। আমি রাজনীতি করি। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে লিখি না। তাই শিরোনামটা দিলাম ‘হঠাৎ রাজনীতি’। সমপ্রতি ১৪ দল কেন্দ্রিয় নেতা আমির হোসেন আমু এক চিঠিতে খোরশেদ আলম সুজনকে সমন্বয়ক করে চট্টগ্রাম মহানগর ১৪ দলকে সক্রিয় করলেন। দেশের অন্য কোনো মহানগর নয়, শুধু চট্টগ্রাম। কারণ Chittagong to the fore (মহাত্মা গান্ধী)। এতদিন ভুলে থাকা ১৪ দল পুনর্বার চাঙ্গা হলো। এই সংবাদটি দৈনিক আজাদী প্রথম পৃষ্ঠায় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেদিনই সকালে একটা গ্রোসারি দোকানে এক পাঠক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো। তার স্বগত: মন্তব্য ইতিবাচক ছিল কিনা বোঝা গেল না।

১. নিজের ঢোল

চট্টগ্রাম চেম্বার থেকে রিটায়ার্ড করার পর আমি জাসদ (ইনু)র মহানগর ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করা শুরু করি। জীবতকালে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় অফিসে গেলে চৌধুরী আমাকে তার পাশে বসিয়ে হাত চেপে ধরে জসিমুদ্দিন বাবুল (সাধারণ সম্পাদক, নগর জাসদ)কে বলেছিলেন ‘ইবারে ধরি রাইখকো’। আবুল বাশার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরী নাগরিকদের সম্মান দিতে জানতেন।

অনেকে আমাকে লেখক ও চেম্বার সচিব হিসেবেই চেনে। দারুল ফজলের মার্কেটের একটা মিটিংয়ে নিজের ঢোল নিজেকে বাজিয়ে শোনাতে হলো (সৈয়দ মুজতবা আলী)। ১৯৬৭ সালে আমি যখন নগরে আসি এর এক বছর আগে এই চট্টগ্রামেই বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করেছেন। সেই সময় আমাদের মতো অনতিতরুণদের ‘যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়’ (হাসান হাফিজ)। ১৯৬৯ সালে এক তপ্ত দুপুরে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ গ্রন্থবিরোধী আন্দোলনে পথে নামি। আমরা খাস্তগীর স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করি। কাজেম আলী হাই স্কুলের সতীর্থ শেখ আহমেদ জানাচ্ছেন। ‘আমরা ১৯৬৯ বঙ্গবন্ধুকে উত্তর চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পথে স্কুল সামনে মাল্যভূষিত করি। দ্বিতীয়বার এম.এ. আজিজের বাসার সামনে আমাদের দেখা হল। গাড়ি থামিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন পড়, পড়, পড়। বঙ্গবন্ধুর কত জনসভার বজ্রকণ্ঠ শুনেছি তার শুমার নেই।

১৯৭০ সালে ‘পাকা এ তরীর মাঝি মাল্লা/দাঁড়ি মুখে সারী গান লা-শরীক আল্লাহ’ (কাজী নজরুল ইসলাম) আনোয়ারা-পটিয়া-চন্দনাইশ-সাতকানিয়ায় এম.এন.এ,এমপিদের জন্য কাজ করেছি। ১৯৭১ আমার মা তার সবচেয়ে ভীতু ছেলেটাকে গভীর নিশীথে মুক্তিযুদ্ধ যেতে বলেন। শাজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। মুক্তিযুদ্ধের পরে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য নিউ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, নগর ছাত্রলীগ করি। কোনো এক হ্যামিলনের বংশীবাদকের ডাকে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল পড়ুয়া সহ হাজার হাজার ট্যালেন্ট্যাড শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধারা সহ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এক শামিয়ানার নিচে চলে আসে। এমনকি দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত কার্যক্রমে আমি অ্যাকটিভ ছিলাম। জেল জুলুম হুলিয়া আমাদের জন্য সবসময় অব্যাহত ছিল।

১৯৮১-৮২ তে বহুধা বিভক্ত সংগঠন। ছাত্রলীগের একটা অংশ থেকে সাহিত্য সম্পাদক পদে ৮ ভোটে হেরে যায়। এই প্রথম শিবির চাকসু’তে এসে গেল। এরপর নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জুর প্যানেলে সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে পথ নাটক ‘অবশেষে জেনারেল’ লিখে আর্টিজানের ভূমিকা নিই। আমাদের দল থেকে অনেকে আওয়ামীলীগ-বিএনপিতে গেছে। আমি পূনর্বার জাসদে আসি। আমি এটাকে ইমানী দায়িত্ব মনে করেছিলাম। কারণ সমাজে বৈষম্যহীন সমতা আসুক-তা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, করবো।

২. জাসদ- একটি ট্র্যাজিক পার্টির নাম

বাংলাদেশে সবচেয়ে ট্র্যাজিক পার্টির নাম- জাসদ। সমপ্রতি বাংলাদেশের রাজনীতির রাসপুটিন, রহস্যমানব বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের আদর্শ তুমুলভাবে ব্যর্থ, সমালোচিত হচ্ছে। মহিউদ্দিন আহমদ, জয়নাল আবেদীন, নওয়াজিশ মাহমুদের গ্রন্থসমূহে আমাদের ব্যর্থতার, গ্লানির, একিউজড করার কথা আছে (প্রথমা, খড়িমাটি) একটি প্রবাদ আছে Victory has a thousand fathers, but defeat is an orphan. (John F. Kennedy)

৩. যৌথ আন্দোলন ও ১৪ দল

অভিজ্ঞতা থেকে বলি ৭৫ পরবর্তী আমরা ছাত্রলীগ, ছাত্রইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ (মুজিববাদ), যৌথ আন্দোলন শুরু করি। স্বৈরাচারী আন্দোলনে ২২ দল (১৫+৭) আন্দোলন করেছে। এরশাদের পতন হয়েছে। পরবর্তী মহান মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তরের সংবিধান, অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশে ২৩ দফাকে সামনে রেখে ১৪ দল গঠন করা হয়। এখান থেকে গণ ফোরাম বের হয়ে যায়। মূলত আওয়ামীলীগ, জাসদ (ইনু), ওয়াকার্স পার্টি, গণ আজাদী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) গণতন্ত্রী পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, জেপি, গণতান্ত্রিক ফেডারেশন, বাসদ (রেজাউর রশিদ) সাম্যবাদী দল, ঐক্য ন্যাপ ইত্যাদি নিয়েই ১৪ দল।

৪. ১৪ দলের ২০২৩-এর নবযাত্রা

নতুনভাবে সক্রিয় চট্টগ্রাম ১৪ দলের প্রথম সভায় শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নগর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, কাউন্সিলর হাসান মাহমুদ হাসনী, বন ও পরিবেশ সম্পাদক মশিউর রহমানসহ ১৪ দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

চট্টগ্রাম ১৪ দলের মিটিং সমূহে মহান একাত্তর ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মূল লক্ষ্যমাত্রা বলে শুরু করা হয়। উইথ ইন দ্য পার্টি সমালোচনা করেছি। বড়ো দল রুলিং পার্টিতে-হাইব্রিডদের আনাগোনা, আমেরিকার ভিসা নীতির সমালোচনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানকে স্বাগত: জানানো হয়। পাশাপাশি বিদ্যুৎ, গ্যাস সাপ্লাই, পেঁয়াজসহ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য সিন্ডিকেট অসাধু ব্যবসায়ীদের দমন করার জন্য সরকার সমীপে দাবী পেশ করা হয়। বিএনপি জামাতীদের অগ্নিসন্ত্রাস রোধে রাজপথে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। ১৪ দল মনে করে এরা ক্ষমতায় আসলে ৭১’র ১৪ ডিসেম্বর, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মত ঘটনা বেড়ে যাবে। সাথে সাথে চট্টগ্রামের উন্নয়নে ও চট্টগ্রামের সকল সমস্যার সমাধান সামাজিক শক্তি হিসেবে থাকার পুনর্বার ইচ্ছে ব্যক্ত করা হয়। শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক পদ্মাসেতু, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন, মাতার বাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের মতো বিপুল অবকাঠামো নির্মাণকে প্রশংসা করা হয়। ১৪ দল বাক্‌ স্বাধীনতার অপব্যবহারে ক্ষোভ প্রকাশ করে। সমপ্রতি ঘোষিত বাজেট যাতে মূল্যস্ফিতি কমায়, ব্যবসাবান্ধব করার জন্য আহ্বান জানিয়েছি। ছাত্র যুব জনতার বিভেদ ভুলে চট্টগ্রাম ১৪ দলকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানানো হয়।

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী দেশী-বিদেশী অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ান।’ জেলা পরিষদ সমুখস্থ সমাবেশের আহ্বান। এই সভায় সমন্বয়ক খোরশেদ আলম সুজন সভাপতিত্ব করেন। জাসদ মহানগরের জসিম উদ্দিন বাবুল, ওয়ার্কার্স পার্টির এডভোকেট আবু হানিফ। মহানগর আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দিন, এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল, সাম্যবাদী দলের অমূল্য বড়ুয়া, গণ আজাদী লীগের নজরুল ইসলাম আশরাফি, ন্যাপ (মোজাফফর) ফয়েজউল্লাহ মজুমদার, গণ আজাদী লীগের খোরশেদ আলম, জেপি এর ডা. বেলাল মৃধা, গণতন্ত্রী পার্টির স্বপন সেন। সঞ্চালনা করেন ওয়াকার্স পার্টির শরীফ চৌহান, আওয়ামী লীগের শফিকুল ইসলাম ফারুক। কাউন্সিলর জহুর লাল হাজারী, নীলু নাগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নগর সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবু। সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ, ছাত্রলীগ মহানগর সভাপতি ইমরান হাসান আহমেদ ইমু (দৈনিক আজাদী, জুন ২০২৩) বক্তব্য রাখেন। কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রিয় ১৪ দলের নেতাদের নিয়ে লালদিঘি মহাসমাবেশ করার প্রস্তুতি চলছে।

৫. মুদ্রার অপরপীঠ

সমপ্রতি ঢাকার আইনশৃংখলা কর্তৃপক্ষ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ১০ বছর পর জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছেন। এটা নিয়ে এক মহলে উল্লাস, অন্য মহলে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। গত ১৩ জুন চট্টগ্রামে রেডিসন ব্লুতে এক সাক্ষাৎকারে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এম পি বলেন ‘দলীয়ভাবে আমরা তা সমর্থন করি না।’ শেষ করছি মোরশেদ শফিউল হাসানের ‘একাত্তর’ উপন্যাসের ইংরেজি ভূমিকার একটা অংশ দিয়ে, “ইংল্যান্ডকে চেনা যায় ÒCricet, Shakespeare, and অনুরূপভাবে Banglees will say ‘Libaration war, Bangabondu Mujib and Tagor’ (আবেদীন কাদের পিএইচডি, নিউইয়র্ক ২০ ডিসেম্বর ২০২০) ১৪ দলও তাই মনে করেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধনিজ নিজ কর্মফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে