কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কয়েক মাস ধরেই ঘুরেফিরে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিলেন, আর তা হচ্ছে: আপনি কি পদত্যাগ করবেন? তবে ট্রুডো লিবারেল পার্টির নেতার পদ ছাড়তে চাননি। যদিও ভোটারদের মধ্যে তাকে নিয়ে হতাশা ক্রমাগত বাড়ছিল এবং জনমত জরিপগুলোতে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বৈরিতাও ক্রমাগত বাড়তে দেখা যাচ্ছিল। এমনকি নিজেকে যোদ্ধা আখ্যা দেওয়া ট্রুডো নিজ দলেই বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন।
দলের অনেকেই তার পদত্যাগের দাবি জানিয়েছিলেন। এই বিরোধিতার মুখেই সোমবার রাষ্ট্রীয় বাসভবন রিডাউ কটেজের সামনে দেওয়া বক্তব্যে ট্রুডো পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচনে দেশের জন্য সত্যিকারের পছন্দের কাউকে প্রয়োজন। আমার কাছে এটি স্পষ্ট যে, আমাকে দলের ভেতরেই লড়তে হলে, আমি এই নির্বাচনে সবচেয়ে ভাল প্রার্থী হতে পারি না।
তবে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও ট্রুডোর দল লিবারেল পার্টি নতুন নেতা বেছে না নেওয়া পর্যন্ত তার প্রধানমন্ত্রী পদ বহাল থাকবে। নতুন নেতা নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হবে দলীয়ভাবে। দলকে নতুন নেতা খোঁজার সময় দিতে ট্রুডো আগামী ২৪ মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত রাখতে বলেছেন।
প্রায় এক দশক আগে প্রগতিশীল রাজনীতির নতুন মুখ হিসেবে ক্ষমতায় উঠে এসেছিলেন ট্রুডো। দলকে পড়ন্ত অবস্থা থেকে টেনে তুলে ২০১৫ সালে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসেন তিনি। তার তারুণ্যের কারিশমা এবং আশাবাদী রাজনৈতিক বার্তায় ভোটাররা হয়েছিল মোহমুগ্ধ।
তারা বিপুল ভোট দিয়ে লিবারেলদেরকে তৃতীয় স্থান থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পার্লামেন্টে পৌঁছে দেয়, কানাডার রাজনৈতিক ইতিহাসে সেটি ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। এরপর থেকে টানা গত নয় বছর ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে এসেছেন লিবারেল পার্টির নেতা জাস্টিন ট্রুডো ।
তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় বারাক ওবামা, আঙ্গেলা ম্যার্কেল, শিনজো আবে এবং ডেভিড ক্যামেরনের মতো বিশ্বনেতারা শাসনক্ষমতায় ছিলেন। পরে এই সব নেতা একে একে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও ট্রুডো তার পদে বহাল থাকেন। ৫৩ বছর বয়সী ট্রুডো বর্তমানে জি–৭ জোট ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা নেতা। বিশ্ব মঞ্চে অভিষেক হওয়ার পর এবং দুটি সাধারণ নির্বাচনে ট্রুডো তার দলের জন্য সৌভাগ্য হয়েই ছিলেন। কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা ট্রুডো হঠাৎ কেন পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন?
কানাডার রাজনীতি বিষয়ক সাংবাদিক এবং জাস্টিন ট্রুডো অন দ্য রোপস–এর লেখক পল ওয়েলস সমপ্রতি বিবিসি–কে বলেছেন, তার বিশ্বাস– একজন গৌরবময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রুডো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে সমপ্রীতি ও জলবায়ু নীতির মরেতা বিভিন্ন বিষয়ে তার প্রকৃত নেতৃত্বের জন্য তাকে স্মরণ করা হবে। তবে তিনি (ট্রুডো) আবার এমন মানুষও, যিনি ক্রমেই জনমত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন এবং সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলেন না।
গত বছর শেষের দিকে কানাডার লিবারেল পার্টি উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিবাসন পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। এরপর কয়েক দফায় রাজনৈতিক ধাক্কা খাওয়ার মুখে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ট্রুডোর দিন শেষ হতে চলেছে। গ্রীষ্মে কানাডায় অনুষ্ঠিত কয়েকটি বিশেষ নির্বাচনে লিবারেলদের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত আসনগুলোতেও লিবারেল প্রার্থীরা ভাল ফল করতে পারেনি। ফলে পার্টির ভেতরে অস্থিরতা দেখা দেয়।
ওদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে ডনাল্ড ট্রাম্প গত নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর বলে দিয়েছেন, কানাডা অনুপ্রবেশকারী এবং মাদক আমেরিকায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সেদেশের পণ্যের ওপর তিনি ২৫% কর আরোপ করবেন। এই পরিমাণ কর কানাডার অর্থনীতিকে শেষ করে দিতে পারে।
বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে কিছুদিন আগে পদত্যাগ করেন কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। ওই ঘটনার পর থেকেই ট্রুডোর ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়তে থাকে।
এ বছর কানাডায় সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে। কিন্তু তার আগেই দলেন নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হলেন জাস্টিন ট্রুডো। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে কানাডায় বেশকিছু জনমত জরিপ চালানো হয়েছে।
পরবর্তী নেতা হবেন কে : আগামী ২৪ মার্চের মধ্যে কানাডার লিবারেল পার্টিকে নতুন নেতা বেছে নিতে হবে। কিন্তু ট্রুডোর উত্তরসূরি কে হবেন সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বেশ কয়েক জনের নাম শোনা যাচ্ছে। বিবিসি জানায়, এদের মধ্যে ট্রুডোর সরকারের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি এবং কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান মার্ক কারনির নাম উঠে এসেছে আলোচনায়।
ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড কানাডার পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ অ্যালবার্টায় বেড়ে উঠেছেন। তিনি টরেন্টো থেকে নির্বাচিত এমপি। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে তিনি সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন কানাডার প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী। এই তিনজন ছাড়াও নতুন নেতা বাছাইয়ের তালিকায় আছেন ডমিনিক লেব্লাঙ্ক।
ট্রুডোর দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং অর্থ ও ইন্টারগভার্নমেন্টাল অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী তিনি। আরেকজন হচ্ছেন, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টি ক্লার্ক। কেন্দ্রীয় রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে তিনি সরে গেলেও সমপ্রতি কয়েক মাসে তিনি লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। আরও নাম শোনা যাচ্ছে–পরিবহনমন্ত্রী অনিতা আনন্দর। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভুত। তিনি বর্তমানে কানাডার পরিবহনমন্ত্রীর পাশাপাশি অভ্যন্তরীন বাণিজ্য মন্ত্রীও।