হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভাণ্ডারীকে কেন ‘ফরদুল আফরাদ অলি’ বলা হয়

ড. মোহাম্মদ আবদুল আজিম শাহ্‌ | শুক্রবার , ১১ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ

আরবি ‘ফরিদুল’ ও ‘আফরাদ’ দুটি ভিন্নশব্দের সমন্বয়ে ফরদুল আফরাদ। ‘ফরিদুলএর অভিধানিক অর্থ একক, অনন্য, বিরল, অতুলনীয়। ‘আফরাদ’ অর্থ একক, অনন্য, অদ্বিতীয়। ‘ফরদুল আফরাদ’ অর্থঅনন্যদের মধ্যেও যিনি অনন্য, অতুলনীয়দের মধ্যেও অতুলনীয়। মর্যাদা, ক্ষমতা ও গুণে যিনি মহানদের মধ্যেও মহান, শ্রেষ্ঠদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী; এককথায় তাকে ‘ফরদুল আফরাদ’ বলে।

পবিত্র কোরআনে আছেআল্লাহ বলেছেন, ‘আমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হলাম। আল্লাহর চেয়ে অধিক গুণসম্পন্ন আর কে হতে পারে? এবং আমরা তাঁরই এবাদত করি। ( সূরা বাকারা১৩৮ )’। রসূল (.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও’। যাঁরা সাধনা করে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়েছেন তাঁদেরকে আউলিয়া বলা হয়। এঁরা বেলায়তপ্রাপ্ত হয়ে স্তরবিশেষে গাউস, কুতুব, আবদালসহ বিভিন্ন পদে নিয়োজিত হন। এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে বেলায়তের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়ে আল্লাহর হুকুমে কেউ কেউ দৃশ্যঅদৃশ্য জগৎ পরিচালনা করেন। সমগ্র সৃষ্টি তাঁদের অনুগত থাকে। এঁরা শ্রেষ্ঠঅলি হিসেবে পরিচিত। আবার শ্রেষ্ঠঅলিদের মধ্যে কতকঅলির (যুগসংস্কারক, ফজিলত রব্বানী ও গাউসুল আজম রূপে) আবির্ভাব ঘটে যাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর জন্য বিশেষ দান। এঁদেরকে বলা হয় ফরদুল আফরাদ অলি (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠঅলি)। মাইজভাণ্ডারী দর্শনের প্রবর্তক হজরত শাহ্‌সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (.) যুগসংস্কারকসহ গাউসুল আজম রূপে আল্লাহর পক্ষ থেকে সৃষ্টিকুলের জন্য ফজিলতে রব্বানী হিসেবে আগমন করেছেন।

তিনি আগমন করে পূর্বের শৃঙ্খলিত সকল তরিকাকে সমন্বয় করে নতুন একটি দর্শন পদ্ধতি দিয়েছেন; যার নাম উন্মুক্ত আধ্যাত্ম্যবাদ। এটি দর্শন নয় বরং দর্শনেরও মূলতত্ত্ব। হজরতকেবলা সহ তাঁর দর্শনের মূলতত্ত্বের কয়েকটি শ্রেষ্ঠত্ব নিচে আলোকপাত করলাম / তিনি একদিকে শৃঙ্খলিত যুগের সমাপ্তিকারী, অপরদিকে উন্মুক্ত আধ্যাত্মিক নবযুগের সূচনাকারী (মারাজাল বাহরাইন) রূপে বিকশিত হয়েছেন। ৩। তিনি ঝিমিয়ে পড়া নীতিবিবর্জিত ধর্মকে নতুন জীবন দান সহ সকল ধর্মের সূক্ষ্ম ও স্থুলত্তের সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং ধর্মসাম্যতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ৪। তিনি ধর্মের আচারিকতাকে প্রাধান্য না দিয়ে নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে তাঁর গুণোমুগ্ধ ছিলেন। ৬। এটি সুবুদ্ধির দর্শন। সুবুদ্ধি সম্পর্কে হজরত শাহ্‌সুফি মওলানা মতিয়র রহমান শাহ্‌ (.) ফরহাদাবাদি বলেছেন, ‘সুবুদ্ধিতে খোদা, সুবুদ্ধিতে রসূল (.), সুবুদ্ধিতে কোরআন, সুবুদ্ধিতে ইসলাম, সুবুদ্ধিতে ঈমান এবং সুবুদ্ধিতে মানবতা’। সুবুদ্ধি ব্যতীত স্রষ্টামিলন অসম্ভব। সুবুদ্ধি ব্যতীত সর্বসাধন বৃথা। এখানে কুবুদ্ধির কোনো স্থান নেই। হযরতকেবলা বলেছেন, ‘এখানে হাওয়াকে দাফন করা হয়েছে’ অর্থাৎ প্রবৃত্তির বিনাশ করা হয়েছে। অতএব আত্মশুদ্ধিসহ প্রবৃত্তিকে বিনাশের মাধ্যমে ক্ষমা, দয়াপ্রাপ্তিসহ নিজেকে আলোকিত সত্তাতে পরিনত করার উদ্দেশ্যে মাইজভাণ্ডার শরিফ গেলেই হজরতকেবলার দর্শন, শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন এবং হজরতের বেলায়তের আলোতে আলোকিত হওয়া সম্ভব। অন্যথায় নয়। ৭। তিনি আধ্যাত্মিকতায় নিহিত বিজ্ঞানকে জানার পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আউলিয়াদের অলৌকিক ঘটনা, রহস্যপূর্ণ কালামে অসংখ্য হেকমত, বিজ্ঞান নিহিত। এসব জগৎবাসীর নিকট পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করেন; যাতে ভক্তশিষ্যগণ গবেষণা ও চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করতে পারেন। তরিকত জগতে চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করতে না পারলে সেই তরিকত চর্চার কোনো মূল্য নেই। এজন্য রাহবারে আলম হজরত সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান (.) মাইজভাণ্ডারী বলেছেন, ‘চিন্তাযুক্ত মানুষের জন্যই তরিকা, চিন্তাহীনদের জন্য নয়’। হজরতকেবলা যুগপৎ পরিবর্তনে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে আধ্যাত্মিকজ্ঞানে নিহিত বিজ্ঞানকে গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কল্যাণ করার পথকে সুগম করে দিয়েছেন। ৮। হজরত কেবলা প্রচলিত হাতে হাত রেখে বাইয়াত প্রথাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রেম ভক্তি সহ স্মরণকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। হজরতের স্পষ্ট ঘোষণা, ‘সুদূর ইয়েমেন থেকে আমাকে স্মরণ করলে সে আমার নিকটে। আর আমার নিকটে থেকেও স্মরণ থেকে বিচ্যুতি হলে সে আমার থেকে অনেক দূরে’। শাহানশাহ্‌ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক (.) মাইজভাণ্ডারী বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করেছেন। তাঁর নিকট মুরিদ হতে আসা মিরসরাই নিবাসী মোহাম্মদ ইয়াসিন বিল্লাহর উদ্দেশ্যে অট্টহাসিতে বলেন, ‘দরবারে ভক্তি বিশ্বাস নিয়ে যারা আসে সবাই মুরিদ’। তিনি আরো বলেন, ‘বাইয়াত করা মানে স্মরণ রাখা। স্মরণ রাখা বড় কষ্ট’। হাতে হাত রেখে বাইয়াত হতে হবে মাইজভাণ্ডারী দর্শনে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ভক্তি, বিশ্বাস, প্রেম নিয়ে স্মরণ করাই হলো বাইয়াত। ৯। আল্লাহ রাব্বুলআলামিন রক্তের ধারা থেকে আদর্শের ধারাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। রসূল(.), আউলিয়াগণ পুতপবিত্র। তাঁদের আওলাদগণও পবিত্র। কিন্তু এই পবিত্রতার তখনই মূল্য যখন রক্তের সাথে আদর্শের সমন্বয় হয়। আদর্শহীন ‘সৈয়দ’ থেকে আদর্শবান ‘গোলাম’ এর মূল্য অনেক বেশি। আদর্শহীন সৈয়দ বংশের ব্যক্তি কিংবা অলির আওলাদ ওই বংশের কলঙ্ক। পবিত্র কুরআনে বলা আছেযেহেতু হজরত নূহ (.)’র পুত্র কেনান পিতার আদর্শ ধারণ করে না; তাই আল্লাহপাক তাকে আহল (অলদ) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। স্বয়ং আল্লাহ আদর্শব্যতীত বংশধারাকে অলদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এই গুণের বহিঃপ্রকাশ রসূলেপাকের(.) মধ্যেও পাওয়া যায়। তিনিও আদর্শের ধারক বাহককে আহল হিসেবে গণ্য করেছেন। আওলাদ না হওয়া সত্ত্বে ও রসূলেপাক (.) হজরত সালমান ফারসিকে আওলাদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রক্তের সাথে আদর্শের সমন্বয় হলে পবিত্রতার সুগন্ধ পাওয়া যায়। রসূলেপাক (.)’র পদাঙ্ক অনুসরণকারী হজরত কেবলাও একই নীতি অনুসরণ করে বংশীয়ধারা এবং পাশাপাশি বংশীয়ধারার বাহিরে আদর্শের ধারক, বাহককেও উন্মুক্তভাবে বেলায়ত প্রদানসহ এমনকী বেলায়তে ওজমাও প্রদান করেছেন। ১০। তিনি সেমাহকাওয়ালীর সাথে ঢোলবাদ্যবাজনা, নৃত্যের (রকস) মাধ্যমে খোদাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিছু তরিকায় সেমাহমাহফিল থাকলেও এসব মাহফিলে (হাল) ভাববিভোরতা উদয় হইলে তা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে হয়, জাগ্রত হাল অন্তরেই রাখতে হয়। প্রকাশ করার রেওয়াজ নেই। হজরতকেবলা সেমাহকাওয়ালীর সময় ভাবের উদয় হলে; সেই ভাবকে প্রকাশ করার দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এজন্য লক্ষ করা যায়মাইজভাণ্ডারী সেমাহ কাওয়ালীর সময় বাদ্যবাজনার তালে তালে একজন পাপিষ্ট বান্দার মধ্যেও ভাবের (হাল) উদয় হয় এবং মওলার প্রেমে বেহুশ হয়ে কখন যে নৃত্য (রকস) করতে করতে বেহুশ হয়ে পড়ে নিজেও জানে না। রসূলেপাক (.) বলেছেন, ‘ক্ষণিকের ভাব বিভোরচিত্ত এবাদত দোজাহানের এবাদত থেকেও উত্তম’।

১১। হজরতকেবলা এমন এক মহান অলি, যাঁর সোহবতে অনেকই বেলায়তপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং তাঁদের কেন্দ্র করে পৃথক স্বাধীন, স্বকীয় দরবার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেখান থেকেও সকলে প্রতিনিয়ত পার্থিব ও অপার্থিব দয়া অর্জন করছেন। এভাবে হজরতকেবলা যুগের চাহিদা অনুসারে উন্নত কৌশল, বিজ্ঞান দ্বারা অসংখ্য পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন করে; নতুন দর্শন পদ্ধতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার সরকারের এ নীতি হাশর পর্যন্ত জারি থাকবে’।

সার্বিকভাবে মাইজভাণ্ডারী দর্শন বিশ্বমানবতার মুক্তির দর্শন, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞানের দর্শন, সর্বতরিকা সমন্বয়ের দর্শন। এ দর্শনের বৈচিত্রতা বুঝতে না পেরে অনেকেই হজরতকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছেন, ‘যিচ দোকানমে হার চিজ হে ওহি আচ্ছা হে’ অর্থাৎ যে দোকানে সকল কিছু পাওয়া যায় সেটি উত্তম দোকান। তীরে দাঁড়িয়ে যেমনি মহাসাগরের গভীরতা নির্ণয় সম্ভব নয়; তদ্‌্রপ মাইজভাণ্ডার না গিয়ে এ দর্শনের গভীরতা বোঝা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন অনুভূতি ও উপলব্ধি। হজরতকেবলার দর্শনের গভীরতা আত্মস্থ করে শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক (.) মাইজভাণ্ডারী বলেছেন, গধরুনযধহফধৎ রং ধহ ঙপবধহ. উড়হঃ ঃযরহশ ড়ঃযবৎরিংব। অনেকে না বুঝে, বুঝতে চেষ্টা না করে মাইজভাণ্ডারী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন, যেটি কোনো মতে কাম্য নয়। সহজ কথায় মাইজভাণ্ডার শরিফ আউলিয়া তৈরির কারখানা। পবিত্রতম এই স্থানের মর্যাদা সম্পর্কে মতিভাণ্ডার দরবার শরিফের সুফি হজরত মওলানা মতিয়র রহমান শাহ্‌ (.) ফরহাদাবাদীর আধ্যাত্মিক বাগানের উজ্জ্বল নক্ষত্র সুফি হজরত মওলানা আবুল ফয়েজ শাহ্‌ (রহ.) বলেন, ‘মাইজভাণ্ডার শরিফের দিকে তাকিয়ে থাকাটাও ইবাদত’।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক; সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভে মুমিনের দোয়া
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা