ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দ শহরে আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ফারুক (র.) এর বংশধর হজরত আবদুল আহাদ সিরহিন্দির ঔরসে ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র.) হিজরী ৯৭১ সনের ৪ঠা শাওয়াল শুক্রবার ভূপৃষ্ঠে তশরিফ আনেন। অত্যন্ত অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন হেফ্জ করেন। পিতার কাছে এল্ম শরিয়তের প্রাথমিক পাঠ সমাপণ করে শিয়ালকোটের প্রখ্যাত আলেম কামাল উদ্দিন কাশ্মিরীর কাছে ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। এরপরে তিনি মুহাদ্দিস শায়খ এয়াকুব কাশ্মিরীর কাছে গিয়ে বিভিন্ন হাদিস রপ্ত করে সনদ লাভ করেন। এরপরে কাজী বদখশানীর কাছ হতে তাফসীর, ফিক্হ ও আদব শিক্ষা গ্রহণ করে সনদ লাভ করেন। এভাবে তিনি এল্ম শরীয়ত এর পণ্ডিত রূপে আলেম সমাজে সমাদৃত হলেন।
এলম্ শরীয়ত এর পাঠ শেষ হলে তদীয় বুজর্গ পিতা হজরতকে চিশতিয়া, কাদেরীয়া এবং সুহারাওয়ার্দীয়া তরীকায় মুরীদ করেন এবং তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য দেখে তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন।
উপ-মহাদেশে মোগল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর একজন খাঁটি সুন্নী হানাফী মুসলমান ছিলেন। তাঁর পুত্র হুমাইয়ুন যখন শের শাহ্ শুরীর আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে পারস্যে পালিয়ে গিয়ে শিয়া সম্রাট তামাস্পের সাহায্য প্রার্থী হন, তখন সম্রাট ১২ হাজার শিয়া সৈন্য, সেনাপতি বৈরাম খাঁর নেতৃত্বে হুমাইয়ুনের সাহায্যে পাঠিয়ে দেন। এতে শেরশাহ্ পরাজিত হলেন। এ ঘটনার পর থেকে ভারতবর্ষে শিয়াদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেলো।
হুমাইয়ুনের মৃত্যুর পরে তাঁর তেরো বৎসর বয়সী পুত্র জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর শিয়া সেনাপতি বৈরাম খাঁর অভিভাবকত্বে মুগল দরবারের শাসনভার গ্রহণ করেন। এ সময় থেকে শিয়া সুন্নী বিরোধ শুরু হয়। সুযোগ বুঝে দরবারের চাটুকার আলিমগণ ধর্মে ধর্মে বৈষম্য ও অসহিষ্ণুতার কথা বলে সম্রাটকে প্ররোচনা দান করতে থাকে। সম্রাট নিজের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে সত্য মিথ্যার বাছ বিচার না করে সকল ধর্মের মানুষকে এক ধর্মে নিয়ে আসার জন্যে ভাবনা চিন্তা করতে থাকলেন।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.) এর পরে হাজার বছর গত হলে দেখা গেলো দীন ইসলাম এবং মুসলমানদের মধ্যে শির্ক, কুফরী ও বেদআত ঢুকে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মুগল সম্রাট আকবরের দরবারের মোল্লা মোবারক নাগোরী তদীয় পুত্রদ্বয় যথাক্রমে আবুল ফজল এবং ফৈজী ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ এবং সম্রাটের মনোরঞ্জনের মানসে, পার্থিব ধনসম্পদ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সম্মানের লোভী হয়ে নিজেদের ঈমানকে জলাঞ্জলি দিয়ে, কুরআন হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করে দীন ই ইলাহী নামে একটি ভুয়া ধর্মের প্রবর্তন করে। এতে সম্রাট, দুনিয়াদার আলিম এবং চাটুকার আমাত্যদের হীন মানসিকতায় প্ররোচিত হয়ে শাহী ফরমান জারী করে ধর্মভীরু প্রজাদের বাধ্য করেন নব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের জন্য।
সম্রাটের আনুগত্যশীল এই বানোয়াট ধর্মের বিরুদ্ধে ঈমানী দায়িত্ব নিয়ে হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র.) প্রথম কলম হাতে তুলে নেন। দীন ই ইলাহীর অসারতা ব্যাখ্যা করে সম্রাটের দরবারের আমীর ওমরা, তৎকালীন আলিমে দীন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে হযরত এমন যুক্তিপূর্ণ চিঠিপত্র লেখা শুরু করলেন যে, তাঁর ক্ষুরধার যুক্তির সামনে দীন ই ইলাহীর কোন সারবত্তা খুঁজে পাওয়া গেলো না। অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে সম্রাট দীন ইলাহীকে ঐচ্ছিক ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করেন।
সম্রাট আকবর এবং তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীরের শাসনকালে অত্যন্ত প্রতিথযশা ইসলামী পন্ডিত ও মনীষী মজুত থাকা সত্ত্বেও দীন ইসলামকে রক্ষার জন্য সম্রাটের মোকাবেলা করতে কেউ সাহসী হননি। অথচ একমাত্র হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী এ সমস্ত ফেত্না প্রসূত অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে একাকী রুখে দাঁড়ান। আলিমগণের মধ্যে শেখ ওজিহ গুজরাটি, শেখ জালাল থানেশ্বরী, মাওলানা ইয়াকুব কাশ্মিরী, শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী, মোল্লা আবদুল হাকিম শিয়ালকোটী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় মুফ্তী তখন রাজ্যে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু যুগের সংস্কার কারো দ্বারা সম্পন্ন হয়নি, একমাত্র মুজাদ্দেদ আলফেসানাী (র.) এই জিম্মাদারী গ্রহণ করেছিলেন।
সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত নতুন ধর্মের প্রধান উপাদান হচ্ছে সূর্যের উপাসনা করা। কথিত আছে তিনি সকাল থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত দৈনিক চার বার এই উপাসনা করতেন। আবুল ফজলের গভীর প্ররোচনার ফলে তিনি পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করতেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, আকবর প্রথম জীবনে অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিলেন। এবাদত বন্দেগীতে যথেষ্ট সময় কাটাতেন, এমন কি ঘরে বাইরে সকল স্থানেই তিনি জামাতে নামাজ আদায় করতেন। পরবর্তীকালে দুনিয়াদার আলেমগণের প্ররোচনায় তিনি নতুন ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
আকবরের মৃত্যুর পরে, শিয়াপন্থী স্ত্রী নূর জাহানের অশুভ প্ররোচণায় অতিষ্ঠ তদীয় পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে হজরতকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করে ফেললে ভারতবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে থাকা হজরতের হাজার হাজার মুরীদ রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। হজরত তাদের উদ্দেশ্যে লিখলেন, ‘যদি সম্রাট আমাকে জেলখানায় প্রেরণ না করতেন, তাহলে এত সহস্র কয়েদী কিভাবে দীন ইসলামের ছায়াতলে আগমন করতো এবং আমার উপর এই বিপদ আপতিত হওয়া ব্যতীত আমার আধ্যাত্মিক উন্নতির অন্যকোন উপায় ছিল না।’ কিন্তু এতদসত্ত্বেও হজরতের হাজার হাজার ভক্ত অনুসারী সম্রাটকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার মানসে বিপুল পরিমাণ সৈন্য সামন্ত নিয়ে রাজধানীর দিকে ধাবিতহয়। অবশেষে হজরতের বিশিষ্ট মুরীদ কাবুলের শাসনকর্তা মোহাব্বত খানের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সম্রাটকে বন্দী করে ফেলে। পরিশেষে সম্রাট আকবর প্রবর্তিত অনৈসলামিক নিয়মকানুন বাতিলের শর্তাবলী মেনে নিয়ে জাহাঙ্গীর হজরতকে মুক্তি দিয়ে তওবাহ করে হজরতের মুরীদ হয়ে যান। কথিত আছে যে, সম্রাট জাহাঙ্গীর একদা সিরহিন্দে উপস্থিত হয়ে হজরতের মেহমান হন এবং লঙ্গরখানায় প্রস্তুতকৃত খাদ্য খেয়ে অত্যন্ত তৃপ্তিবোধ করেন। তিনি শেষ বয়সে বলতেন, ‘জীবনে আমি এমন কোন ভাল কাজ করিনি, যদ্দারা পরিত্রাণের আশা করা যায়, তবে আমার কাছে একটি সনদ আছে আর সেই সনদ হচ্ছে হজরত একদিন আমাকে বলেছিলেন, যদি রাব্বুল আলামীন আমাকে বেহেস্তে প্রবেশাধিকার দান করেন তবে আপনাকে ছাড়া আমি যাবো না।’
আধ্যাত্মিক জগতের কান্ডারী হজরত আবদুল কাদের জিলানী (র.) প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বে একদা অন্তরদৃষ্টির মাধ্যমে হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র.) এর আগমনের সংবাদ অবগত হয়ে স্বীয় জুব্বাহ মোবারক তাঁর জন্যে উপহার স্বরূপ রেখে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরই আওলাদ হজরত শাহ সেকান্দর (র.) এই জুব্বাহ খানা হজরতের পবিত্র হস্তে অর্পণ করেন। নক্শবন্দীয়া তরীকার প্রখ্যাত বুজর্গ হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ (র.) নিজ পীর সাহেবের নির্দেশে সুদূর কাশ্মির থেকে ভারতবর্ষে আগমন করেছিলেন হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানীর আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ দানের জন্যে। তারপর অল্প কিছুদিনের মধ্যে হজরতের অসাধারণ আধ্যাত্মিক উন্নতি লক্ষ্য করে খাজা সাহেব তাঁর সামনে মুরীদের মতো নতজানু হয়ে বসতে থাকলেন। হজরতের অতীন্দ্রিয় জ্ঞান গরিমা উপলব্ধি করে তিনি বলতেন শায়খ আহমদ আধ্যাত্মিক জগতের একটি সূর্য। তাঁর উজ্জ্বলতার সামনে আমাদের মতো শত শত তারকা নিসপ্রভ বটে।’
বস্তুত হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র.) ছিলেন একাধারে মুজতাহিদ, ফকিহ্, এল্ম মারিফাতের বিশাল মহীরূহ। তাঁর বিশাল জ্ঞান এবং ঈমানের দাপটের কাছে পরাক্রমশালী সম্রাট আকবরের অহংকার ধুলোয় মিশে গিয়েছিলো, নেশাগ্রস্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের তওবাহ্ নসীব হয়েছিলো এবং আওরঙ্গজেবের মতো ঈমানদার সম্রাটের আবির্ভাব হয়েছিলো।
হজরতের প্রবর্তিত মুজাদ্দেদিয়া তরীকার আলোয় আজ ভারতবর্ষের অনাচে কানাচে আলোকিত। এ তরীকার প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে যুগবরেণ্য আলেমেদীনগণ এবং অগণিত সূফী মাশায়খ কেরাম। তাইতো পিতৃ প্রদত্ত নাম শায়খ আহমদ সিরহিন্দী ঢেকে গেছে মুজাদ্দেদ আলফেসানী নামের বিশালতার প্রভাবে। এ উপমহাদেশে এল্ম মারিফাতের অনুসারীদের কাছে চারটি তরীকা খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সেগুলো যথাক্রমে কাদেরীয়া, চিশ্তিয়া, নক্শবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদীয়া। বাংলাদেশে মুজাদ্দেদীয়া তরীকার প্রচলন অত্যন্ত বেশী বলে মনে হয়। হজরত অনেক কিতাব ও রিসালা লিখেছেন। তার মধ্যে মারিফে লাদুন্নিয়া, মুকাশিফাতে আয়নিয়া, মাব্দা ওয়া মাআত, তাহলিলিয়া, এছবাতুন্ নবুয়ত ও মকবুবাত শরীফ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র.) হিজরী ১০৩৪ সনের ২৭শে সফর তেষট্টি বৎসর বয়সে সিরহিন্দে ইন্তেকাল করেন। লেখক : প্রাবন্ধিক