বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু গেল জুনেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭১১ জনের মৃত্যু এবং ১ হাজার ৯০২ জন আহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৬ হাজার ৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২৯৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ১৯ জন। এর আগে ২০২৩ সালে ৬ হাজার ৯১১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫২৪ জন নিহত ও ১১ হাজার ৪০৭ জন আহত হয়েছেন। ২০২২ সালে ৬ হাজার ৮২৯ দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭১৩ জন নিহত ও ১২ হাজার ৬১৫ জন আহত হয়েছেন। সমপ্রতি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ২৩% পথচারী ও ৪.২% সাইকেলচালক বা আরোহী। গবেষণা সংস্থা সেভ দ্য রোডের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ৬ মাসেই সারা দেশে ১৭ হাজার ৯৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৭৭৮ জন আর আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮২৬ জন। জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের বিষয়গুলো সড়ক নিরাপত্তায় ব্যবহার করে মৃত্যুহার কমিয়ে এনেছে। যেমন–সুইডেনে প্রতিলাখে মৃত্যুর হার মাত্র ২.৮। এছাড়া ডব্লিউএইচও–এর ৭টি অঞ্চল সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের ব্যবহার করে মৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে। এর মধ্যে ইউরোপীয় অঞ্চলে সড়কে মৃত্যুর হার ৩৬% হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একাধিক দেশে মৃত্যুর হার ১৫% হ্রাস পেয়েছে।
উপরে উল্লিখিত তথ্যের আলোকে বলা যায়, সারা দেশের সড়কগুলোকে নিরাপদ করার বিষয়ে অনেক আলোচনা হলেও বাস্তবতা হলো, সড়কে নৈরাজ্য চলছেই। সড়ক–মহাসড়কগুলোয় যানবাহন চলাচলে কোনো শৃঙ্খলা না থাকার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ত্রুটিপূর্ণ রোড ইঞ্জিনিয়ারিং, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালানোয় বাড়ছে দুর্ঘটনা। ২০২৪ সালে সরকার ‘মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা’ জারি করলেও তা প্রয়োগের নির্দেশনা না থাকায় এর সুফল মিলছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মামলার এক শতাংশেরও চূড়ান্ত বিচার হচ্ছে না। তাঁদের মতে, এক্ষেত্রে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। এতে হতাহতের সংখ্যাও বেশি। ফলে সবার আগে দরকার নিরাপদ সড়ক। এ জন্য সড়ক নির্মাণের সময় সেফটি ফিচারগুলো অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এক্ষেত্রে রোড ইঞ্জিনিয়ারিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাংঙ্কিং অনুসারে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। রোডক্র্যাশে (সড়ক দুর্ঘটনা) মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে পথচারী, সাইকেল ও মোটরসাইকেল আরোহী। সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ ছাড়া দেশে রোডক্র্যাশ কমানো সম্ভব নয়।
তাঁরা বলেন, ২০১৮ সালে যে সড়ক পরিবহন আইন হয়েছে সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যা মামলা করার বিধান যুক্ত হয়। কিন্তু সেটির বিষয়ে মালিকপক্ষের আপত্তির কারণে ওই আইন এখনো পুরোপুরি কার্যকরী হয়নি। দোদুল্যমানতার মধ্যেই আছে। যদি নতুন আইনটি পুরোপুরি কার্যকরী হয় তাহলে সাজা নিশ্চিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, নিরাপদ সড়কের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনপূর্বক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতিসংঘ গত দশককে ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এ সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে সদস্য দেশগুলো একমতও হয়েছিল। কিছু দেশে এরই মধ্যে উন্নতি ঘটলেও বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তায় এখনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
বলা জরুরি যে, দেশে সড়ক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলেও সড়ক নিরাপত্তা রয়ে গেছে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে। সড়ক নিরাপত্তার ঘাটতিতে প্রতিদিনই দেশের কোথাও কোথাও ঘটছে দুর্ঘটনা; দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বার্ষিক মৃত্যুহার উচ্চ আয়ের দেশগুলোর দ্বিগুণ এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ নৈপুণ্য দেখানো অর্থনীতিগুলোর চেয়ে পাঁচ গুণের অধিক। এমনকি আঞ্চলিক গড় বিবেচনায়ও দেশে সড়কে মৃত্যুহার বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সময় কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও তাতে মেলেনি তেমন সুফল। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এবং সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় প্রশাসনকেও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।