বাংলাদেশে অপ্রদর্শিত বা অবৈধ অর্থের পরিমাণ কত, তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের কোনো গবেষণা নেই। বিশ্বব্যাংক ২০০৫ সালের এক গবেষণায় বলেছে, ২০০২-০৩ সালে বাংলাদেশে এ ধরনের টাকার পরিমাণ ছিলো মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এদিকে ২০১১ সালে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় অপ্রদর্শিত ও অবৈধ অর্থ নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রদর্শিত অর্থ অর্থনীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে সরকার শুরু থেকেই সচেষ্ট ছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে অর্থবছরের মাত্র ছয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ বৈধ করা হয়েছে বলে সম্প্রতি এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার রেকর্ড একটি করোনার মধ্যে পুঁজিবাজার ও রিয়েল এস্টেট খাত চাঙ্গা থাকার পেছনে এ অর্থের ভূমিকা রয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার প্রক্রিয়া ও প্রভাব প্রশ্নমুক্ত নয়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দেশের অভ্যন্তরে অপ্রদর্শিত বা অবৈধ অর্থ তৈরি হয়। অর্থনীতির মূলধারায় এ অর্থ প্রবেশে বাধা দিলে তা পাচার হয়ে যাওয়ার শঙ্কাও থাকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার তথ্যানুযায়ী, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। কিন্তু দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এমন প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের বাজেটে বলা হয়েছে, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই না কেন, নতুন অর্থবছরের বাজেটের মধ্যে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণেই অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা আস্থা পেয়েছেন এবং সুযোগ নিয়েছেন অর্থ বৈধ করার। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত স্বেচ্ছায় অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শন এবং বিদ্যমান কর প্রদানের মাধ্যমে বৈধ করার সুযোগ দিয়ে সুফল পেয়েছে। নেপালও একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে অপ্রদর্শিত টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় আনা যেতে পারে। এটি একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াবে, অন্যদিকে অবকাঠামো উন্নয়নেও পর্যাপ্ত অর্থ মিলবে। আর্থিক খাতের উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতির উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গেল কয়েক বছরে অর্থনীতির ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে করজাল বিস্তৃত হয়নি। ফলে ছায়া অর্থনীতির আকার বেড়েছে। এক্ষেত্রে এনবিআর করজাল বাড়াতে উপজেলা পর্যায়ে তদারকি কার্যক্রম বিস্তৃত করতে পারে। রাজস্ব প্রদানে সক্ষম ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে তাদের করজালের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে জরিমানা আরোপের ফলাফল ইতিবাচক নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়। জটিল কর আইনও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে ছায়া অর্থনীতি তৈরি হয়। এটি রোধে কর আইনকে আধুনিকায়ন করতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব প্রশাসনকে শক্তিশালী, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাজস্ব কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, উন্নত রাজস্বসেবা নিশ্চিতের মতো পদক্ষেপ অপ্রদর্শিত অর্থ তৈরির পথ বন্ধে সহায়তা করবে। দুর্নীতি, ঘুষ ইত্যাদি বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে দুদককে আরো সক্রিয় করতে হবে। অর্থ পাচার বন্ধে তদারকি বৃদ্ধি, আর্থিক প্রতিবেদনে আরো স্বচ্ছতা আনয়ন, কর ফাঁকির শাস্তি নিশ্চিতের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। কর ছাড়ের মাধ্যমে পাকিস্তান, ভারতসহ অনেক দেশে অপ্রদর্শিত অর্থ হিসাবের মধ্যে আনতে উদ্যোগ নিলেও তাতে তেমন সুফল আসেনি। কর ছাড়ের বিষয়টিকে সময়োপযোগী কর প্রণয়ন করতে হবে, যাতে অপ্রদর্শিত অর্থের অধিকারীরা বিনা দ্বিধায় সুযোগটি গ্রহণ করে। কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা এড়াতে নিয়মিত রাজস্ব অডিট পরিচালনা, তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে জরিমানা ও শাস্তি এমন পর্যায়ে নির্ধারিত ও বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে মানুষ কর ফাঁকি দিতে না পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক সাদরেল রেজা এক গবেষণা প্রবন্ধে অবৈধ আয়কে দুইভাগে ভাগ করেছিলেন। যেমন সরল কালো আয় ও যৌগিক কালো আয়। সরল কালো আয়ের উৎস তিনটি। যৌগিক কালো টাকার উৎসও তিনটি। এর মধ্যে ব্যবসা, শিল্প ও সেবা সম্পৃক্ত উৎসের মধ্যে ছিল বৈদেশিক মুদ্রার অবৈধ লেনদেন, চোরাচালান, ভেজালপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি নিম্নমানের নির্মাণ কর্মকাণ্ড, কর ফাঁকি, অবৈধ জুয়া, ব্যাংক ঋণ ফেরত না দেয়া, বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি ইত্যাদি। অপ্রদর্শিত টাকা সৃষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী উভয় প্রকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমেই অবৈধ টাকার পরিমাণসহ বাহকদের চিহ্নিত করতে হবে, যাতে অর্থনীতির অনুকূলে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া যায়। প্রথমত, সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর যারা সৎ বিনিয়োগকারী, তারা অবৈধ টাকার সঙ্গে পেরে ওঠেন না। ফলে অর্থনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট হয়। প্রতি বছরই অবৈধ অর্থ বৈধ করার এমন সুযোগে সৎ করদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, এটিও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। এ সুযোগ অনন্তকাল দেয়া নৈতিক বিরুদ্ধে। এতে সৎ করদাতারা বৈষম্যের মধ্যে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে। অপ্রদর্শিত বা অবৈধ অর্থ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ অপ্রদর্শিত অর্থ সৃষ্টির সুযোগ অবারিত থাকলে সেই অর্থনীতির সামাজিক বৈষম্য ও আর্থিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে।