স্যালুট জানাই শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীকে

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ২ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

নিজের পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে আপনি যখন ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে ক্লাস থেকে টেনে টেনে বের করছিলেন, তখন আমি পুরান ঢাকার এক রেস্টুরেন্টে ঢাকাইয়া ঐতিহ্যবাহী খাবারের অপেক্ষায় ছিলাম। সাথে ছিল বন্ধুবান্ধবীরা। সেই মুহূর্তে খবর এলো উত্তরায় প্লেন ক্রাশ করেছে মাইলস্টোন স্কুলে। অনেক ছাত্রছাত্রী হতাহত হওয়ার আশঙ্কা। এই খবরে আমাদের খাবার টেবিলে নেমে এলো বিষাদের ছায়া। সবাই উত্তরায় থাকা আত্মীয়স্বজনের খবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ডিজিটাল যুগ। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রকৃত ঘটনা ভাইরাল হলো। নিউজ ডেস্ক, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ভরে গেল আগুনের লেলিহান শিখায়, বিধ্বস্ত প্লেনটির ছবি, কোমলমতি বাচ্চাদের আর্তনাদ আর বাঁচার আকুতি, মাবাবা, শিক্ষকশিক্ষিকাদের আহাজারি, চিৎকার, বিলাপ আর কান্নায় এলাকার আকাশবাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল।

এক পর্যায়ে মোবাইল বন্ধ করলাম। কারণ আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমরা কি খেলাম, না খেলাম বুঝিনি। বুকটা অজানা কষ্টে ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছিল। এর পরের ঘটনা সবার জানা। খুব দ্রুত হতাহতের খবর এলো। পাইলট তৌকিরের প্রশিক্ষণ বিমানটি বিকল হয়ে আছড়ে পড়েছে দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুলে। যেখানে প্লেনটি ক্রাশ হলো সেই ক্লাসরুমে সব ছোট ছোট বাচ্চা। স্কুল ছুটির সময় তারা যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল, তখনই আচম্বিতে এই প্লেন বিকট শব্দে প্রবেশ করল অবুঝ শিশুগুলোর ক্লাসরুমে। সাথে সাথে আগুনের লেলিহান শিখায় তারা ঝলসে গেল। কেউ কেউ অগ্নিদগ্ধ হয়ে বেরিয়েছিল। সারা শরীর পুড়ে গেছে, শরীর থেকে মাংসপিণ্ড খসে পড়ছে। কিন্তু যারা ভেতরে ছিল তাদের কেমন লাগছিল কে জানে। একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল নাকি অর্ধপোড়া অবস্থায় তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল? মাকে ডেকেছিল, মা সারা শরীর জ্বলছে, পানি দাও, পানি দাও, বুক ফেটে যাচ্ছে।

তবে স্কুলের কোঅর্ডিনেটর শিক্ষিকা মাহেরীন নিজের অগ্নিদগ্ধ শরীর নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে ২০টি বাচ্চার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি আর দগ্ধ যন্ত্রণা সইতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলে উদ্ধারকর্মীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি তখন অনেকটা মৃতপ্রায়। আইসিউতে উনার স্বামী উনাকে জিজ্ঞেস করছিলেন কেন তুমি আগুনে ঝাঁপ দিলে? তোমারও তো দুটো বাচ্চা আছে। তিনি বললেন, আমি পুড়ে গেলেও ২০টি বাচ্চাকে তাদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। এই কথা বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনিও পাড়ি দিলেন পরপারে।

কি মানবিক শিক্ষক! নিজের জীবন দিয়ে বাচ্চাদের উদ্ধার করতে আগুনে প্রবেশ করলেন আর বাচ্চাদের বলছিলেন, ভয় পেয়ো না, দৌড়াও, আমি তোমাদের পেছনেই আছি। তখন কিন্তু উনার সারা শরীরে আগুন। অথচ তিনি সহজেই অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু কতটুকু মানবিক আর মমতাময়ী হলে নিজের জীবন বাজি রেখে তিনি আগুনের লেলিহান শিখা থেকে ২০টি বাচ্চাকে উদ্ধার করতে পারেন।

উনার এই যন্ত্রণাদায়ক আত্মদানে আমরা জানতে পারলাম নির্মম আর মূল্যবোধের অবক্ষয়যুক্ত সমাজে এখনো মানবিক কিছু মানুষ আছেন। নিদারুণ পোড়া ক্ষত নিয়ে তিনি আইসিউতে গেলেন, সেখান থেকেই লাইফ সাপোর্টে। স্বামীর সঙ্গে উনার শেষ কথা হলো, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। স্বামী চেয়েছিলেন উনার শরীর স্পর্শ করতে, কিন্তু পোড়া দগদগে ক্ষতে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখারও সুযোগ ছিল না।

মাহেরীন চৌধুরী দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে মাইলস্টোন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। দুর্ঘটনার দিনে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ক্লাসের কোঅর্ডিনেটর ছিলেন। ফলে বাচ্চাগুলোকে সিরিয়ালি অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়াই ছিল তাঁর সেদিনের ডিউটি। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এমন কঠিন দায়িত্ব পালন করলেন নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে। এই আত্মদান সারা দেশের স্কুলগুলোতে তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন স্কুলের কাছে তিনি মাইলস্টোন হয়েই থাকবেন। উনার জন্যই তো কবি লিখে গিয়েছিলেন : ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’

জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা রবে? এটি জেনেও কিছু কিছু মৃত্যু ইতিহাস হয়ে থাকে। শিক্ষিকা মাহেরীনের মৃত্যু ও ইতিহাসের মর্মান্তিক চিরবিদায়ের অংশ হয়ে থাকবে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় পাইলট তৌকিরের মৃত্যুতে দেশ হারাল এক মেধাবী, সম্ভাবনাময়ী পাইলটকে। আর এতগুলো তাজা প্রাণ, কচি কচি ভাইবোন, ছেলে আর মেয়ের মৃত্যু সংবাদে ঢলে পড়লেন মাও। কি হৃদয়বিদারক! একইসাথে পাশাপাশি শায়িত হলো তিনটি কবরে। কত পরিবারে স্বজন হারাদের আর্তনাদ, কান্নার রোলে আকাশবাতাস কাঁপছে। আমরা সমব্যথী। শোক আর সমবেদনা জানানো ছাড়া আমাদের আর কোনো ভাষা নেই। আহা! জীবন কত ছোট্ট, মৃত্যু কত কাছে। রয়েছে পিছে পিছে। তারাশংকর তাই তো লিখেছিলেন, জীবন এতো ছোট ক্যান রে!

পূর্ববর্তী নিবন্ধপারিবারিক আদালত আইন ২০২৩
পরবর্তী নিবন্ধ৫ আগস্ট বিজয় মিছিল সফল করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহবান