সবেমাত্র মাস্টার্স শুরু করেছিলাম ২০০১ সালের দিকে। কসমোলজি বা মহাবিশ্বতত্ত্ব বিষয়ক মজার কিন্তু জটিল একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে হবে। সুপারভাইজার ছিলেন গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদ স্যার। প্রথমদিকে মহাবিশ্বের গঠন নিয়ে কম গাণিতিক, গল্পের মতো রহস্যঘেরা মজার মজার কিছু বই পড়ছিলাম। মহাবিশ্ব সৃষ্টির গল্পের মতো মজার ব্যাপারগুলো জেনে বেশ আগ্রহ পেলাম ধীরে ধীরে। পরবর্তীতে গবেষণার কাজ একটু একটু শুরু করলাম আজাদ স্যারের সাথে। স্যার কসমোলজি বুঝাতে গেলে পুরা মহাজগৎ থেকে একবার করে ঘুরিয়ে আনতেন। অবাক হতাম বোঝানোর এত ধৈর্য্যশক্তি স্যার কোথায় পান। শিশুসুলভ একটা হাসি সবসময় লেগে থাকতো স্যারের চোখে-মুখে। জটিল জিনিষ খুব সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করতেন প্রচুর সময় দিয়ে। শূন্য আর এক এর মাঝে লাখো-কোটি সংখ্যা হতে পারে, সেটা আমার ছোট মস্তিষ্কে প্রথম ঢুকিয়েছিলেন স্যার বিগব্যাং পরবর্তী মহাজগতের গ্যালাঙির সংখ্যা বুঝাতে গিয়ে। আগেই বলছি গবেষণার বিষয় ছিল গাণিতিক কসমোলজি। এ বিষয়ের বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত এমিরেটাস প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যার এর ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ” অ্যান ইন্ট্রুডাকশান টু ম্যাথমেথিক্যাল কসমোলজি” বইয়ের বেশ কিছু গাণিতিক সমীকরণ সমাধান ছিল আমার মূল কাজ। আজাদ স্যারের পিএইচডি সুপারভাইজার ছিলেন এ মহান ব্যক্তি জামাল স্যার।
শুরুতেই ধাক্কা খেলাম জামাল স্যারের বইটি পড়তে গিয়ে। দেখলাম এক সমীকরণ থেকে আরেক সমীকরণে যেতে প্রায় দু-পৃষ্ঠা ক্যালকুলেশন করতে হচ্ছে। অসম্ভব রকম কঠিন ছিল ক্যালকুলেশনগুলো। নিজেকে নিজে বললাম চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আরও সহজ সহজ বই খোঁজার চেষ্টা করলাম। সবসময় রেফারেন্স বই হিসাবে আজাদ স্যার কিছু কসমোলোজিস্টদের নাম বলতেন, যেমন: স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত ভি. নার্লিকার, রজার পেনরোজ ইত্যাদি। স্যার বলতেন, দেখো জামাল স্যার দেশে ফিরে আসাতে হয়তো স্যারের নোবেল মিস হলো, তবে কিন্তু হকিং, পেনরোজ এরা কিন্তু একসময় পেতে পারেন। স্যার আজ নেই, কিন্তু কথা সত্যি বলেছিলেন।
পদার্থবিজ্ঞানে এবার যে তিনজন নোবেল পুরস্কার পেলেন তাদের একজন রজার পেনরোজ। বাকীরা হলেন রেইনহার্ড গেনজেল ও আন্দ্রিয়া ঘেজ। মহাবিশ্বের সৃষ্টির পর অন্যতম রহস্যময় বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁরা। সন্ধান পেয়েছেন নতুন এমন এক বিষয়ের, যা সেই রহস্যের উদঘাটনে নয়া দিগন্তের উন্মোচন করেছে। সেই কৃষ্ণ-গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল সংক্রান্ত গবেষণার জন্য এবার পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন।
যুক্তরাজ্যের অঙফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক রজার পেনরোজ। বয়স প্রায় ৯০বছর। পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলেও প্রফেসর রজার পেনরোজ মূলতঃ একজন গণিতজ্ঞ। গণিতের সূত্র প্রয়োগ করে এ বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন যে আপেক্ষিকতাবাদের সাধারণ তত্ত্বের প্রত্যক্ষ পরিণতি হল কৃষ্ণ গহ্বর। সোজা কথায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে অঙ্ক কষে স্যার রজার পেনরোজ প্রমাণ করেছেন যে ব্ল্যাক হোল গঠন সম্ভব। ১৯৬৫ সালেই সেই গবেষণার ব্যাখ্যা করেছিলেন পেনরোজ যার স্বীকৃতি পেলেন তিনি এবার। উল্লেখ্য মহাবিশ্বের গঠন সংক্রান্ত পেনরোজের সমসাময়িক আমাদের জামাল স্যারের ও বিশ্বে সমাদৃত ” দ্যা আলটিমেট ফেট অব দ্যা ইউনিভার্স” নামে একটি গবেষণা পত্র রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো -আইনস্টাইন নিজেও বিশ্বাস করতেন না যে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব আছে। এর মধ্যে যা প্রবেশ করে, তার সবকিছু ধরে ফেলতে পারে অত্যন্ত উচ্চ ঘনত্বসম্পন্ন ভারী এই দানবাকার বস্তু। কোন কিছুই সেখান থেকে বের হতে পারে না, এমনকি আলোও নয়। এসব শুনে আমি হা করে থাকলে, এটার সত্যিকারের মর্মার্থ বোঝাতে আজাদ স্যার বলতেন, ব্ল্যাক হোল থেকে এক চামচ মাটি পৃথিবীতে আনলে সেটা টেনে নিয়ে যেতে একশোটা হাতি লাগবে।
যাই হোক আইনস্টাইন কিন্তু এটা দেখিয়েছিলেন যে, কোনো ভারী মহাজাগতিক বস্তুর অভিকর্ষ বল বা অসম্ভব জোরালো টানে আশপাশে থাকা প্রায় সবকিছুই ভারী বস্তুটার মধ্যে ঢুকে পড়ে। তার অভিকর্ষ বলের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না সবচেয়ে কম ভারী আলোর কণাও। এরাই ব্ল্যাক হোল। আলো বেরিয়ে আসতে পারে না বলেই এদের এমন নামকরণ। কিন্তু এটা কেমন করে সম্ভব, সে বিষয়টাই পরিষ্কার হতে পারছিলেন না আইনস্টাইন। যার কারণে ১৯১৫ সালের নভেম্বরে এমন ধারণার জন্ম দিলেও প্রকাশ্যেই তিনি বলতে শুরু করেছিলেন, সত্যি সত্যিই এমন কিছু এ মহাবিশ্বে আছে বলে মনে হয় না। পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, শুধু যে অস্তিত্ব আছে তাই না- এর চার পাশে থাকে একটা এলাকা, যার নাম ‘ইভেন্ট হরাইজন’। কিন্তু এদের অস্তিত্ব সম্ভব এটা বিশ্বাসই করে উঠতে পারছিলেন না আইনস্টাইন। প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৬৫ (আইনস্টাইনের মৃত্যুর ১০ বছর পর) সালে আইনস্টাইনের সেই সংশয় দূর করেছিলেন স্যার রজার পেনরোজ। গাণিতিকভাবে পেনরোজ দেখিয়েছিলেন, ব্ল্যাক হোল সত্যি সত্যিই আছে ব্রহ্মাণ্ডে। সেগুলো কীভাবে গঠিত হয়, সেটাও গাণিতিক উপায়েই প্রথম দেখিয়েছিলেন তিনি। ফলশ্রুতিতে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদকে। রীতিমত গণিতের হিসেব করে তিনি দেখিয়েছিলেন ব্ল্যাক হোলের ভিতরে রয়েছে এমন একটি সীমানা, যেখানে পৌঁছে প্রকৃতির সব নিয়মই ভেঙে পড়ে। এক কথায় সেখানে অকার্যকর পদার্থবিদ্যার সবসূত্র। এই ব্রহ্মাণ্ডের শেষও যে সেই ব্ল্যাক হোলেই, সেই তথ্যও বেরিয়ে এলো পেনরোজের সমীকরণ থেকে। কৃষ্ণগহ্বর আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে যে সংশয় ছিল-এবারের নোবেল কমিটি স্যার রজার পেনরোজের ঝুলিতে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারটি দিয়ে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব বিতর্কের অবসান ঘটালেন।
এবার আসি স্যার রজার পেনরোজের বাংলাদেশ ভ্রমণ নিয়ে। জামাল স্যারের উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা (জঈগচঝ) কেন্দ্রে (বর্তমানে এটি জামাল স্যারের নামে ঔঘওজঈগচঝ) গাণিতিক পদার্থবিদ্যার ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালে। গবেষণা কেন্দ্রের ডেপুটি রেজিস্ট্রার শরীফ মাহমুদ সিদ্দিকী মারফৎ জানলাম, উক্ত সম্মেলনে নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম সহ অধ্যাপক রজার পেনরোজ, অধ্যাপক জন টেইলর প্রমুখ বিখ্যাত বিজ্ঞানী যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনটি আবদুস সালাম উদ্বোধন করেন এবং তাঁর ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেন, আমার দেখে খুশী লাগছে পৃথিবীর একজন বিখ্যাত গণিতবিদ স্যার রজার পেনরোজ এখানে উপস্থিত আছেন। পরে একবার ঢাকায় ও এসেছিলেন। ঢাকায় উল্লেখ করেছিলেন রায়চৌধূরী সমীকরণের কথা যেটি ১৯৫৫ আবিষ্কৃত এবং হকিং-পেনরোজের কাজের কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল এ সমীকরণ। এটি ব্যবহার করেই পরবর্তীকালে পেনরোজ ও হকিং তাঁদের বিখ্যাত ‘সিংগুলারিটি তত্ত্ব’ প্রণয়ন করেন। শুনেছি অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামকে প্রফেসর ইমেরিটাস করার জন্য রজার পেনরোজ জোর সুপারিশ করেছিলেন। পরিশেষে প্রত্যাশা গণিতের প্রয়োগে উন্মোচিত হোক মহাবিশ্বের সকল জটিল রহস্য। গণিতজ্ঞ স্যার রজার পেনরোজের জন্য শুভ কামনা।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।