বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিশ্ব ইতিহাসে গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। একাত্তুরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্মত্যাগ, প্রাণ বিসর্জন, মা–বোনের সম্ভ্রম হারানোর মর্মন্তুদ বেদনায় ভরপুর। দীর্ঘ নয়মাস বাঙালি স্বদেশে, রণাঙ্গনে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বহুজনের বিবিধ বিসর্জন শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পাতাকা ওড়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
পেছনে ফিরে দেখা যাক। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের সৃষ্টি মুসলিম মানসে আশার সঞ্চার করলেও পরবর্তীতে দুই অঞ্চলের বৈষম্য ও শোষণ বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের দমনপীড়ন, বঞ্চনা, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাংলাভাষার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এক নতুন মাইলফলক। ধারাবাহিক সংগ্রামে যুক্ত বাঙালি দীপ্ত পথভারে মুখরিত হয়।
১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসনে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ১০টি আসন লাভ করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রী সভা গঠিত হয়। পাকিস্তান সরকার ৫৬ দিন মন্ত্রী সভার কার্যক্রম সচল রাখে। ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত আওয়ামী লীগ ১৯৫৬–৫৮ পর্যন্ত রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন চালু করে। এ সময় রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে বিশেষ বিধান বলবৎ করা হয়। ব্যাপক গ্রেফতার চলে। বাঙালি প্রতিরোধে ফুঁসে ওঠে। ১৯৬২–৬৪ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন মূল ধারার রাজনীতিতে গতিবেগ সঞ্চার করে। পাকিস্তানী শাসকবর্গের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে ছাত্ররা ‘শরীফ কমিশন রিপোর্ট’ প্রত্যাহারে আন্দোলন তীব্র করে তোলে। ১৯৬৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা উত্থাপন করা হয়। সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার পাশাপাশি ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার, দুই পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে আনা, ট্যাক্সধার্য ও বৈদেশিক মুদ্রার স্বতন্ত্র হিসাব নির্ধারণ ও প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠনের ক্ষমতা অর্জনসহ বিবিধ বিষয় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ছয় দফার মাধ্যমে স্বায়ত্ত শাসনের সংগ্রাম তীব্রতর হয়। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে বিচার শুরু হয়। ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা নিজেদের নির্দোষ দাবী করেন। এসময় আন্দোলন চলাকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা, ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামন ও মতিউর রহমানকে পাকিস্তানী সামরিক সরকারের ঘাতকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। সারাদেশ আন্দোলন সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। সরকার বাধ্য হয়ে অবশেষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহর করে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ছাত্র সমাজ পাকিস্তান সরকার বিরোধী আন্দোলনের এক নতুন মাইল ফলক সূচনা করে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে ১১ দফা ঘোষিত হয়।। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসনে বিজয়ী হয়। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে বসতে না পারায় জনরোষ বৃদ্ধি পায়। পাঁচদিন হরতাল পালিত হয়।
সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনীর সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় গুরুত্ব পায়। জনগণ স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ ও বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেয়। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। ইতোমধ্যে বেলুচিস্তানের জেনারেল টিক্কা খানকে পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়। একদিকে আলোচনার নামে প্রহসন চলে, অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। বিদেশি গণমাধ্যমে যাতে গণহত্যা সম্পর্কে কোনো সংবাদ প্রচার না পায় সেজন্য বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের উপর অতর্কিত হামলা করা হয়। বিভিন্ন স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়া হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকায় গণহত্যা পরিচালনা করে।
চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। প্রতিরোধ গড়ে ওঠে সর্বত্র। সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করে। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিসেনারা প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে। মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলায় ১৭ এপ্রিল সরকার শপথ গ্রহণ করে।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। রায়ের বাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের গলিত লাশের স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্বজনেরা ভিড় করেছে। অনেক প্রিয়মুখ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বহির্বিশ্বে জনমত গঠনে অস্থায়ী সরকার নিরন্তর কাজ করে। দীর্ঘ নয়মাস মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়া যোদ্ধা ও বীরের আত্মত্যাগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ’ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান অধিকার করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানী সৈন্যরা পরাজিত হয়।
সামরিক–বেসামিরক যোদ্ধা মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্যে খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। অধিকাংশ সাধারণ জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে ও সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা আলোচনার পাদপ্রদীপে আসেনি। সিংহভাগ মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত ‘স্বাধীনতা’ অর্থবহ করে তুলতে হবে। উন্নয়ন হয়নি, প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। উন্নয়ন সামগ্রিক এক অবস্থা। উন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ স্থান পেয়েছে। জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের, আর্থ–সামাজিক কাঠামো মজবুত দৃঢ়করণে অধিক মনোযোগ প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক।