
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০–৬২/৬৩ শিক্ষাবর্ষে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিলাম তখন ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. আব্দুল করিমের তত্ত্বাবধানে গবেষণা কর্ম শুরু করেছিলেন – সেই সঙ্গে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে অধ্যাপনায় কর্মরত ছিলেন। তখন নামটা শুনেছিলাম মাত্র। পরিচয় গড়ে ওঠার সুযোগ পাইনি। হয়তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেই স্বগ্রামের কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন আমার একই কলেজে অধ্যাপনায় যোগদানের কয়েক বছর আগে।
আমি কানুনগোপাড়া কলেজ থেকে বি.এ পাস করি ১৯৬০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করার পর ঐ কলেজে বাংলা বিভাগের শূন্য পদে আমার স্বনামধন্য শিক্ষক অধ্যাপক অংশুমান হোর (সাহিত্য ভারতী)’র আন্তরিক আহবানে ১৯৬৫–র ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা থেকে এসে যোগদান করি। তখন থেকে ধীরে ধীরে সুনীতি কানুনগোর সঙ্গে আমার নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে। চালচলনে, বেশভূষায়, সহজ–সরল, অনাড়ম্বর নিরভিমান কিন্তু বিদ্যাচর্চায় নিবিষ্টমনা পণ্ডিত এই মানুষটির ভেতর মনের মিল খুঁজে পাই।
একসময় অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর (৭১’এ শহীদ) তাঁকে কলেজ লাইব্রেরির এলোমেলো গ্রন্থরাজি গুছিয়ে তালিকাভুক্ত করার দায়িত্বভার দেন। ওই সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য সহকর্মী হিসেবে আমাকে যুক্ত করে নেন।
তিনি অনর্থক সময় ব্যয় করতেন না। প্রয়োজনের বেশি এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে কলেজের কর্তব্যকর্ম শেষে সোজা বাড়ির পথে রওনা দিতেন। গল্পগুজব, আড্ডায় অনর্থক সময় ব্যয়ে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। কলেজের সাহিত্য – সংস্কৃতি – ক্রীড়া, নাট্যানুষ্ঠান ইত্যাদিতে যোগ দিয়ে সময় ব্যয় করার আগ্রহ তাঁর ছিল না বললেই চলে। কারণ একটাই। একদিন তিনি নিজেই আমাকে সাথে নিয়ে তাঁর বাড়িতে যান। স্বচক্ষে দেখি তাঁর আসল জায়গা। লক্ষ্য করি তাঁর বাড়ির এক পাশের নিভৃত এক কোণে বসে স্তূপীকৃত কাগজপত্র দেখে দেখে এক মনে টাইপ করে যাচ্ছিলেন এক টাইপিস্ট ।
মুসলিম শাসনামলে চট্টগ্রাম – Muslim Rule in Chittagong – বিষয়ে গবেষণা গ্রন্থটির চূড়ান্ত কপি তৈরি করছিলেন তিনি। চারদিকে কাগজপত্র বই ছড়ানো।
চট্টগ্রামের বিবিধ বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল নিবিড়। আমার কাছ থেকে বড়ুয়া–বৌদ্ধ সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে চাইতেন। কিন্তু আমার তথ্যভাণ্ডার তেমন সমৃদ্ধ ছিল না বলে সঠিক উত্তর দিতে পারতাম না।
তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল কর্ণফুলী নদীর ভাণ্ডারজুড়ি ঘাটের উত্তর পাড়ে আমার জন্মস্থান বেতাগী গ্রামের মাইল দেড় মাইল উত্তরে অবস্থিত পূর্ব–পশ্চিম উত্তরের প্রসারিত পাহাড় শ্রেণির প্রতি। তাঁর আগ্রহেই একদিন তাঁকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাই। প্রবেশপথ ও বাড়ির সম্মুখভাগ দেখেই তিনি মন্তব্য করেছিলেন বৌদ্ধদের ঘরদোর চারপাশ পরিস্কার – পরিচ্ছন্ন রাখাই তাদের ঐতিহ্য।
ওই পাহাড় শ্রেণির দক্ষিণ প্রান্তের মাঝামাঝিতে একটি উঁচু পাহাড়ের উপরে তাকে নিয়ে যাই। এ পাহাড়টির খ্যাতি ছিল বেতাগী বৌদ্ধ বনাশ্রম নামে। ওখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির এখনও আছে। মন্দিরের ভিতরে সুউচ্চ সুডৌল একটি বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধমূর্তির বেদীর সামনের ভাগে রক্ষিত ছিল ছোট ছোট কয়েকটি পিতলের এবং সম্ভবত মাটি ও সিমেন্টের মিশ্রণে গড়া ক্ষুদ্রাকার আরো কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি। ওগুলো পাওয়া গেছিল উত্তরদিকস্থ ঘন জঙ্গলে ভরা পাহাড় থেকে এবং পশ্চিমে টিলার নিচে সংলগ্ন স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক আবুল হায়াত চৌধুরীর (এখন মৃত) নতুন বাড়ির জন্য উঠোন খোঁড়াখুঁড়ির সময় আবিষ্কৃত পাতকুয়া থেকে।
ডক্টর সুনীতিবাবু মন্তব্য করেছিলেন, ওগুলো সব মগ শাসনামলের। বনাশ্রম বিহারের পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ওখান থেকে একমুঠো মাটি নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন এর পাশ দিয়েই একসময় বঙ্গোপসাগর প্রবাহিত হতো। এখান থেকে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ দিকের দেয়াং পাহাড় শ্রেণির পাদদেশ পর্যন্ত খেয়া পারাপার ছিল। হয়তো এর অনেক নিদর্শন ছিল – কালক্রমে হারিয়ে গেছে।
উত্তর–পশ্চিম দিকে একটি প্রাচীন বটগাছ/ তেঁতুল গাছ ছিল। এর পরিচিতি ছিল এক কড়ি ঘাট হিসেবে। কারণ এক কড়ি দিয়ে এখান থেকে খেয়া পারাপার হতো বলে প্রসিদ্ধি আছে। আবুল হায়াত চৌধুরীর বাগানের দক্ষিণের পাশের নিচু জমিতে হাল চাষের সময় লাল ইট বেরিয়ে আসে। একটি ছোট বুদ্ধমূর্তিও পাওয়া যায়। সেটিও ঐ বনাশ্রম বিহারে রক্ষিত ছিল। পশ্চিম দিকে নাতি উচ্চ টিলাতে অনেক গুপ্তধন পাওয়া গেছিল বলে জনশ্রুতি আছে। এসব মগ আমলের বলে প্রসিদ্ধি রয়েছে।
বনাশ্রম বিহারের লাগোয়া পশ্চিম দিকের ঘন – নিবিড় চম্পাতলী পাহাড়ের ভিতর আরো কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন চাপা পড়ে আছে বলে তাঁর মনে হয়। অতঃপর তাঁর মন্তব্য ছিল চট্টগ্রামে মগ রাজত্বের ইতিহাসের কোনো নিদর্শন হয়তো ওখানে লুকিয়ে আছে।
শুধু চট্টগ্রাম নয় – বৃহত্তর বঙ্গদেশসহ বৃহত্তর ভারতবর্ষের এবং ইউরোপের ইতিহাসের বিস্তৃত ক্ষেত্রেও তাঁর বিচরণ ছিল। তাঁর রচিত বিবিধ গ্রন্থমালা এর উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে।
তাঁর বিয়ের বর যাত্রীদের মধ্যে কলেজ থেকে একমাত্র আমাকে তাঁর সাথী করে নিয়েছিলেন। সম্ভবত সতীশ চন্দ্র লেনে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে আনন্দ – কৌতুকে রাত্রি যাপন করেছিলাম। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভায়রা ভাই আশীষ চৌধুরীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল আমার। তাঁর স্ত্রীও ছিলেন আমার প্রিয় বৌদি। সুনীতি বাবুর বিদুষী স্ত্রী সংগীত শিল্পী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপিকা লিনা কানুনগো। উত্তর নালাপড়ায় তাঁদের বাসায় বেশ সমাদর পেতাম। তাঁর প্রৌঢ় সময়ে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় দক্ষিণ দিকের কোনও এক রোডস্থিত (দক্ষিণ নালাপাড়া ?) বাসায়ও ঘনঘন গেছি। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পরও বহুবার গেছি, শুধু দেখতে নয় – তাঁর থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সংগ্রহ করতে।
অকাতরে তিনি তথ্যের যোগান দিয়েছেন। এর উপর নির্ভর করে দৈনিক আজাদীতে কয়েকটি প্রবন্ধও লিখেছিলাম। এমনকি তার জীবনপ্রসঙ্গ নিয়েও দু–তিনটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে একটি নাম ছিল ‘আমার সতীর্থ সুহৃদ ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো’। আমি তখন তাঁকে সর্বভারতীয় ও ইউরোপীয় ইতিহাসের এক পারঙ্গম পণ্ডিত হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম। আমি চট্টগ্রাম বেতারে মাঝে মাঝে সাহিত্য আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য কিংবা বিবিধ বিষয়ে কথিকা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ পেতাম। একবার চন্দ্রনাথ তীর্থ নিয়ে কথিকা পাঠের আমন্ত্রণ পেলাম। এ বিষয়ে আমার তো তেমন ঐতিহাসিক তথ্যাদি জানা ছিল না। তাই তাঁর শরণাপন্ন হলাম। তখন প্রথম জানলাম চন্দ্রনাথ শুধু হিন্দু তীর্থভূমি নয়, ওটা বৌদ্ধদেরও তীর্থভূমি ছিল এবং বৌদ্ধ ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক বৌদ্ধ তীর্থভূমি। তাঁর প্রদত্ত লিখিত তথ্যাদির উপর নির্ভর করে সংক্ষিপ্ত সময়ে কথিকা পাঠ সম্ভব হয়েছিল। এক সময় (২০২২–২৩) আমাদের প্রাক্তন ছাত্র অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীসহ মিলিত উদ্যোগে সুনীতি ভূষণ কানুনগোর জীবন ও কীর্তি নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে একটি সম্মেলন করার প্রস্তুতির সূচনা করা হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসার জন্য আমার ঢাকায় মিরপুরে অবস্থানের কারণে এই উদ্যোগ সফল হয়নি। হয়তো বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ইতোমধ্যে বিস্তর তথ্যাদির ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে।
অনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নামক একটি সংগঠন তাঁকে চট্টল ইতিহাসবিদ হিসেবে শুধু নয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসবিদ হিসেবেও সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। নিয়মানুযায়ী তাঁকে সাম্মানিক অর্থ দেয়া হয়েছিল। সে অর্থ সংগঠনটির কল্যাণেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এমনই ছিল তাঁর ঔদার্য।
শেষ দুয়েক বছর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলাম। আমাদের শ্রী সুপ্রিয়া বড়ুয়া ও আমার নিজের চিকিৎসার জন্য ঢাকার মিরপুর ১৪ তে আমার ছেলের বাসায় ছিলাম। হঠাৎ একদিন মোবাইলে দেখলাম তাঁর মৃত্যুসংবাদ – যেন অকস্মাৎ বজ্রপাত। তখন গভীরভাবে শোকাহত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
এখন বেশি করে মনে পড়ছে তার সতীর্থ বন্ধুপ্রীতির কথা। কলেজ থেকে ২/৩ মাইলের মধ্যে হাঁটা পথে আমার শ্বশুরবাড়ি বৈদ্যপাড়া গ্রামে যাওয়ার সময়ে তিনি আমার সহযাত্রী হয়েছিলেন– আমাকে কোন বাহন নিতে দেননি– কথা বলতে বলতে হেঁটে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছিলেন। স্মৃতিমঞ্জুসার মধ্যে এই স্মৃতিটি উজ্জ্বল হয়ে আছে।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, একসময় তিনি আমাকে বলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা সন্তু লারমা রাত্রির অন্ধকারে তাঁর বাসায় এসে তাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস– বিশেষভাবে রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে লিখবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি সে অনুরোধ রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ বিশেষ গুরুদায়িত্বটি পালন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল কিনা জানি না। তবে মনে হয় তিনি প্রতিশ্রুতিটি পালন করেছিলেন। কথা হয়েছিল ইংরেজী ভাষাতেই লিখবেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ,
স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ।












