প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন হাই স্কুলে ভর্তি হলাম তখন থেকে বিভিন্ন পত্রিকার ছোটদের পাতাগুলোর প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়তে থাকে। তখন দৈনিক ইত্তেফাকের কচিঁকাচার মেলা, দৈনিক পূর্বদেশ (ঢাকা থেকে প্রকাশিত) এর চাঁদের হাট, দৈনিক পয়গামের নওনেহালের আসর, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসর এর নিয়মিত পাঠক ছিলাম আমি। সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে সমমনা কিছু সহপাঠী জুটে গেল ক্লাসে। ক্লাসের বিরতিতে এ নিয়ে আলোচনা হতো। লেখালেখির শুরুটা ছিল নান্দনিক। সহপাঠীদের মধ্যে শামসুল ইসলাম, কাজী রফিক, আনোয়ারুল আজিম (ময়ুখ চৌধুরী), মইনুল ইসলাম মাহমুদ, মোবিনুল হক, আ জ ম ওমর ও হারুন ওসমানী ছিল সৃজনশীল মনমানসিকতার মূর্ত প্রতীক। কেউ দুলাইন ছড়া লিখে বলতো বাকি দুলাইন তুই জুড়ে দে এভাবে শুরু হলো লেখালেখির যাত্রা। বন্ধু শামশুল ইসলাম ছিল সবার শীর্ষে, তার লেখা একটি কবিতার কথা এখনও মনে পড়ে, কবিতার নাম ছিল ‘জীবন‘ এ জীবন নয় শুধু খেলা ও স্বপন, কঠোর কর্তব্যমান মানব জীবন। বন্ধু শামশু আজ এ জগতের মায়া ছেড়ে পরপারে চলে গিয়েছে অনেক আগে। সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের আমাদের ব্যাচের সবাই ছিল খুবই মেধাবী একমাত্র আমি ছাড়া যাকে বলা হয় অঘাচণ্ডী বা অঘারাম। পরবর্তী জীবনে এদের অনেকে হয়েছেন দেশ ও সমাজের বরেণ্য ব্যাক্তি। ধীরে ধীরে লেখা লেখির হাত পাকাতে লাগলাম। চেতনার উপত্যাকায় প্রতিদিন কত শত শব্দের উত্থান ঘটে, তবে মিলাতে গিয়ে ঘামের ত্রাসে শরীর আদ্র হয়। দুরু দুরু বক্ষে সাহস সঞ্চয় করে ছোটদের পাতায় কচি হাতের লেখাগুলো পাঠাতে লাগলাম ডাকযোগে। অপেক্ষা করতাম সুবর্ণ বিজয় কখন হাতছানি দিবে। দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসর ছিল আমার প্রথম ও একমাত্র পছন্দের। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন দেখলাম ঢাকার পূর্বদেশ পত্রিকার চাঁদের হাটে আমার একটা ছড়া বের হলো, আমাকে আর পায় কে, ভাবখানা এমন যেন মহাবিশ্বের অর্ধেকটা জয় করে ফেলেছি। এর পর দৈনিক পয়গাম ও পূর্বদেশ এর চাঁদের হাটে আরও কিছু লেখা ছাপানো হয়। উৎসাহের জোয়ার আমার চেতনার উপকুলে আচড়ে পড়তে লাগলো। শুধু যে ছড়া লিখতাম তাইনা, ছোট গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গান ও নাটক লিখতে বেশ আনন্দ পেতাম। নিজের লেখা গানে নিজেই সুরারোপ করতাম। স্কুলের টিফিনের পয়সা জমিয়ে ডাক যোগে এখানে ওখানে লেখা পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। চেতনার আগুনে মশাল জ্বেলে নিত্য নতুন শব্দ ভাণ্ডারে অবগাহন করে ছড়া কবিতা লিখতে লিখতে সাদা খাতার পাতা ভরাট হয়ে যায়তো ক্লান্তি আমায় কাবু করতে পারেনি। আগামীদের আসরে আমার সভ্য নম্বর ছিল ৬৯১। নিবাস ছিল ঘাটফরহাদবেগ এলাকার ৭৫ কাজেম আলী লেইনে। এটা আমার জন্মস্থানও বটে। দৈনিক আজাদী অফিস ছিল রেড ক্রিসেন্ট মাতৃ সদন হাসপাতালের পাশে আন্দরকিল্লা এলাকায়। বাবার কড়া হুকুম ভোরে আজান দেয়ার পর ঘুম ছেড়ে সবাই ফজরের নামাজ পড়ে প্রাতঃভ্রমণে যেতে হবে, সে সুযোগটা আমার জন্য বেশ আনন্দদায়ক ছিল, দূর্বাঘাসে চিকচিকে শিশির ঝরা ভোরের সুনির্মল বায়ু সেবন সে এক অনুপম অনুভূতি। এ ছাড়া আজাদী অফিসের পাশে গিয়ে ঘুরে আসা যাবে। শুক্রবার হলে তো উৎসাহটা বেড়ে যায় দ্বিগুণ কারণ ঐ দিন আগামীদের আসর প্রকাশিত হবে। আমার লেখা ছাপা হোক আর না হোক তাতে কী, অন্যদের লেখা তো পড়তে পারবো। প্রাতঃভ্রমণ শেষে আজাদী অফিসের কলাপসিপল গেট ধরে তাকিয়ে দেখতাম পত্রিকা প্রিন্টের কৌশল। আন্দরকিল্লা আজাদী ভবনেই ছিল বড় বড় মেশিন যেখানে পত্রিকা ছাপা হতো। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্যারকে দেখতাম সবকিছু দেখভাল করছেন। কোন কোন দিন স্যার আমার হাতে একখানা পত্রিকা ধরিয়ে দিয়ে বলতো যা বাসায় গিয়ে পড়ে নিস। সেই থেকে খালেদ স্যার এর প্রতি আমার মনের শ্রদ্ধার প্রজাপতিটা শত রঙ্গে রঙ্গীন হয়ে ডানায় ডানায় রঙ্গ ছড়াতে লাগলো। আগামীদের আসরের পরিচালক ভাইয়ার প্রতি আমার এক ধরনের আকর্ষণ বেড়ে গেলো। কী ভাবে তার সাথে দেখা করা যায় সে সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। বন্ধুদের কেউ কেউ বললো উনি অলকে থাকতে চাইবেন, মনে হয় তোর দেখা করার সাধ কখনও পূরণ হবে না। আমি কিন্তু হতাশ হবার পাত্র নই, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ভাইয়াকে একটা চিঠি লিখবো আর অমনি তা লিখে আজাদী অফিসের ঠিকানায় পোস্ট করে দিলাম। ভাবনার জগতে এলোমেলো হাওয়ার ত্রাস চলছে, ভাইয়ার কাছ থেকে সাড়া পাই কি না পাই সে চিন্তায় প্রহর যেন কাটতেই চায়না। ডাক পিয়নের আগমন এর ক্ষণটুকু অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতে কখনো বিরক্ত বোধ করতাম না। অবশেষে সপ্তাহ খানেক পর সেই মহেন্দ্রক্ষণ এলো, ভাইয়ার সাথে দেখা করার সুবর্ণ সুযোগ এসে গেলো। প্রতি বৃহস্পতিবার ভাইয়া বিকেল ৪টা থেকে অফিস করেন, কারণ পরদিন শুক্রবার আগামীদের আসর প্রকাশিত হবে তাই সম্পাদনা করার কাজ নিয়ে উনি খুব ব্যস্ত থাকেন। আমি আগেই জেনেছিলাম ভাইয়ার নাম আবুল কাশেম সন্দীপ। তখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এক বৃহস্পতিবার ভাইয়ার সাথে দেখা করার অভিপ্রায়ে হাজির হলাম আজাদী অফিসে। পরিচয় দিলে ভাইয়া আমাকে সাদরে কাছে টেনে নিলেন। সেদিনের সেই সোনাঝরা বিকেলের মুহূর্তটা স্মৃতির সিন্দুকে সযত্নে লালন করে চলেছি আজও। ভাইয়া মানে কাশেম ভাইকে প্রথম দেখায় আমার শ্রদ্ধার পুষ্পাঞ্জলি আমার অজান্তেই তার পদপারে লুঠে পড়লো। তার সম্ভাষণে মুগ্ধতায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি।
এক ঝাঁক পাখির মত কিছু রোদ্দুর আমার মনের আকাশটাকে রাঙিয়ে দিল। কেমন আছো বাবুল? জ্বী ভাইয়া, ভালো আছি। সস্নেহে আদরে ঢেকে নিয়ে বসতে বললেন। হালকা পাতলা শরীরের অধিকারী ভাইয়ার যে গুনটা আমায় মোহিত করেছিল তা হলো তিনি সবসময় হাসি মুখে থাকতেন। এরই মধ্যে চা বিস্কিট চলে এলো। কাশেম ভাই মানে ভাইয়া কয়েকটা ছড়া আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন এগুলো থেকে আগামীকালের আসরের জন্য তোমার ইচ্ছেমতো কয়েকটা ছড়া বাছাই করে দাও। হতবাক বিস্ময়ে আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম, ভাইয়া বলেন কী, আরে আমিতো নিজের লেখাই ঠিক মতো লিখতে পারি না, ভাইয়াকে মুখ ফুটে যে সে কথা বলবো সে সাহসও আমার ছিল না, অগত্যা লেখাগুলো উল্টে পাল্টে দু তিনটি তার সামনে দিলাম। পরদিন আসরে আমার বাছাই করা একটা লেখা প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে আজাদী অফিসে আমার আসা যাওয়া বেড়ে গেল, অধ্যাপক খালেদ স্যারের অকৃত্রিম আদর ভালোবাসা আর স্নেহের ছোঁয়ায় আমার জীবনটাই ধন্য হয়ে গেলো। স্কুল ছুটির পর বাসায় ফেরার পথে আজাদী অফিস ঘুরে যাওয়া ছিল নিয়মিত কাজের একটা অংশ। আশা যাওয়ার সুবাদে একসময় বেলাল মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। বেলাল ভাই আমার শ্রদ্ধার আসনের আর এক মধ্যমণি। ভাইয়া ও বেলাল ভাই আমাকে বাবুল নামে সম্বোধন করতো। আমার জীবনে আগামীদের আসর এত বেশি প্রভাব ছিল যে সেই স্মরণীয় দিনগুলো আজও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। কাশেম ভাই ও বেলাল ভাই আজ নেই তবে তাঁরা আজীবন আমার স্মৃতির কাননে সুবাস বিলিয়ে যাবেন।
১৯৬৬ সনে রহমতগঞ্জ এলাকায় সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললাম নবীন মেলা নামে একটি সংগঠন যা ৫৯ বছর ধরে এখনো নানা কর্মসূচী নিয়ে সগৌরবে এগিয়ে চলেছে। এ সংগঠনের প্রতিও কাশেম ভাই ও বেলাল ভাই এর অকুণ্ঠ সমর্থন আমার উৎসাহের জোয়ারে সহস্র ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগলো। ১৯৬৮ সনে আমাদের গ্রাম রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা গ্রামে কাকলী নামে আগামীদের আসর এর একটি শাখা চালু করা হয়। বেলাল ভাই ও কাশেম ভাই উপস্থিত থেকে এ শাখাটি উদ্বোধন করেন। তারিখটা সঠিক মনে পড়ছে না। গ্রামের শিশু কিশোর তরুণ সমাজ খুবই উৎসাহ নিয়ে এ সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। বেলাল ভাইয়ের আত্মজীবনী বইয়ে আমার সম্পর্কে এবং কাকলী সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়েছেন। দৈনিক আজাদী অফিসের তিন তলার খোলা একটা জায়গায় মাঝে মাঝে লেখা লেখির বিষয় নিয়ে আড্ডা চলতো। ওই আড্ডায় বেলাল ভাই থাকতেন মধ্যমণি, এছাড়া আরও কয়েকজন ছড়াকার ও সাহিত্যমোদী স্বজ্জনরা থাকতেন। ভাইয়াও থাকতেন মাঝে মাঝে। বেলাল ভাইয়ের রসাত্মক আলাপচারিতা ছিল সবার খুবই পছন্দ। এছাড়া গোলাম মোস্তফা যাকে সবাই পাখী ভাই বলে ডাকতেন তিনিও ছিলেন প্রাণবন্ত এক মানুষ যিনি কথার যাদুতে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। ’৬৯ এর গণ আন্দোলন শুরু হবার পর আমাদের যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে, তবে টেলিফোনে যতদূর সম্ভব কথা হতো, এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দূরত্ব বেড়ে যায়। বেলাল ভাই ও কাশেম ভাই শব্দ সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার কিছু দিন পর কাশেম ভাই ঢাকা চলে যান তবে বেলাল ভাইয়ের সাথে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার যোগাযোগ অক্ষুণ্ন ছিল। দৈনিক আজাদী ও আগামীদের আসর ঘিরে আমাদের সম্পর্কের যে সেতু বন্ধন রচিত হয়েছিল তার জন্য দৈনিক আজাদীর প্রতি জীবনের সূর্য ঢোবার পূর্ব পর্যন্ত কৃতজ্ঞতার শিখা অনির্বাণ থাকবে। দৈনিক আজাদী ‘র ৬৬ বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে সবাইকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
লেখক: সভাপতি, নবীন মেলা।