ইতিহাসের প্রয়োজনে পুরানোদিনের দালান–কোঠা রক্ষা করা হয়। এখানে প্রাচীনকালের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। এসব দালান যদি কথা বলতে পারত। অনেক কিছু প্রকাশ করে দিত। জানতাম অতীতের নানান কাহিনী। মানুষের এ ইচ্ছে পূরণ করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
কৈশোরে স্লোগান দিতে দিতে একদিন হাজির হয়েছিলাম হলুদ রঙের একটি দালানটির সামনে। এর নাম মুসলিম ইনস্টিটিউট। এককালে চট্টগ্রামের প্রধানতম মিলনায়তন ছিল এটি। ১৯২৫ সালে চট্টগ্রামের বনেদি ব্যবসায়ী হাতি কোম্পানি এবং আরও কয়েকজন মিলে মুসলিম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। হাতি কোম্পানির নাম আবদুল গণি সওদাগর। তাঁরা এটি করেছিলেন বর্তমান জেনারেল হাসপাতালের উত্তর দিকে। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এ জায়গায় হাসপাতালের উদ্যোগ নেন। ফলে ১৯৫৩ সালে মুসলিম হল বর্তমানস্থানে স্থানান্তর হয়। ৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন হয়। সাহিত্যিক আবুল ফজল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এখানে দেশ–বিদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষ এসেছেন। খেলাঘর জেলা সম্মেলনে প্রথম দেখা মুসলিম হল এই স্বপ্নালু কিশোরকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নেয়।তারপর রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, সম্মেলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উৎসব, প্রতিবাদী কবিতা উৎসব, ছড়া উৎসবে কখনও নেপথ্যে, কখনও প্রকাশ্যে মঞ্চে উঠে মুসলিম হলের সঙ্গে একাত্ম হয়েছি। অনেকের স্মরণ সভায় মিলিত হয়েছি। বাচিকশিল্পী পার্থ ঘোষ–গৌরি ঘোষকে এখানে সম্মাননা জানিয়েছি বোধন আবৃত্তি পরিষদের ব্যানারে। তাঁদের কন্ঠে পূর্ণেদ্রু পত্রীর কথপোকথন শুনে শিহরিত হই। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ চট্টগ্রাম আয়োজিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পাপিয়া সারওয়ার, মিতা হক–এর পরিবেশনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সন্ধ্যা করোটিতে জেগে আছে। তারিখটা ছিল ১৯৯৫ সালের ২১ এপ্রিল। তখন দেখেছি, আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামের মানুষ টিকেট কেটে লাইন ধরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছে। এর আগে ১৯৮৫ সালে পঞ্চম জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয় এখানে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল আমার অটোগ্রাফ খাতায় তখন লিখেছিলেন-‘সংগ্রামে কর না যেন ভয়/হবে হবে হবে তোমাদের জয়।’ এখনও সে লেখা পরম যত্নে বুকের কাছে আগলে রেখেছি সুগন্ধি মোড়কের মতো। আবদুল গাফফার চৌধুরী, তোফায়েল আহমদের বক্তৃতা শুনেছি মন্ত্র মুগ্ধের মতো। আবেগে চোখ ভিজিয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা শুনে এখানে শিহরিত হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের কথাও শুনেছি। উপমহাদেশের নাট্যজন হাবীব তানভীরের বিখ্যাত নাটক ‘চরণ দাস চোর’, ‘আগ্রা বাজার’ নাটক এখানেই দেখেছি। নাটকদুটোর অসাধারণ শিল্পশৈলী ভুলবার নয়। ঋতুভিত্তিক নাট্যমেলা এখানেই হতো। মুসলিম হলে প্রায় ১২০০ দর্শক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে। এর পশ্চিম পাশের একটি ভবন সংস্কার করে নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার স্থাপন করেছিলেন স্টুডিও থিয়েটার। এখানেই নজরুলকে সংবর্ধনা দিয়েছে চ্টগ্রামবাসী।
রহমতগঞ্জে অবস্থিত জে.এম. সেন হল চট্টগ্রামের প্রথম টাউন হল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট, কলকাতার মেয়র ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত জে.এম. সেন হল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অর্থায়নে এবং তাঁর প্রদত্ত জমিতে এই হল প্রতিষ্ঠিত হয়। এ হলের জন্য মোক্তার লাইব্রেরি এককালীন পাঁচ হাজার টাকা এবং রামুর মহাত্মা খিজরী অনেক টাকা চাঁদা প্রদান করেছিলেন। হলের নামকরণ করা হয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের পিতা ভারতবর্ষের গুণী আইনজীবী যাত্রা মোহন সেনগুপ্তের নামে। ১৯১৬ সালের ১৬ নভেম্বর শরৎচন্দ্র দাস রায় বাহাদুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিন বছর কয়েক মাস পর ১৯২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নবীনচন্দ্র দত্ত রায়বাহাদুর উদ্বোধন করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মিলনায়তনটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উল্লেখযোগ্য হল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। স্বাধীনতাত্তোরকালে এসে জে.এম. সেন হল জৌলুস হারায়। আমাদের কালে লাল ইটের এই দালানটিতে ছোটখাটো রাজনৈতিক সভা, পূজা, বিয়ে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হতো। বড় কোনো আয়োজন দেখিনি। তারপরও জে.এম.সেন হল আজও অতীতদিনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে চৌধুরী শ্রী পূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি আন্দরকিল্লায় ননগেজেট অফিসার ক্লাব, আন্দরকিল্লা ভিক্টোরিয়া মুসলিম হলের কথা উল্লেখ করেছেন।
চট্টগ্রামের আরেকটি উল্লেখযোগ্য হল ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট। আসাম–বেঙ্গল কর্তৃপক্ষ ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। রেলওয়ের ইংরেজ কর্মচারীদের বিনোদনের জন্য বর্তমানের বি.আর.টি.সি বাস টার্মিনালের উত্তর–পূর্ব পাশে এ হলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে এর নাম ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট ছিল না। ১৯৪৮ সালে মিলনায়তনটি সংস্কারের পর পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজিউল্লাহ’র নামানুসারে ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট হয়। এটিকে ঘিরে একদা সুস্থ, গণমুখী সাংস্কৃতিক জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল। তখন এর ধারণ ক্ষমতা ছিল দু’শ থেকে আড়াইশ। পরবর্তীকালে ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট যখন পলোগ্রাউন্ড মাঠের পাশে বর্তমান ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয়। তারপর থেকে এর পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। আমাদের সময়ে এ মিলনায়তনটি হাউজি খেলার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বন্দর এলাকায় ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বন্দর রিপাবলিক হল।
চট্টগ্রামের ব্যস্ত এবং ছোট্ট মিলনায়তনটির নাম ছিল বুড্ডিস্ট ফাউন্ডেশন। ডিসি হিলের উল্টো দিকে দোতালায়। পঞ্চাশ জনের বেশি মানুষের ধারণ ক্ষমতা ছিল না। এখানে বেশি হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বোধনের উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে আবৃত্তি অনুষ্ঠান হয়। ছোট–ছোট রাজনৈতিকদলগুলো কর্মী সভা করত। একতা পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চট্টগ্রামে এসেছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগ কর্তৃক বরণ অনুষ্ঠানে। আবদুল হালিম দোভাষের কারণে আমিও সে সভার একজন সাক্ষী হয়ে থাকলাম। আরেকটা ছোট্ট মিলনায়তন হলো ‘আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য চট্টগ্রাম’। এটি ১৯৬৫ সালে চকবাজার এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে মূলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। একসময় এখানে প্রতিমাসে একটা করে অনুষ্ঠান করার জন্য বোধন চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। এখানে বিনাভাড়ায় অনুষ্ঠান করতাম। সৈয়দ শামসুল হক, সুকুমার বড়ুয়াকে নিয়ে আবৃত্তি অনুষ্ঠান করেছি বোধনের পক্ষ থেকে। ্এরই ধারাবাহিকতায় নাজমা নিগার আর প্রয়াত রণজিৎ রক্ষিত–এর প্রথম দ্বৈত আবৃত্তি অনুষ্ঠান-‘আলোর নিচে অপূর্ব সেই আলো’ হয়েছে। অনুষ্ঠানের নামখানা ছিল আমারই দেওয়া। জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়‘ কবিতার একটি চরণ।
চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিলনায়তন আছে। মিউনিসিপ্যাল স্কুল মিলনায়তনে ১৯৯৩ সালের ৮ অক্টোবর বোধন আবৃত্তি স্কুলের অবিস্মরণীয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি হয়েছে। সেন্টপ্লাসিড স্কুলের মিলনায়তনে শুনেছি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। এখানে একদা নিয়মিত নাটক হতো। থিয়েটার৭৩সহ অনেক নাট্যদল নিয়মিত নাটক করত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মিলনায়তনে তৎকালীন সময়ে আধুনিক ছিল। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ এখানে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র উৎসব করেছিল। শিশুদের সমন্বিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফুলকীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উৎসব হতো। তখন ফুলকীতে সর্বসাধারণের অনুষ্ঠানের সুযোগ ছিল না।
এলিটদের জন্য আজ থেকে একশ ছেচল্লিশ বছর আগে ১৮৭৬ সালে চা বাগানের মালিক ডব্লিউ.এ. ক্যাম্পবেল সাহেবের উদ্যোগে ‘চট্টগ্রাম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম ক্লাব প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় পুরাতন টেলিগ্রাফ অফিসের পাশে। ১৯০৩ সালে জমিদার রায় নিত্যানন্দ রায়ের দেওয়া জমিতে চট্টগ্রাম ক্লাব পাইওনিয়ার হিলে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬১ সালে ৯৯ বছরের জন্য সরকার ‘চট্টগ্রাম ক্লাব’–এর জন্য ১২ একর জমি লিজ দেয়। এখানে একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। চলচ্চিত্র সংসদের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে উদ্বোধকের জন্য বসে আছি। পরে জানা গেল উদ্বোধক প্যান্ট–শার্ট পরে আসেননি। তাই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের পরিচালক শৈবাল চৌধুরী চেষ্টা তদবির করে তাঁকে আনেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন কবিয়াল ফণী বড়ুয়া। তিনি পাঞ্জাবি সাদা লুঙ্গি পরতেন।
চেরাগীর পাহাড় মোড়ে ছিল আমেরিকান সেন্টার। এখানকার ছোট্ট অডিটরিয়ামটিতে চট্টগ্রামের গ্রুপথিয়েটার চর্চার সূত্রপাত ঘটে। শিল্পকলা একাডেমীতে একটি কলাভবনটি আছে। ওটা উদ্বোধন করেন ১৯৭৩ সালে বিখ্যাত ফরাসি লেখক আন্দ্রে মারলো। তবে চট্টগ্রামের প্রাচীনতম (১৩২ বছরেরও বেশি) ৭তলা ভবনটির নাম পি.সি.সেন ভবন সদরঘাটে অবস্থিত। এটা ছিল পারিবারিক বাসস্থান।
তথ্য সহায়িকা : ১. হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা, ২. উইকিপিডিয়া। ৩. ইন্টারনেট। ৪. রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ চট্টগ্রাম আয়োজিত রবীন্দ্রসঙ্গীত সন্ধ্যা উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যজন