১৯৫৪ সাল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচন। প্রফেসর আসহাব উদ্দীন আহমদ সাহেব যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে এমপিএ নির্বাচিত হন। তিনি বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে একদিন স্কুলে উপস্থিত। তখন আমিও উক্ত স্কুলের ছাত্র। স্কুলে তাঁর বক্তৃতা শুনে আমি মোহিত হলাম।
তিনি তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বাবু বিনোদ বিহারী আইচকে অনুরোধ করলেন যেন আমরা স্কুলের ছাত্ররা চাঁদপুর (বাঁশখালী শংখ নদীর পাড়ে) ডাক বাংলোতে ঢাকা থেকে আগত যুক্তফ্রন্ট নেতা মাওলানা ভাসানী ও জনাব শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে সেখানে যাই। আমরা পরদিন স্কুলের ছাত্ররা মিছিল করে উক্ত ডাক বাংলোতে উপস্থিত হয়েছিলাম এবং মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনেছিলাম।
এরপর দীর্ঘদিন উনার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। তিনি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত আর আমি ছাত্রজীবন ও career নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। প্রফেসর আসহাব উদ্দিন সাহেব চীনপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন এবং তা নিষিদ্ধ ছিলো। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক আমুল পরিবর্তন হলো। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁনের সাথে চীনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এর বন্ধুত্ব হলে চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ মুক্ত হয় এবং প্রফেসর সাহেবেরা ও আত্মগোপন থেকে বের হয়ে বেশ কয়েক বছর মুক্ত জীবন যাপন করেছিলেন। চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে The East is Red শিরোনামে একটি অনুষ্ঠিানও অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। কিছুকাল এভাবে চলার পর পাকিস্তান রাজনীতিতে আবার পরিবর্তন এলো। আয়ুব খাঁন পদত্যাগ করে ইয়াহিয়া খাঁনের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁকে আবার আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। ১৯৬৪ সালে তিনি আত্মগোপনে থাকার সময় হঠাৎ একদিন আমার সাথে সাক্ষাৎ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার এক বন্ধু আমাকে একটা বই উপহার দিয়েছিল। বইটা ছিল এক Russian উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ ‘মা’। বইটি নিয়ে আমি গ্রামের বাড়িতে (দ. বুরুমচরা) গিয়েছিলাম। আমাদের পাশের বাড়িতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। কেমন করে তিনি ঐ ‘মা’ বইটির কথা জেনে যান এবং আমাকে গোপনে উনার সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। আমিও যথারীতি বেশ কিছুদিন উনার সাথে সাক্ষাৎ করি এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ আলোচনা করি। তখন হতে আমি বেশ কয়েক বছর উনার রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকি। ইতিমধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কে তিনি আমার বেয়াই হয়ে যান, ফলে ঘনিষ্ঠতা আরও একটু বেড়ে যায়। আমি যেখানেই যাই, উনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবার আত্মগোপনে চলে যান। এ সময় অনেক বামপন্থী বিপ্লবী আত্মগোপনে থেকে রাজনীতি করেন। অতি গোপনে তিনি আমার চট্টগ্রামস্থ খলিফা পট্টির বাসায় যাতায়াত করতেন এবং উনার লেখা বিভিন্ন বই আমার নিকট পৌঁছাতেন। পরবর্তীতে বদলী জনিত কারণে আমি পাঁচ বৎসর সিলেট থাকা অবস্থায় উনার সাথে যোগাযোগ ছিল না। আবার যখন আমি ঢাকা সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে বদলী হয়ে আসি তখন তিনি তাঁর লেখা বিভিন্ন বই নিয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অফিস ছুটির পর উনার ভাই ডাক্তার আহমদ আলী চৌধুরী সাহেবের ধানমণ্ডিস্থ বাসায় উনার সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। কথা মতে আমি বিকালে অফিস ছুটির পর উনার সাথে সাক্ষাৎ করি। অনেকক্ষণ আমাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়। সেখানে প্রফেসর ড. আহমদ শরীফের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়। কথায় কথায় তিনি বলেন বয়সতো ‘আশি’ হলো। এবার তবে ‘আসি’। আমি খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম, সত্যি সত্যিই তিনি এরপর আর বেশিদিন বাঁচেননি। বিগত ২৮/০৫/১৯৯৪ ইংরেজী তারিখে আশি বছর বয়সে তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করে পরলোকে চলে যান। আমার জানামতে ১৯১৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন। অতপর চট্টগ্রাম কলেজ হতে প্রথম বিভাগে আই.এ পাস করেন, একই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি.এ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি বিষয়ে এম.এ পাশ করেন।
এরপর চট্টগ্রাম কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (মহসিন কলেজ), ফেনী কলেজ, লাকসাম নবাব ফয়েজুন্নেসা কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেনে। কুমিল্লা থাকাকালীন উনার এক বন্ধুর সহচার্যে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত হন। তিনি আজীবন সংগ্রামী এবং সাধারণ জীবন যাপন করেন। তিনি কোনদিন নীতিবিচ্যুত হননি এবং সারাজীবন মানুষের খেদমতে জীবন কাটিয়ে দেন। নিজের স্বার্থ বলতে কিছু ছিল না। এই রকম পকেট খালি রাজনীতি আর কেউ করেছে কিনা আমার জানা নেই। যেখানে মানুষের সমস্যা ও দেশের সমস্যা সেখানেই প্রফেসর সাহেব ছিলেন। বাংলাদেশে এমন কোন রাজনীতিবিদ নাই যার পিছনে স্বার্থের কোনো কিছু নাই। একমাত্র ব্যতিক্রম আমাদের এই প্রফেসর সাহেব। এমনকি উনার একই ধারার রাজনীতি করে অনেকে বাড়ি–গাড়ির মালিক হয়েছেন কিন্তু তিনি সারা জীবন দেশের ও দশের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
লেখক: সাবেক ডি.জি.এম, সোনালী ব্যাংক পিএলসি।