বিদায়ের সুর বাজাচ্ছে ২০২০ সাল। রেখে যাচ্ছে কালের সাক্ষী হয়ে থাকা করোনার ক্ষতচিহ্ন, যা অন্তত আগামী একশো বছর নির্মম স্মৃতিচারণে হাতড়ে বেড়ানো যাবে। করোনাভীতিতে নিস্তেজ হওয়া জীবনের চালিকাশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বছরে মাঝে মধ্যে আমরা কয়েক বন্ধু-সুজন বিভিন্ন আনন্দ আয়োজনের মাধ্যমে মেতেছি প্রাণের খেলায়।
এরপর চলে এলো বিজয়ের মাস।আমরা বাঙালিরা খুবই গৌরব ভরে জাঁকজমকপূর্ণ ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে আমাদের বিজয় দিবসকে উদযাপন করি। কিন্তু করোনার ভয়াল থাবা এবার আমাদের বঞ্চিত করেছে সার্বিকভাবে বাংলার বীর শহীদদের জয়গান করতে। অস্থির,ব্যাকুল মন কেমন যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠলো,”আজ বাংলার ইতিহাস দেবোনা হতে ম্রিয়মান।”
অবশেষে মনকে প্রবোধ করতে আমার সুহৃদ, শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুজনেরা এক ব্যতিক্রমী বিজয় দিবস উদযাপনের আয়োজন করলো। আমাদের জয়গান এবার স্থলে নয়, জলে হবে। সাথে শীতকালীন পিঠা উৎসব। ফিরিঙ্গিবাজারের অভয়মিত্র নৌ-ঘাটে আমরা পঁচিশ জন মিলিত হলাম কর্ণফুলীর বুকে বিজয়ের পতাকা উড়াবো বলে। আমাদের পুরো নৌকাটিকে লাল-সবুজের পতাকায় সুশোভিত করা হলো। নৌকাটি দেখে বুকটা কেমন গর্বে ভরে গেল! সামান্য একটা নৌকাও যে অনেক নৌকার ভীড়ে অসামান্য হতে পারে, তার মহান গুরুত্ব বুঝিয়েছে এই লাল-সবুজের পতাকা। স্যালুট আমার বাংলাদেশ!
সবাই নৌকায় উঠে বসলে আমাদের নৌকা বাতাসে পতপত করে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে চললো কর্ণফুলীর বুকে। অতিক্রম করলো কর্ণফুলী ব্রীজের নিচের সীমানা। আমাদের সফরসঙ্গীরা ছিলেন ডাঃ এমরান, ডাঃ শাকিল ও পরিবার, অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার জনাব আশরাফ ও পরিবার, আমাদের এক খালাম্মা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা পরিদর্শক, মোস্তাফিজ ভাই ও পরিবার এবং আরও ছোট ভাই ও বোনেরা-যারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব পেশায় প্রতিষ্ঠিত।
নৌকার খোলা আকাশেই সবাই খুব আয়েশি ভঙ্গিমায় বসলো। (কয়েকজন ছাউনির নিচে) শীতের শীতল বাতাসে রোদটা যেন কুসুম কুসুম উষ্ণতা দিচ্ছিলো।ফুরফুরে আমাজে আমরা সবাই। ব্লু-টুথ স্পীকারে বাজছিল দেশের গান,বিজয়ের গান। আমরাও সুর মেলাচ্ছিলাম। যেন সত্যিই সেই কাঁচা বয়সের রং ধরেছিল মধ্যবয়সী মনে। পিঠা উৎসবের আয়োজনে সবাই নিজ ঘর থেকে একটি করে আইটেম বানিয়ে এনেছিল। উদ্বোধন হলো দুধচিতই দিয়ে। দারুণ মজার সে পিঠা আমার রসনাবিলাস আরও বাড়িয়ে দিল, কারণ সকাল থেকে না খেয়ে ছিলাম বলে। দুইটা খেতে মন চাইলেও জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করলাম এর পর আরও অনেক পিঠা খেতে হবে ভেবে।সফরসঙ্গীদের মিলিত হাতে দারুণ গোছালোভাবে বিলি-বন্টন হতে দ্বিতীয়বারের মতো এলো ভাপাপিঠা ভোজনপর্ব। আহা, তাহাও অতীব সোয়াদের!
একটু পরপর পতাকাশোভিত নৌকাটি দেখছিলাম দিনটির মর্মার্থ হৃদয়োঙ্গম হতে। দিনটিকে ধরে রাখতে চলছিলো উচ্ছ্বসিত ফটোসেশান নিরবধি। আমরা পাড়ি দিলাম কর্ণফুলী ও হালদা নদীর মোহনা, কালুরঘাট ব্রীজের নিচ দিয়ে পাড়ি দিতে আরেকবার স্মরণে আসলো সেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যা কিনা কালুরঘাট বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণার সাথে জড়িত। কিছুটা আনমনে ছিলাম সেইসময়। নাম না জানা পাখিও সেদিন আমাদের সাথে কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে বিজয়োল্লাসে মেতেছিল।যাওয়ার পথে একটু দূর থেকে নদীর ধার ঘেঁষে কাশফুলের সারি আমাদের চোখগুলোকে পলকহীন করে দিল।ফেরার পথে মাঝি কাশফুলের কাছ ঘেঁষে আসার আশ্বাস দিলে আমাদের চোখের পলক পড়লো।
মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমরা বেছে নিলাম হালদা নদীর মদুনাঘাটকে। সেখানে আগেই অর্ডার করা একটি হোটেলে খেলাম এক চতুর্থাংশ মুরগি, নদীর রুই মাছের বড় চাকা(অত্যন্ত সুস্বাদু),সবজি,ডাল, মিষ্টি পাকা পেঁপে ও কোমল পানীয়।সেখানে বাজার ঘুরে অনেকেই সৌখিন কেনাকাটাও সাড়লো।আবারও শুরু হলো ফিরতি নৌভ্রমণ। এবার গতিপথ কিছুটা বদলিয়ে সেই কাশফুলের ধার ঘেঁষে নৌকা চললো। শুভ্র কাশফুল, পতাকাশোভিত নৌকা ও আমাদের জয়োল্লাস বাংলা মা’কে যেন সত্যিই বিজয়িনী বানালো সেই ক্ষণের তরে। সবুজের আচ্ছাদনে দ্বীপও চোখে পড়লো।
আমাদের পরের গন্তব্য ছিল কদুরখীল, বোয়ালখালীতে অবস্থিত রিভারভিউ ক্যাফে-৭১। সেখানে বাকি পিঠা পেটে পুরতে ও চা-পানের তরে আমরা অবতরণ করলাম। চমৎকার সুন্দর জায়গা এই রিভারভিউ, যা পর্যটকদের কয়েকঘন্টা নিমেষেই কেড়ে নিতে পারে। শেষ বিকেলের সোনালি সূর্য,নদীর চারপাশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আরেকবার আসার বাসনা তীব্রভাবে জাগ্রত হলো। চৌদ্দ/পনেরো রকমের পিঠা নিয়ে আমরা বসে গেলাম।আহা,বাঙালির রুচির তারিফ করতেই হয়!কে বলবে আমরা কিছু আগেই মধ্যাহ্নভোজন সেরেছি?বাকি পিঠা মাংসপুলি,নারকেল পুলি,পাটিসাপটা, পানতোয়া,মুগপাকন, ছাঁচিপিঠা,গাজরের বরফি,গুড়ের খোরমা আরও বাহারি সব আইটেম নিমিষেই হাতে হাতে বাটি খালি করছিলো। অসম্ভব ভাললাগার সাথে চা-কফি পান করে অতিক্রান্ত সময়শেষে আমরা আবারও নৌকায় উঠলাম ফিরতিপথের নিশানা ধরে।একে একে সবুজের সোনার বাংলা নদীর ধার দিয়ে আমাদের এই পঁচিশজন দামাল নির্ভীক সন্তানদের প্রশান্তি দিচ্ছিলো তার রূপের পসরা সাজিয়ে।কর্ণফুলী নদীর বুকে আমরা বিদায় জানালাম বিজয় দিবসের অস্তমিত সূর্যকে।মাগরিবের ওয়াক্তে আমরা অভয়মিত্র ঘাটে এসে পৌঁছালাম। বুকভরা তৃপ্তি, চোখভরা প্রশান্তি নিয়ে আমরা বিদায় নিলাম একে অপরের কাছ থেকে। সফরসঙ্গীদের আকুল বাসনা, আন্তরিক প্রচেষ্টায় সফলরূপে শেষ হলো আমাদের বিজয়-দিবস উদযাপন, স্মৃতির পতাকে সমৃদ্ধ করতে যার জুড়ি মেলা ভার।