সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। বিশিষ্ট পার্লামেন্টেরিয়ান ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তিনি রাখ ঢাক করতে জানতেন না, মুখের উপর সত্য বলে ফেলতেন। অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিতেন সরকারের দোষ–ত্রুটি, ভুল–ভ্রান্তি। সরকারের অন্যায়, অপকর্ম এবং জনবিরোধী কাজের তিনি ছিলেন অকুতোভয় এবং সোচ্চার প্রতিবাদকারী আর নিঃশঙ্ক সমালোচক। কাউকে তোয়াজ তোষামোদ করে কথা বলার লোক তিনি ছিলেন না।
তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। ব্যবসায় অর্জিত অর্থেই তাঁর জীবিকা এবং রাজনীতির ব্যয় নির্বাহ হত। আজ ২২ শে নভেম্বর মানব দরদী মহৎপ্রাণ এই মানুষটির নবম শাহাদাত বার্ষিকী। আজকের এই দিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে কাটানো আমার জীবনের চল্লিশ বছরের সুখ–দুঃখময় নানা ঘটনা আজ হৃদয় দর্পণে বার বার ভেসে উঠছে। এই চল্লিশ বছরের অনেক সোনালী দিনের সুখ ভরা স্মৃতি আমার অন্তরকে বারংবার আন্দোলিত করছে। ২০১৫ সালের ২২ শে নভেম্বরের বেদনা ভরা চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার সেই ভীতিকর আতংকের রাতের প্রতিটি ক্ষণ আর মুহূর্তের কথা আজ মনের আয়নায় বার বার ভেসে উঠছে আর আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ২২ শে নভেম্বরের সেই কালো রাতে। সেদিনের বেদনা বিধূর স্মৃতি হৃদয়দর্পণে ক্ষণে ক্ষণে ঝিলিক দিয়ে উঠে দু’নয়ন অশ্রু সিক্ত করে তুলছে।
১৯৭৮ সালের ১৮ই জুলাই তাঁর বাবার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন সন্ধ্যায় তাঁর চট্টগ্রামের গুডস হিলস্থ বাসভবনে আমার এক সহপাঠী তাঁর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে যতবার তিনি চট্টগ্রাম এসেছেন ততবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেছি। ডিসেম্বরের শেষের দিকে কোনো একদিন তিনি আমাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে ঢাকা পাঠান। কাজ দুটি সম্পন্ন করে আমি তাঁকে রিপোর্ট করি। সে দিন আমার মনে হয়েছিল, কাজ দুটি ভালোভাবে করতে পারায় তিনি আমার প্রতি বেশ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সেদিন তাঁর মতিঝিলস্থ বাণিজ্যিক অফিসে তাঁর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং তিনি আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে আমার করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে আমাকে চট্টগ্রাম গিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলেন। এরপর আমি চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীও বেরিয়ে তাঁর চেম্বারে ঢুকেন এবং আমাকে ডেকে নেন। আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি আমাকে তাঁর বড় ভাইয়ের একান্ত সচিব হিসাবে নিয়োগের বিষয়টি জানান। কিছুদিন পর ১৯৭৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের (স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সংসদ) নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারিখ ঘোষিত হয়েছিল।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সার্বিক তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা, তদারকি এবং তাঁর সকল নেতা কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমে জনগণের বিপুল ভোটে ফটিকছড়ি, রাউজান এবং রাঙ্গুনিয়া–এই তিন সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের জাঁদরেল প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাউজান ও রাঙ্গুনীয়া এই দুই আসনে তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে মাত্র ২৯ বছর বয়সে এম.পি. নির্বাচিত হয়ে সারা দেশে বিস্ময় ও চমক সৃষ্টি করেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৯ সালের বাজেট অধিবেশনে তিনি যে যৌক্তিক ও ক্ষুরধার বক্তব্য রেখেছিলেন তাতে তাঁর প্রজ্ঞার, মেধার ও দূরদৃষ্টির স্ফুরণ এবং সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি এবং সংবিধান সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের পর্যাপ্ততার যে প্রকাশ ঘটেছিল তা সারা দেশে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছিল এবং তখন থেকেই তিনি একজন ভালো পার্লামেন্টেরিয়ান হিসাবে সকলের মনযোগ কেড়েছিলেন।
আমি অত্যন্ত নিকট দূরত্ব থেকে দেখেছি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে শেখ হাসিনার অন্তরঙ্গতা। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল সমূহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করলে বিরোধী দল সমূহ কর্তৃক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বিরোধী দলীয় মোর্চার মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সফলভাবে এই দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় এই দুই নেতা, সালাউদ্দিন কাদের এবং শেখ হাসিনা অত্যন্ত কাছাকাছি থেকে আন্দোলনের গতি প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ করতেন। আমি দেখেছি সংসদ ভবনস্থ বিরোধী দলীয় নেতা হাসিনার অফিসে এবং সংসদের বিরোধী দলীয় এমপিদের লবীতে আরো অনেক সিনিয়র নেতাদের সাথে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং হাসিনা খোশ গল্পে মেতে উঠতেন। সেখানে চলত চা–কফি খাওয়া আর আড্ডা। এক অজ্ঞাত কারণে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এবং বিশেষ করে ২০০২ সালে ও.আই.সি. মহাসচিব নির্বাচনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালে উভয়ের উষ্ণ সম্পর্ক শীতলতম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। শেখ হাসিনা ও তাঁর দল দেশে এবং বিদেশে ও.আই.সি. নির্বাচনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ভোট না দেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালান। তখন থেকে শেখ হাসিনা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ ও ঈর্ষা পোষণ করে এসেছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার নেতৃত্বে সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে এদেশের মানুষ দেখেছে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত বড় নেতা, মেজ নেতা, সেজ নেতা, ছোট নেতা, জেলা–ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির ৪০০ কোটি টাকার মালিক পিয়ন, পুলিশ, আমলা এরা কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হল। আলাদিনের চেরাগ ঘষলেও এত টাকা কামানোর কথা নয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন সৎ মানুষের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি নিজের অর্জিত অর্থে রাজনীতি করেছেন, অর্থাৎ রাজনীতি করার জন্য নিজের টাকা খরচ করেছেন। আর এসকল ব্যক্তিরা রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তারা রাজনীতি করে অর্থ আয় করেছেন। ব্যাংক লুট, আর অর্থ পাচার করে এবং ঋণ খেলাপী হয়ে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়েছেন। আর দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাঁর অর্জিত অর্থে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, আনোয়ারা, কর্ণফুলী এসব উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুল, কলেজ, মেটারনিটি হাসপাতাল সমাজকল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠান। একটি বিশেষ গোষ্ঠী সবসময় চেয়েছে তাঁকে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিসেবে প্রতিপন্ন করতে। তাদের জ্ঞাতার্থে আমি একটি কথা বলতে চাই। তাঁর ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক অফিসে যত কর্মকর্তা–কর্মচারী রয়েছেন তৎমধ্যে ত্রিশ ভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাদের মধ্যে ঢাকার অফিসের অসিত কুমার বিশ্বাস ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী, যিনি এখন প্রয়াত এবং স্বপন কুমার ঘোষ নির্বাহী পরিচালকের মত সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। চট্টগ্রামস্থ তাঁর শিপিং অফিসের এক সময়ের ম্যানেজার ছিলেন প্রয়াত সুধীর কুমার বিশ্বাস এবং তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত স্টেনোগ্রাফার ছিলেন প্রয়াত সাধন চন্দ্র চক্রবর্তী। তাঁর স্টিভিডরিং বিভাগের প্রধান কেনেথ এন্থনী।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন একজন আপাদমস্তক সৎ এবং ভালো মানুষ। তিনি গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর মর্যাদার প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টাসহ ছয়বার সংসদ সদস্য ছিলেন। এত সব পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে বা এর পরবর্তীতে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অসাধুতার বিন্দুমাত্র অভিযোগ পাওয়া যায় নি। তাঁর দুর্নীতির খবর বের করার জন্য কতিপয় সংবাদ মাধ্যম এবং বিভিন্ন সরকারি তদন্ত সংস্থা সবসময়ই সক্রিয় ছিল। তাঁর সম্পর্কে কতিপয় সংবাদ মাধ্যমের অপপ্রচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যাতে থাকত ব্যক্তিগত আক্রমণ, আক্রোশ আর বিদ্বেষ। তাঁকে ভিলেন রূপে প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল একটি গোষ্ঠী। তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত কোনো সংবাদের প্রতিবাদ পাঠালে এসব সংবাদ মাধ্যম যে সব প্রতিবাদ লিপি হয়তো বিকৃত করে প্রকাশ করত অথবা প্রকাশ করত না। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত কতিপয় সংবাদ মাধ্যমের এই অনৈতিক কর্ম চলমান ছিল।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন সৎ, দক্ষ প্রশাসক, সিংহ হৃদয়ের অধিকারী, নির্লোভ জনবান্ধব নেতা। তাঁর মত সৎ এবং জনকল্যাণকামী নেতা বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব, সততা, সত্য কথনে নির্ভীকতা তাঁকে পতিত সরকার প্রধানের চক্ষুশূল, ঈর্ষা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছিল। তাইতো তৎকালীন তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নামক কাশিমবাজার কুঠিতে ‘বিচার’ নামক নাটক মঞ্চায়ন করার মাধ্যমে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে চরমতম দণ্ডে দণ্ডিত করে পতিত শেখ হাসিনা সেদিন তাঁর অন্তরের লালিত ঈর্ষা আর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছিলেন। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার কি কখনো ভেবেছিল চরম আতংকজনক অশনি সংকেত নিয়ে ৫ই আগস্টের মত একটি দিন এদেশে আসবে এবং এদেশের সব জাতি ধর্ম দলমতের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়বে এবং এসব মানুষের অন্তরে টগবগ করে ফুটতে থাকা রোষের লাভা স্রোত ফ্যাসিবাদী সরকারের নেত্রী শেখ হাসিনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পূর্ব মূহূর্তে তাঁকে সামরিক বাহিনীর বদান্যতায় ভিন দেশে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হবে। তিনি নিশ্চয় সেদিন বুঝেছিলেন মৃত্যু কত কাছে এসে পড়েছিল এবং আতংক কাকে বলে। যদি বুঝেও থাকেন, তবে এই বুঝতে পারাটা সাময়িক। যাদের হাত অসংখ্য মানুষের রক্তে রঞ্জিত তাদের মৃত্যু ভয় সহজে আসে না। জুলাই–আগষ্টের গণঅভ্যুত্থান, বিগত ১৬ বছরের গুম, আয়না ঘরের অসংখ্য মানুষ হত্যার সাথে যাদের সম্পৃক্ততা, তাদের মৃত্যু ভয় না থাকারই কথা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামের আদালতের রায় আগেই নির্ধারিত হয়েছিল এবং সে রায় নিয়ে বিচারকদের মধ্যেকার টেলিফোন সংলাপ বিচারের আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। গত ১৬ বছরে, গণঅভ্যুত্থানে, আয়নাঘরে পৈশাচিকভাবে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের বেঁচে থাকা স্বজনদের অন্তরের গহীন থেকে নির্গত অভিশাপ মাখা দীর্ঘশ্বাস এই ফ্যাসিবাদের হোতাদের ধ্বংস করে দেবে। সর্বশক্তিমান বিধাতার কাছে দাখিলকৃত আবেদনের বিচারও একদিন হয়ে যাবে, যেমন হয়েছে ৫ই আগস্ট।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন কারো স্বামী, কারো পিতা আর অনেকের নেতা। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক। জ্ঞান–বুদ্ধি এবং শিক্ষার সামান্য কিছু যদি আমার মধ্যে থেকে থাকে তা’ শিখেছি আমার পরিবার, শিখেছি আমার শিক্ষায়তন থেকে আর শিখেছি আমার শিক্ষক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন সরকারি–বেসরকারি দপ্তরে চিঠিপত্র লেখার কায়দা এবং সরকারি–বেসরকারি দপ্তর থেকে প্রাপ্ত চিঠির জবাব লেখার পদ্ধতি। তাঁর কাছ থেকে শিখেছি কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংসদের কার্যক্রম, শিখেছি কার্যপ্রণালী বিধি মোতাবেক নোটিশ প্রদানের বিষয়, শিখেছি সংসদের উত্থাপিত বিলের সংশোধনী নোটিশ, Private Members Bill প্রস্তুত এবং বাজেটের উপর কিভাবে বিভিন্ন নোটিশ দিতে হয় তার নিয়ম বিধি। ইংরেজি ও বাংলায় সহজ ভাষায় কম কথায় কীভাবে সুন্দর চিঠি ড্রাফট করা যায় তিনি আমায় শিখিয়েছেন। সংসদে তাঁর পূর্ব নির্ধারিত কোনো বক্তৃতা থাকলে কয়েক দিন আগে থেকে বক্তৃতার বিষয়ে এবং সমর্থনে তাঁর নির্দেশিত মতে বিভিন্ন তথ্য ও দলিল সংগ্রহের জন্য তিনি আমাকে নির্দেশ দিতেন। এসব তথ্য প্রাপ্তির প্রধান ও অন্যতম উৎসস্থল ছিল সংসদ লাইব্রেরী, হাইকোর্ট লাইব্রেরী, পাবলিক লাইব্রেরী, ন্যাশনাল আর্কাইভ। এসব তথ্য–সংশ্লিষ্ট কাগজ যোগাড়ের জন্য বেশ কয়েকদিন এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হত এবং সংগৃহীত তথ্যসমূহ নিয়ে তাঁর সাথে বসে বাছাই করে নির্বাচিত তথ্যসমূহ তাঁকে বুঝিয়ে দিতাম। এসব তথ্যের আলোকে তিনি সংসদে ভাষণ দিতেন যা দেশব্যাপী সমাদৃত হত। তাঁর নির্বাচনী এলাকা রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে তাঁর যোগাযোগের মাধ্যম ছিলাম আমি। ব্যস্ততার বা বিদেশে অবস্থানের কারণে সবসময় তাঁকে পাওয়া না গেলে সরকারি কর্মকর্তারা আমার মাধ্যমে তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। এছাড়া তাঁর নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে এলজিআরডি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, স্বাস্থ্য, ধর্ম, যোগাযোগ এসব মন্ত্রণালয়ে পেন্ডিং কাজের ফলোআপের জন্য আমাকে যেতে হত। অনেক সময় এসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা সচিবের সাথে দেখা করতাম। আমার তদবিরে কাজ না হলে উনি নিজেই আমাকে নিয়ে সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেতেন। মন্ত্রী, সচিব এসব আমলাদের সাথে সাক্ষাত করে তাদের মুখোমুখি হয়ে কথা বলার এক সময়কার ভীতি ও নার্ভাসনেস কেটে গিয়ে নিজের উপর আমার আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে।
এসব কাজে আমি তখন শঙ্কাহীন, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সাবলীল হয়ে উঠি। তাঁর সাথে আমার স্মৃতিপূর্ণ জায়গাগুলির মধ্যে সংসদ ভবনের দক্ষিণ পশ্চিম ব্লকের ৮২৩ নম্বর এবং পশ্চিম ব্লকের ২২২নং নম্বরের তাঁর অফিস কক্ষ, সংসদ লাইব্রেরী, মতিঝিলস্থ শিপিং অফিস, ধানমণ্ডির বাসভবনের লাইব্রেরী কাম স্টাডি রুম এবং অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী চট্টগ্রামের বাসভবন গুডস হিল।
জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় রোগ–জরায় আক্রান্ত এই দেহ নিয়ে যাপিত দিনের অলস সময়ে স্মৃতির পাখিরা আমার চারপাশে উড়ে উড়ে আমাকে নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে তুলছে। নষ্টালজিয়া আর আবেগ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় দূর এক অজানায়, অন্তহীন গহীন অন্ধকারে ঢাকা এক সুদূর প্রান্তরে। যেখানে পাড়ি জমিয়েছেন আমার শিক্ষক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ‘হে মহান, কে বলে আজ তুমি নাই, লক্ষ হৃদয় মাঝে তুমি নিয়েছ যে ঠাঁই।’
লেখক : বর্ষীয়ান নাগরিক ও সমাজকর্র্মী